Advertisement
২৭ মার্চ ২০২৩
ভবিষ্যতে পাকিস্তান চিনের ‘ইজরায়েল’ হয়ে উঠতে পারে

স্বার্থ আছে, তাই কাছাকাছি

আসলে পাক রাজধানীতে চিনা নাগরিকদের উপরে সরাসরি এই উগ্রপন্থী হানা বেজিং একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। পাক প্রেসিডেন্টকে চিনা প্রধানমন্ত্রী চু রংচি পরে স্মরণও করিয়ে দিয়েছিলেন যে, বিনিয়োগকারীরা এক ঝাঁক পায়রার মতো।

হঠকারী: ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের চিন ভূখণ্ডে প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ার প্রতিবাদে স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের বিক্ষোভ। নয়া দিল্লি। পিটিআই

হঠকারী: ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের চিন ভূখণ্ডে প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ার প্রতিবাদে স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের বিক্ষোভ। নয়া দিল্লি। পিটিআই

সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

বছর দশেক আগের কথা। ২৪ জুন, ২০০৭। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এক মহল্লার এক মাসাজ পার্লার ও আকুপাংচার চিকিৎসা কেন্দ্রে হঠাৎই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে এক দল সশস্ত্র মানুষ। হানাদারদের অভিযোগ, ওই পার্লার ও ক্লিনিকে গোপনে দেহব্যবসা চালানো হত। সমাজের স্বঘোষিত ওই নজরদারদের সঙ্গে যেতে অস্বীকার করায় সেখানকার কর্মীদের মারধর করা হয় ও শেষ অবধি সাত জন চিনা কর্মী ও দু’জন পাকিস্তানি নাগরিককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কাছের লাল মসজিদে। একেবারে রাজধানীতে, দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রের প্রায় ঢিলছোড়া দূরত্বে এমন অপহরণের ঘটনা ঘটায় বিব্রত জেনারেল পারভেজ মুশারফ সরকারকে এর অব্যবহিত পরেই অতীতের নরম মনোভাব ছেড়ে এই উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে বহুচর্চিত লাল মসজিদ অভিযান চালাতে হয়েছিল। পাকিস্তান পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, বস্তুত এই আপাত অকিঞ্চিৎকর অপহরণ পাকিস্তানি রাজনীতির মোড় অনেকটাই ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

Advertisement

আসলে পাক রাজধানীতে চিনা নাগরিকদের উপরে সরাসরি এই উগ্রপন্থী হানা বেজিং একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। পাক প্রেসিডেন্টকে চিনা প্রধানমন্ত্রী চু রংচি পরে স্মরণও করিয়ে দিয়েছিলেন যে, বিনিয়োগকারীরা এক ঝাঁক পায়রার মতো। দেশের সরকারের ভুল পদক্ষেপে তারা ভয় পেলে, পুরো ঝাঁকই সেই দেশ থেকে পালিয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে, অপহরণের পরের বেশ কয়েক ঘণ্টা স্বয়ং চিনা রাষ্ট্রপতি হু জিনতাও ইসলামাবাদের চিনা কূটনীতিকদের মাধ্যমে পাকিস্তানি পদক্ষেপের উপর কড়া নজর রেখে চলেছিলেন। ২০০১-এর পর জঙ্গি দমনের দাবিতে পাকিস্তানের উপরে ওয়াশিংটনের চাপ বেড়েছে। পাক ভূখণ্ডেই ড্রোন হানা-সহ মার্কিন সেনা অভিযান হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের সামগ্রিক নীতি বদলের ইঙ্গিত মেলেনি। আমেরিকা যা পারেনি, অপহরণের পরে চিন তা পেরেছে। আমেরিকা পাকিস্তানের প্রতিবেশী নয়, চিন প্রতিবেশী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও এমন কথাই বলেছিলেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-কে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের প্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন, আমরা প্রতিবেশী নই, প্রতিবেশী আপনারা। অতএব এ বারে প্রস্তুতি নিন।

উল্লেখ্য, ওই ২০০৭-এ চিন-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মূল্য যেখানে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার ছিল, ২০১৫-১৬-তে তা তিন গুণেরও বেশি বেড়ে হয়েছে ১৩৭০ কোটি মার্কিন ডলার। বর্তমানে পাকিস্তানে বিদেশি বিনিয়োগের শতকরা চল্লিশ ভাগই চিনের। অর্থাৎ, আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের দূরত্ব যতই বেড়েছে, বেজিংয়ের সঙ্গে ইসলামাবাদের নৈকট্যও ততই বেড়েছে। সোভিয়েত সেনা আফগানিস্তানে প্রবেশের পর ওয়াশিংটন নতুন পর্যায়ে সোভিয়েত-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষিতে উপমহাদেশের রাজনীতিতে মাথা ঘামিয়েছিল বটে, কিন্তু আফগান ভূখণ্ড থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারে আমেরিকার আগ্রহ কমে যায়। আমেরিকার মাটিতে সন্ত্রাসের ঘটনা আবার ওয়াশিংটনকে এই অঞ্চলে টেনে আনে। বিপ্রতীপে, এই অঞ্চলের আর্থ-রাজনীতিতে চিনের স্থায়ী উপস্থিতি ইদানীং কালে, বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশের পরিকাঠামো সুদৃঢ় করার নামে নিজেদের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকে আরও সুনিশ্চিত করতে বেজিং নতুন উদ্যমে নতুনতর উদ্যোগে আগ্রহী। এই প্রেক্ষিতে ইসলামাবাদের চিনকে যেমন প্রয়োজন, বেজিংয়েরও নিজের অর্থনীতি ও জ্বালানী নিরাপত্তার স্বার্থে পাকিস্তানকে দরকার। অতএব, ১৯৭১-এর পাকিস্তান আর আজকের পাকিস্তান মোটেও এক নয়।

২০১৩ সালে কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানা-তে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং ‘নিউ সিল্ক রোড’-এর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই ভাবনায় চিন তার প্রতিবেশী অঞ্চলকে নিজ অর্থনীতির সঙ্গে জুড়তে চায়। এরই অংশবিশেষ প্রস্তাবিত ‘চিন-পাকিস্তান ইকনমিক করিডর’। আনুমানিক অন্তত ছ’হাজার কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের এই করিডর চিনা প্রেসিডেন্টের স্বপ্নের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবর) প্রকল্পেরই অন্তর্গত। এর ফলে চিনা প্রযুক্তি ও আর্থিক সাহায্যে আরব সাগরের তীরে নবনির্মিত গ্বদর বন্দরের সঙ্গে জুড়তে চলেছে পশ্চিম চিনের জিনজিয়াং প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর কাশগর। এ ভাবেই পশ্চিম এশিয়ার তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল ভাণ্ডারের সঙ্গে নিজেদের ভূখণ্ডের দূরত্ব কমাতে চাইছে বেজিং। প্রস্তাবিত এই প্রকল্প চিনের সঙ্গে আফ্রিকার দূরত্বও কমাবে, কমাবে ইউরোপীয় বাজারের সঙ্গেও তার দূরত্ব। চিনের স্বার্থে নতুন ভাবে সংযুক্ত হবে ভারত মহাসাগর, পারস্য উপসাগর ও ভূমধ্যসাগর। আর তাই, পাকিস্তান পরিণত হতে পারে চিনের নয়া ‘জিনজিয়াং’-এ। চিনা ভাষায় ‘জিনজিয়াং’ শব্দের অর্থ ‘নয়া সীমান্ত’। সুতরাং এই নয়া সীমান্তের নিরাপত্তা চিনের কাছে অগ্রাধিকার পাবে— এটাই স্বাভাবিক।

Advertisement

বেজিং সম্প্রতি পাকিস্তানে অত্যাধুনিক বন্দর, মহাসড়ক, সেতু, রেলপথ ও পাইপলাইন নির্মাণের এক সুবৃহৎ পরিকল্পনা নিয়েছে। এ সবই কারাকোরাম মহাসড়ক সম্প্রসারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কিত। সম্পর্কিত চিনের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে। ইসলামাবাদ এই করিডর তৈরির অনুমতি দেওয়ায় চিনের অনেক বাণিজ্যিক জাহাজ বা তেলবাহী ট্যাংকারকেই আর ভারত মহাসাগরের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে না। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নিকটবর্তী ও চিনের দিক থেকে তুলনায় কম সুরক্ষিত মালাক্কা প্রণালী পেরোতে হবে না। এর ফলে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান চিনের উপনিবেশে পরিণত হবে কি না, অথবা বালুচিস্তানের বিদ্রোহী এবং পাকিস্তানে সক্রিয় অন্য ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি চিন ও পাকিস্তানের এই যৌথ প্রয়াসকে মেনে নিতে পারবে কি না, সে ভিন্ন প্রশ্ন। দুই দেশেরই আপাত কল্যাণের নিরিখে ইতিমধ্যেই এই ‘করিডর’ রক্ষার স্বার্থে পাক সরকার পনেরো হাজার লোকের এক বিশেষ বাহিনী গড়ে ফেলেছে। এই প্রেক্ষিতে অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তান চিনের ‘ইজরায়েল’ হয়ে উঠতেই পারে।

মোদ্দা কথা, চিনের কাছে এই পরিকল্পনা এখন দেশের নতুন আর্থিক দিশা এবং জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন। অন্য দিকে, প্রস্তাবিত ‘চিন-পাকিস্তান করিডর’ যে হেতু জম্মু-কাশ্মীরের বিতর্কিত আকসাই চিন অঞ্চলের মাঝখান দিয়ে যাবে, নয়া দিল্লির পক্ষে তা মানা কঠিন। ভারত বেজিংয়ে চিন-আয়োজিত ও সম্প্রতি বেজিংয়ে অনুষ্ঠিত ‘ওবর’ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দেয়নি। চিন এখন ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক সঙ্গী হলেও ডোকলাম অচলাবস্থা নিয়ে মাসাধিক কালব্যাপী দু’পক্ষের তীব্র চাপানউতোর অব্যাহত। তিব্বতে চিনের সেনা সমাবেশও ক্রমবর্ধমান। চিনা ডুবোজাহাজ পাকিস্তানের বন্দরে সম্প্রতি নোঙর করায় নয়া দিল্লি যেমন উদ্বিগ্ন, ভারত-আমেরিকা-জাপানের সদ্যসমাপ্ত ‘মালাবার’ নৌমহড়ায় বেজিংও বিরক্ত। এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতার নিরিখে নয়া দিল্লিকে তার ইদানীং দিশাহীন প্রতিবেশ নীতি পরিমার্জন করতে হবে। সামগ্রিক বিদেশ নীতিকেও ঢেলে সাজাতে হবে। আর, বর্তমান বাস্তবকে মাথায় রেখেই ভারত ও চিনের দ্বিপাক্ষিক সমস্যাকে বিভিন্ন কূটনৈতিক উপায়ে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মেটাতে হবে। উভয় তরফেই কোনও হঠকারী পদক্ষেপ বা উত্তেজিত মন্তব্য সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। দুই দেশের মানুষের স্বার্থে এটা প্রয়োজন। চাণক্যের দেশের কূটনীতিকদের কাছে অন্তত এমন প্রত্যাশা অমূলক নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.