Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
ধর্ম আর রাজনীতি নিয়ে এই অশিক্ষিত অসভ্যতা

খোলাখুলি যা বলা দরকার

আমি এক জন দেবদেবীর পুজো-করা হিন্দু। ধর্মপরায়ণ এবং ঈশ্বরবিশ্বাসী নাগরিক। আমি গভীর ভাবে বিশ্বাস করি যে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই অনেক বিভাজন রয়েছে। এ দেশটায় অনেক হিন্দুই বিশ্বাস করতে পারেন যে রামচন্দ্র অযোধ্যায় জন্মেছিলেন আর ওই বিতর্কিত জায়গাতেই জন্মেছিলেন।

অন্যায়: ইতিহাসের একপেশে ব্যাখ্যায় ভর করে আছে যে হিন্দুত্বের রাজনীতি, তার তত্ত্বাবধানে রামমন্দিরের শিলান্যাস, অযোধ্যা, ১৯৮৯

অন্যায়: ইতিহাসের একপেশে ব্যাখ্যায় ভর করে আছে যে হিন্দুত্বের রাজনীতি, তার তত্ত্বাবধানে রামমন্দিরের শিলান্যাস, অযোধ্যা, ১৯৮৯

সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০৫
Share: Save:

অনেক দিন ভেবেছি রামজন্মভূমি সংক্রান্ত বিবাদ-বিতর্ক নিয়ে একটা খোলাখুলি লেখা লিখেই ফেলি। লিখিনি, অনেকে দা-কাটারি নিয়ে মুখিয়ে আছেন বলে। মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট এই বিবাদের বিষয়ে এখনই কোনও সিদ্ধান্ত জানাচ্ছে না। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত যা-ই বলুক না কেন, রামজন্মভূমিতে মন্দির (পুনঃ)প্রতিষ্ঠার জন্য হিন্দুত্ববাদী নাগরিকেরা বদ্ধপরিকর। স্পষ্টতই সরকার বাহাদুরও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে, অন্তত আপাতদৃষ্টিতে। কিন্তু আসলে একটা কথা তো পরিষ্কার— সময় এসেছে চিরতরে এ ধরনের বাদবিতণ্ডাকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠানোর। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, সাধারণ মানুষের ধ্যানধারণা, মানসিকতাকে সম্মান জানিয়ে, ভবিষ্যতে কোনও দিন যাতে এ ধরনের সমস্যার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আর বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক আচরণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও কিছু ক্ষেত্রে বৌদ্ধিক ভণ্ডামিকে সামনে রেখেই আইনানুগ পদক্ষেপের প্রয়োজন। রামজন্মভূমি সম্পর্কিত বিতর্কে ঢোকার আগে এবং এ ধরনের অসভ্য বিতর্ককে সপাটে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার আগে ইতিহাসের এবং ইতিহাসের নামে ধর্ম নিয়ে হাতাহাতির আবহাওয়াটা খানিকটা সহজ ও পরিষ্কার করে বোঝা প্রয়োজন।

আমি এক জন দেবদেবীর পুজো-করা হিন্দু। ধর্মপরায়ণ এবং ঈশ্বরবিশ্বাসী নাগরিক। আমি গভীর ভাবে বিশ্বাস করি যে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই অনেক বিভাজন রয়েছে। এ দেশটায় অনেক হিন্দুই বিশ্বাস করতে পারেন যে রামচন্দ্র অযোধ্যায় জন্মেছিলেন আর ওই বিতর্কিত জায়গাতেই জন্মেছিলেন। কিন্তু তাঁদেরও এক বৃহদংশ ইতিহাসকে শুধরে ঠিক করার নামে মসজিদ ভাঙতে চাইবেন না। বৃহদংশ কেন— এই দেশটার সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধির স্বপ্নে যাঁরা উজ্জীবিত হন সেই সব হিন্দুই ইতিহাসকে ঠিকঠাক করে নেওয়ার ব্যাপারে মত দিতে দু’বার ভাববেন। যাঁরা বিশ্বাস করেন যে ওই বিতর্কিত জায়গাতেই রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং পরে এক সময় কেউ জোর করে সেখানে একটা মসজিদ তৈরি করেছে, তাঁদেরও একটা কথা তা হলে মানতে হবে। সেটা এই যে, ইতিহাসে আজ পর্যন্ত যিনি বা যাঁরা যত ভুল করেছেন, অন্যায় করেছেন তিনি বা তাঁরা যখন মৃত তখন তাঁর বা তাঁদের প্রতিনিধিদের শাস্তি পেতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবারই শাস্তি হওয়ার প্রয়োজন।

যেমন ধরুন এই কলকাতা শহরে বা দেশের অন্যান্য অনেক জায়গায় হিন্দুধর্মের মানুষজন সদ্য-পতিহারা মেয়েদের চিতায় ওঠাতেন সেখানে পুরোহিতদের বিধান ছিল নিরঙ্কুশ। একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই বোঝা যাবে কোন কোন পরিবার এই নিধনযজ্ঞে জড়িত ছিলেন। আমরা সেই সব পরিবারকে চিহ্নিত করে আজকে সেই সেই পরিবারের সদস্যদের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠাতে পারি। তাঁদের ঘটিবাটি বাজেয়াপ্ত করতে পারি। যে মানুষ ইতিহাস জানে না, বাবর জানে না, রামচন্দ্র নিয়ে যার কোনও মাথাব্যথা নেই, সে কিন্তু ওখানে প্রার্থনা জানাতেই আসে। ঈশ্বরের নামগানের জন্য। আর আপনি যদি নির্বুদ্ধি এবং মূর্খ হিন্দু না হন তা হলে নিশ্চয়ই জানেন যে আধুনিক ভারতবর্ষের শাসকগোষ্ঠীর সবাই যাঁর নাম উঠতে বসতে স্মরণ করেন বা যাঁর মূর্তি পুজো করেন সেই স্বামী বিবেকানন্দ এবং তাঁর গুরুদেব যত মত তত পথের কথা বলেছেন। তা হলে কাকে বা কাদের শাস্তি দিতে চাইছেন আপনারা? আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, সব ধর্মেই মূর্খ, স্বার্থান্বেষী, উন্মাদ, ধর্মাবলম্বীদের গোষ্ঠী প্রভাবশালী ভূমিকা গ্রহণ করতে চায়। তাই মহামান্য শীর্ষ আদালতের একটি আইনের প্রস্তাব করা প্রয়োজন। যদি অতীতের কোনও ধর্মীয় কুকার্য এবং অন্যায়কে ঠিক করতে গিয়ে দেশে সামাজিক শান্তি লঙ্ঘিত হওয়ার এতটুকু সম্ভাবনা থাকে তা হলে যাতে শুরুতেই সেই সম্ভাবনা নির্মূল করা যায়, তেমন আইন বা বিচারবিভাগীয় নির্দেশ আবশ্যক।

যেখানে সেখানে মন্দির-মসজিদ তৈরি হলে সামাজিক স্বার্থে সেগুলোও নির্দ্বিধায় ধবংস করা প্রয়োজন। “রামচন্দ্রের জন্মের জায়গায় মসজিদ তৈরি হলে অন্যায় হয়েছে”— যাঁরা রামচন্দ্রের জন্মবৃত্তান্ত বিশ্বাস করেন তাঁরা নিশ্চয় এটা ভাবতে পারেন। যাঁরা এতে আদৌ বিশ্বাস করেন না তাঁরা এ নিয়ে বক্তব্য পেশ করতে পারেন। যাঁদের কিছুই যায় আসে না তাঁরা চুপ করে থাকতে পারেন। যাঁরা রামচন্দ্রের জন্য অপমানিত বোধ করছেন তাঁরা, আর যাঁরা মসজিদে ঈশ্বরকে দুটো কথা বলতে যান কিন্তু রামচন্দ্রকে অশ্রদ্ধা করেন না, তাঁরাও ক্ষুব্ধ হতে পারেন। সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের সবাইকে নিয়েই ভারতবর্ষ। কিন্তু সবার আগে সামাজিক শান্তিরক্ষা।

ঐতিহাসিক ভাবে কার দিকে অন্যায়ের পাল্লা ভারী তা সত্যিই বলা শক্ত। এ দেশে ইসলাম এসেছিল বলে কিছু অত্যাচারিত মানুষ জায়গা পেয়েছিল। আবার পরধর্মনিপীড়নের সুযোগ পেয়ে মন্দির ধরাশায়ী করেছেন অনেক দুর্বৃত্ত। সবই ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। এ দিক ও দিক তাকিয়ে একটা কথা স্বীকার করব আর অন্যটা করব না, এটা ভণ্ডামি। ইতিহাসকে একপেশে নজর দিয়ে দেখার জন্য রাজনীতির মানুষ, তথাকথিত উদারমনা কিন্তু একপেশে রাজনীতির প্রতিভূ, রাজনৈতিক ভাবে সঠিক হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় চেষ্টিত ধুরন্ধর গোষ্ঠী, অন্য দিকে নিতান্তই স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত, “আমার ধর্ম সবচেয়ে বড়”, এ কথা ভাবা মূর্খ গোষ্ঠী, সবাই দায়ী। একেবারে খোলাখুলি ভাবে কতকগুলো কথা বলা ভীষণ প্রয়োজন।

এ দেশে এবং এই উপমহাদেশে অনেক মন্দির ধ্বংস হয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে, হয় শাসকের মদতে বা অন্য ভাবে। শাসক শোষিতকে অত্যাচার করে বা অত্যাচার করার সুযোগ খোঁজে। এটা নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ নীতির মতোই সত্য। এটাই ইতিহাস। কিন্তু মানুষ তো এখন ধর্ম-উৎসারিত হানাহানি ভুলে গিয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে গণতন্ত্রের সাহায্যে অসাম্প্রদায়িক ভাবে বাঁচতে শিখেছে। সহাবস্থানের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহযোগিতার সাহায্যে উন্নয়নের মুখ দেখেছে। ভারতবর্ষ তাই টিকে আছে। মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ হয়েছে বললে নিজেকে “সাম্প্রদায়িক সাম্প্রদায়িক” মনে হবে— এই ধরনের মিনমিনে এবং ব্যক্তিত্বহীন মানসিকতা দেশটাকে ধ্বংস করেছে বলে আজ সংসদে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই “হিন্দু গেল-গেল” রাজনীতি জাঁকিয়ে বসতে পেরেছে।

মুসলমান এ দেশে না এলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এক আলুনি শিল্প হয়ে থাকত। এ দেশের অপূর্ব সঙ্গীতের আধারকে বহুগুণ ঔজ্জ্বল্য ও ব্যাপ্তি দিয়েছে ইসলামের প্রভাব। খাওয়াদাওয়ার কথা তো ছেড়েই দিলাম। অত্যাচারী শাসক অন্যায় কাজ করছে আর খাঁ সাহেবরা গেয়েছেন “মন মোহন ব্রিজাকে রসিঁয়া’’ কিংবা “হরি ওম তৎসৎ”। একের পর এক শিল্পী সুরের ধর্ম দিয়ে সব রকম ধর্মীয় বিভাজনকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। মাইহারবাসী ও বেনারসবাসী দুই খাঁ সাহেবের কথা কে না জানে। মন্দির ভেঙে ইসলামের প্রচার কোনও পির-পয়গম্বর সমর্থন করেছেন কি? অন্যায়ের পাশাপাশি ইসলামের কাছে এই দেশ কতটা ঋণী এবং কী ভাবে ঋণী, তারও প্রচার প্রয়োজন। কিন্তু দেশ সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চার প্রচার তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কারণ অজ্ঞানতাই এখনকার গণতন্ত্রের আভরণ। শুধু রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি আর ইতিহাসের সত্য ঘটনাগুলোকে আড়াল করার চেষ্টার প্রতিফল আমরা ভোগ করছি প্রতিনিয়ত।

সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Religion Politics Ayodhya Ram Janmabhoomi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE