Advertisement
১১ মে ২০২৪
Hindi

ভাষা-বাদ

প্রণিধানযোগ্য, কেবল সামগ্রিক অর্থে ‘হিন্দু ভারত’ নহে, উত্তর-মধ্য ভারতের হিন্দু ‘হিন্দি বলয়’টিতেই ফুলে-ফলে পল্লবিত এই ভাষা-রাজনীতি।

ছবি: পিটিআই

ছবি: পিটিআই

শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২০ ০০:৪৬
Share: Save:

একটু একটু করিয়া মুখোশ খসিয়া পড়িতেছে? নূতন জাতীয় শিক্ষানীতিতে সংবিধান-স্বীকৃত বাইশটি ভাষার সমগুরুত্বের কথা উল্লেখ করিয়াও কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক বলিলেন, বিশ্বে ভারতের পরিচিতি কিন্তু হিন্দিতেই। ভারতীয় জনতা পার্টির হিন্দিকে জাতীয় ভাষা করিয়া তুলিবার ও শিক্ষানীতির মাধ্যমে ঘুরপথে হিন্দি চাপাইয়া দিবার অভিযোগ বারংবার বিরোধীরা তুলিয়াছেন, বারংবার সরকার তাহা নস্যাৎ করিয়াছে। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যের পর বিরোধী অভিযোগের সারবত্তা আর অস্বীকার করা যায় না। সাম্প্রতিক শিক্ষানীতিতে ত্রি-ভাষা নীতির প্রয়োগ দেখিয়া অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছিলেন, এই পথে দেশ জুড়িয়া হিন্দির প্রচার ও প্রসার আসন্ন। সরকারি নীতিতে প্রাথমিক স্তর হইতে যে কোনও তিনটি ভাষা শিখিবার কথা বলা হইলেও কার্যক্ষেত্রে অধিকাংশ স্থলে আঞ্চলিক ভাষা ব্যতীত ইংরাজি ও হিন্দি না শিখাইয়া উপায় নাই। তাহার পশ্চাতে একাধিক প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক কারণ বিদ্যমান। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের সুর গত বৎসরের হিন্দি দিবসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রদত্ত বক্তৃতার সারকথার সহিত মিলিয়া গেল। তবে কি ধরিয়া লওয়া যায়, অতঃপর হিন্দির ছত্রচ্ছায়ায় লালিত হওয়াই ভারতের বহুভাষার ভবিতব্য?

প্রণিধানযোগ্য, কেবল সামগ্রিক অর্থে ‘হিন্দু ভারত’ নহে, উত্তর-মধ্য ভারতের হিন্দু ‘হিন্দি বলয়’টিতেই ফুলে-ফলে পল্লবিত এই ভাষা-রাজনীতি। অর্থাৎ আঞ্চলিক আগ্রহকেই তাহা সমগ্র ভারতবাসীর ইচ্ছা বলিয়া দেখাইতে তৎপর। নূতন ঘটনা নহে, ইহা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ঐতিহ্যগত চরিত্র। ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ নামক জনপ্রিয় স্লোগানটি স্মরণ করিলেই দুইয়ের ভিতর যোগসূত্র স্পষ্ট হয়। এই সূত্রকে মান্যতা দিবার কূট-উদ্দেশ্যেই এই অঞ্চল ‘হার্টল্যান্ড’ বা হৃদয়স্থল বলিয়া চিহ্নিত হয়। অপর ভাষাভাষী ভারতীয়েরা দেশের হৃদয়ে ঠাঁই পাইবার যোগ্য বিবেচিত হন না।

বাস্তবিক ওই হৃদয়-ধারণাটির মধ্যেই সঙ্কট লুকাইয়া। কোনও এক প্রাচীন আর্যাবর্তের উত্তরাধিকারের গর্ব হইতে ধারণাটির উৎপত্তি, এবং প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রের বহুলাংশই যে হেতু এই ধারণার ছত্রচ্ছায়ায় উৎসারিত, তাহাতেও এই ভৌগোলিক মহিমার বিস্তার। অথচ ইতিহাস বলে, ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চল হইতে ক্ষমতাকেন্দ্র বেদ-উত্তর যুগে পূর্বাভিমুখে বিস্তৃত হইয়াছিল, এবং দক্ষিণাংশে প্রসারিত হইয়াছিল ভিন্ন ক্ষমতার দাপট। দ্রাবিড়ভূমির সহিত এই আর্যাবর্তের সম্পর্ক এক বিরাট সময়কাল ধরিয়া যথেষ্ট ক্ষীণ ছিল, ভিন্ন ভাষাভাষী সম্প্রদায়গুলির মধ্যেও ছিল বিস্তর দূরত্ব। প্রাক্-আধুনিক যুগে তাহা কোনও সমস্যা তৈরি করে নাই, কেননা রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক একত্বের চাপ সেখানে ছিল না। বহুত্ব ছিল স্বাভাবিক বাস্তব, ‘বহুত্ববাদ’ বলিয়া কোনও তত্ত্ব বা তর্কের প্রয়োজন ছাড়াই। পরবর্তী কালে জাতিরাষ্ট্রের ধারণাটির সঙ্গে আবির্ভূত হইয়াছে এই এক-বাদ, এবং কিছু কিছু রাজনীতির পরিসরে সেই অ-ভারতীয়সুলভ সাংস্কৃতিক একমাত্রিকতা বিশেষ আক্রমণাত্মক হইয়া উঠিয়াছে। বলিবার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান শাসক রাজনীতি সেই সাংস্কৃতিক আক্রমণে বিশ্বাসী। ইহা প্রবল দুর্ভাগ্যের দ্যোতক— কেননা, ভাষা যে মানুষের অন্তরের ধন, সেই আবেগকে এই একবাদী রাজনীতি আমল দিতেই প্রস্তুত নহে। আজ তাই কেন্দ্রীয় আয়ুষ মন্ত্রকের একটি অনুষ্ঠানে সচিব জানাইয়াছেন, হিন্দি ভাষা লইয়া কাহারও সমস্যা থাকিলে তিনি নির্দ্বিধায় অনুষ্ঠান ত্যাগ করিতে পারেন। ভারতীয়ত্ব প্রমাণে তামিলনাড়ুর ডিএমকে সাংসদ কানিমোঝিকে হিন্দিতে কথা বলিবার নির্দেশ দিয়াছেন এক সরকারি আধিকারিক। দেশের নানা প্রান্তে লাঞ্ছিত হইতেছেন অহিন্দিভাষীরা। দেশের ‘কিছু’ মানুষের আকাঙ্ক্ষার চাপে আজ ‘বহু’ মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি বিপন্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hindi Languages
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE