Advertisement
০৫ মে ২০২৪

সব শহর হোক দুর্গাপুরের মতো

একটি শহর নিয়ে এল মুক্তির স্বাদ। লিখছেন বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায়একটি শহর নিয়ে এল মুক্তির স্বাদ। লিখছেন বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায়

একটি শপিং মলের সামনে কবীর। নিজস্ব চিত্র

একটি শপিং মলের সামনে কবীর। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৭:৩২
Share: Save:

ঠিক এক বছর হল দুর্গাপুরে এসেছি। পরিকল্পনা করে গড়ে উঠেছিল এ শহর। প্রথম দিন থেকেই অসংখ্য গাছ আর খোলামেলা রাস্তা দেখে শহরটা ভাল লেগে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরে, আমার ছেলে কবীরকে কেন্দ্র করে সেই ভাল লাগাটা কী ভাবে ভালবাসায় উত্তীর্ণ হল, সেই গল্পটিই বলি।

কবীরের ডুশেন মাস্কিউলার ডিস্ট্রফি (Duchenne Muscular Dystrophy) আছে। এর ফলে শরীরের পেশিগুলি আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যায়। স্বভাবতই কবীরকে হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হয়, যার ফলে ওর ঘোরাফেরা পারতপক্ষে বাড়ির একতলা আর সামনের উঠোনের মধ্যেই সীমিত। ফুটপাথ দিয়ে চলা মুশকিল। কারণ, ওর যন্ত্রচালিত হুইলচেয়ারের চাকা একটু উঁচু-নিচু হলেই আটকে যায়। সিনেমা দেখতে কবীর খুব ভালবাসে, কিন্তু সিনেমা হলে ঢোকা দুষ্কর। কারণ, সিঁড়ি বা চৌকাঠ ডিঙনো ওর পক্ষে অসম্ভব।

দুর্গাপুরে এসে বহুদিন পরে কবীর মুক্তির স্বাদ পেল। আমরা থাকি সিটি সেন্টারে। এখান থেকে কাছের মলে পায়ে হেঁটে চলে যাওয়া যায়। রাস্তার ধারে ফুটপাথ আছে। কিন্তু সেটা বাঁধানো নয়। তাই আমরা ফুটপাথ দিয়ে হাঁটি আর কবীর হুইলচেয়ার নিয়ে রাস্তা দিয়ে লাউবুড়ির মতো গড়গড় করতে করতে যায়। তার ফলে, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে অন্য গাড়িকে গতি কমিয়ে পাশ কাটাতে হয়। এতে তাদের এক-আধ মিনিট সময় নিশ্চয়ই নষ্ট হয়। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল আজ পর্যন্ত কেউ এই নিয়ে চেঁচামেচি করা দূরে থাক, অধৈর্য প্রকাশ করে হর্নও পর্যন্ত বাজাননি।

আরও পড়ুন-ক্ষমাভিক্ষুক

শপিং মলের অভিজ্ঞতাও ততই ভাল। উপরে ওঠার যে র‌্যাম্প বা ঢালুপথ আছে, তার ঢাল কম এবং সেটা দৃষ্টিনন্দন হয়ে সিঁড়ির সঙ্গে মিশে আছে। প্রবেশদ্বারে সুরক্ষাকর্মীরা বিনা অনুরোধেই ধাতু-সনাক্তকারী যন্ত্রটি এক পাশে সরিয়ে কবীরকে ভিতরে ঢুকিয়ে নেন। সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষেরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ভারী কাচের দরজাগুলি টেনে ধরে রাখেন। এমনকি, লিফটে ঢোকার সময় কেউ না কেউ হাত দিয়ে লিফটের দরজাটা আগলে রাখেন যাতে আচমকা বন্ধ হয়ে ধাক্কা না লাগে। সিনেমা হলে ঢোকার মুখে কোনও চৌকাঠ নেই, তাই সোজা গিয়ে পেছনের সারির একটা আসনের পাশে হুইলচেয়ারটাকে রেখে, সেটাতেই বসে সিনেমা দেখে নেওয়া যায়।

শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য এ রকম স্থাপত্য সঙ্গে একটু সৌজন্য, আর সময় মতো একটু সাহায্যের হাত, এগুলি পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা বা পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে সহজলভ্য। কিন্তু আমাদের দেশে যে কতটা বিরল সেটা যাঁরা প্রতিদিন এ সব অসুবিধে, অবহেলা এবং অপমানের সম্মুখীন হন, তাঁরাই জানেন।

আরও পড়ুন- এই কাশ্মীর নিয়ে গর্ব!

আশা করি, ভারতের সব শহর দুর্গাপুর হয়ে উঠবে। সে দিন আমরা সবাই মাথা উঁচু করে দেশের সব সিনেমা হল, স্কুল-কলেজ, কারখানা-অফিস এবং স্টেশনে কবীরের মতো ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াতে পারব।

চিকিৎসক এবং বিভাগীয় প্রধান, জীবাণুবিজ্ঞান বিভাগ, আইকিউ সিটি মেডিক্যাল কলেজ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE