Advertisement
১১ মে ২০২৪

এসো আমার বনে এসো

রাজ্যের বন দফতরের প্রস্তাব অনুসারে জাতীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ অধিকর্তা বক্সা ব্যাঘ্রপ্রকল্পে বাঘের পুনর্বাসন করতে চায়। সারিস্কা বা পান্নায় এমন উদ্যোগ ইতিমধ্যেই সাফল্য পেয়েছে। হয়তো আগামী মাসখানেকের মধ্যেই চার-পাঁচটি বাঘ-বাঘিনী ছাড়া হতে পারে বক্সায়।

বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

রাজ্যের বন দফতরের প্রস্তাব অনুসারে জাতীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ অধিকর্তা বক্সা ব্যাঘ্রপ্রকল্পে বাঘের পুনর্বাসন করতে চায়। সারিস্কা বা পান্নায় এমন উদ্যোগ ইতিমধ্যেই সাফল্য পেয়েছে। হয়তো আগামী মাসখানেকের মধ্যেই চার-পাঁচটি বাঘ-বাঘিনী ছাড়া হতে পারে বক্সায়। রাজ্যবাসীর কাছে এটা আনন্দের খবর।

কিন্তু চিন্তাও সেখানে। আজকের বক্সা বাঘের জন্য কতটা সুরক্ষিত? কতটা উপযোগী বাঘের বসবাসের জন্য?

বক্সার বনে দু’বছরের একটি সমীক্ষা সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। বন দফতরের সহায়তায় ২০১৪ সালে সত্তরটি ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ লাগানো হয় বক্সায়। পর্যায়ক্রমে এক একটি রেঞ্জে রাখা হয় ক্যামেরাগুলো। অতিবেগুনি রশ্মি ব্যবহার করে এই ক্যামেরা দিনে বা রাতে কোনও প্রাণী কাছে আসলেই ছবি তুলতে পারে। সব চাইতে বেশি বন্যপ্রাণীর দেখা মিলেছে কুমারগ্রাম রেঞ্জ, গদাধর রেঞ্জ এবং ফাঁসখাওয়া বিটে। কিন্তু দু’বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করেও বাঘের দেখা মেলেনি। মেলেনি পায়ের ছাপ, বা অপর কোনও চিহ্ন। আপাতত ধরে নিতেই হয়েছে, বক্সায় বাঘ নেই। যত দিন না তেমন কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলছে। বন দফতরের কর্তাদের শুনেছি বটে, তাঁরা বাঘের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে টের পেয়েছেন। কিন্তু তিরিশ বছরে অসংখ্য বার বক্সার জঙ্গলে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় আমি বাঘ থাকার কোনও ইঙ্গিত পাইনি।

কিন্তু সমীক্ষায় এ-ও দেখা গেল যে বক্সার মতো জীববৈচিত্র ভারতে প্রায় কোনও ব্যাঘ্রপ্রকল্পে নেই। বাঘের জ্ঞাতিগোষ্ঠী ক্লাউডেড লেপার্ড, লেপার্ড ক্যাট, মার্বেল ক্যাট, জাঙ্গল ক্যাট, চিতাবাঘ রয়েছে এই বনে। রয়েছে বাঘেরই মতো সমান বিপন্ন বুনো কুকুর (ঢোল)। স্বাধীনতারও আগে বন দফতরের কর্তাদের বন নিয়ে যে ‘ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ ছিল, তা অনুসারে বক্সাতে হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চলের নানা প্রাণী থাকার কথা। যেমন ‘বিন্টুরং’, যা ভামের প্রজাতি, কালো ভাল্লুকছানার মতো দেখতে। কাঁকড়াভুক বেজি, হিমালয়ের ঝুঁটিহীন শজারু, হিমালয়ের পাহাড়ি ছাগল ইস্টার্ন সেরো, চিনে বনরুই। তারা সত্যিই আছে কি না, অনেক দিন স্পষ্ট ছিল না। লুকোনো ক্যামেরা জানিয়ে দিল, তারা সবাই আছে বক্সার বয়ড়া, শাল, কাটুস, লালি গাছের আড়ালে। আর আছে হাতি। তাদের লাথিতে আট-ন’টি ক্যামেরা ভেঙেছে।

আক্ষেপের কথা, ক্যামেরায় এমনও কিছু ছবি ধরা পড়েছে, যা জঙ্গলের প্রাণী ও গাছের নিরাপত্তার জন্য ভয়ানক। ছবিতে দেখছি রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে অবাধে ঘুরছে কিছু মানুষ। হাতে তির-ধনুক থেকে শুরু করে এ কে ফর্টি সেভেন, সব রকমই রয়েছে। ভলকা রেঞ্জে সাধারণ ক্যামেরায় তোলা এমনও ছবি আছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে ষাট ফুট লম্বা একটা সেগুন গাছ কেটে করাত দিয়ে তক্তার মতো কেটে সাজিয়ে রাখা আছে। কোনও এক সময়ে তা পাচার করা হবে। বিভিন্ন রেঞ্জে এমন গাছ কাটার নিদর্শন মিলেছে। যা থেকে স্পষ্ট, বনের নিরাপত্তার অভাব যথেষ্ট। গভীর জঙ্গল থেকে গোটা চারেক ক্যামেরা চুরি গিয়েছে, যার অর্থ মানুষ হানা দিচ্ছে সেখানেও।

ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য বক্সার মতো বিপন্ন ব্যাঘ্রপ্রকল্প ভারতে আর একটিও নেই। জঙ্গলের স্বাভাবিক বিস্তার অসম, ভুটান, নেপালে। ভিন্‌দেশের চোরাশিকারিদের যাতায়াতের রাস্তা খোলা। ভারতের জঙ্গল থেকে নেপালে হাতি ঢুকলে প্রায়ই তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়। চোরাশিকারিদের অস্ত্র উন্নত। বন দফতরের কর্মী কম, ফরেস্ট গার্ডদের হাতে একনলা বন্দুক। সম্প্রতি অবশ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থায় কিছু উন্নতি হয়েছে, কর্মী বেড়েছে, নজরদারির টহল বেড়েছে। এতে বিপন্নতা কিছুটা হলেও কমবে।

তবু চিন্তা থাকছে বাস্তুতন্ত্র নিয়ে। বাঘের শিকার হরিণ-জাতীয় প্রাণী। তেমন তৃণভোজীদের খাবারের অভাব চোখে পড়ার মতো। কারণ বক্সায় মোট বনভূমির তিরিশ শতাংশ সেগুনের বন। যা প্রাকৃতিক ভাবে জন্মায়নি, কারণ সেগুন বক্সার মতো জায়গার স্বাভাবিক গাছ নয়। বছর চল্লিশ আগে কোনও বন দফতরের কর্তার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে এই পরিকল্পনার জন্ম। সেগুনের পাতা অনেক বড়, তাই মাটি পর্যন্ত রোদ পৌঁছয় না। ফলে বনভূমিতে ঘাস জন্মায় না। মাস আষ্টেক আগে বনকর্তাদের চেষ্টায় নিমাতি রেঞ্জে পরীক্ষামূলক ভাবে ঘাস লাগানো হয়েছে জলদাপাড়া থেকে এনে। এগুলো দ্রুত হারে বাড়ে। ইতিমধ্যেই এখানে হরিণ, ভারতীয় গাউর জাতীয় প্রাণীর মল মিলেছে ভাল পরিমাণেই। সাবেকি বাস্তুব্যবস্থা ফেরানোর এটা একটা প্রচেষ্টা। কেবল বাঘ নয়, বক্সার চিতাবাঘ, বন্য কুকুর, সবার জন্যই এটা ভাল খবর। মনে হয় যে, বিভিন্ন পর্যায়ে বিশাল সেগুনের জঙ্গল কেটে ঘাস লাগানো গেলে তৃণভোজীর কাজে লাগবে। তা থেকে ফের ফিরবে বক্সার জীববৈচিত্রের ভারসাম্য। সেগুনের কাঠ বিক্রি থেকে যে অর্থ মিলবে, তা খরচ হতে পারে বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণে।

রাজ্য সরকারের বন্যপ্রাণ উপদেষ্টার পর্ষদের সদস্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Buxa Tiger Reserve
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE