বিহারের রক্সৌল থেকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু পর্যন্ত রেল যোগাযোগ গড়ে তোলার সমঝোতায় পৌঁছল দুই দেশ।
দীর্ঘ আত্মীয়তা নেপালের সঙ্গে। কিন্তু সম্পর্কে টান পড়েছিল। নেপাল তার দক্ষিণের প্রতিবেশী ভারতের উপর নির্ভরতা কমিয়ে উত্তরের প্রতিবেশী চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর নীতি নিয়েছিল। নেপালের তরফে সে নীতি হয়তো এখনও বহাল। কিন্তু ভারতের তরফে সতর্ক কূটনীতি এবং ভারসাম্যের পদক্ষেপ। ফলটা ইতিবাচকই। বিহারের রক্সৌল থেকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু পর্যন্ত রেল যোগাযোগ গড়ে তোলার সমঝোতায় পৌঁছল দুই দেশ।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি ঘোষিত ভাবেই চিনপন্থী। নির্বাচনী প্রচারে নেপালের গ্রামে-গ্রামান্তরে ভারত বিরোধী কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল ওলির দলের জনসভাগুলিতে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে নিজের একাধিক পদক্ষেপে এবং কথাবার্তায় ওলি বুঝিয়ে দিয়েছেন, চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নেপাল বাড়াবে। কিন্তু ভারত সফররত ওলি এখনও পর্যন্ত যা কিছু বললেন এবং করলেন, তাতে স্পষ্ট, নয়াদিল্লিকে সম্পূর্ণ দূরে ঠেলার পথে হাঁটতে পারছেন না তিনি।
সব দিক দিয়েই স্থলভাগে ঘেরা দেশ নেপাল। সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে নেপালের যোগাযোগ নেই। ভৌগোলিক কারণে নেপালের সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজনীয়তা মেটানো চিনের পক্ষে কঠিন। চিনের কোনও বন্দর যদি ব্যবহার করতে চায় নেপাল, তা হলে যতখানি ঘুরপথে যাতায়াত করতে হবে, অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক হিসেবে তা লাভজনক নয়। পণ্য পরিবহণের জন্য নেপালের সামনে সবচেয়ে লাভজনক পথ ভারতীয় সমুদ্রবন্দরগুলি ব্যবহার করা। ভারত সফরে এসে নেপালি প্রধানমন্ত্রী সেই আশ্বাস পেয়ে গেলেন। ভারতের অভ্যন্তরীণ জলপথ এবং সমুদ্রবন্দর নেপাল ব্যবহার করতে পারবে, দিল্লি এবং কাঠমান্ডু এমন সমঝোতায় পৌঁছল। সমঝোতা শুধু জলপথেই থেমে থাকল না, রেলপথেও দৌড়ল। ভারতীয় রেল নেপালের রাজধানী পর্যন্ত রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, এমনটাই স্থির হল।
নেপালের সঙ্গে রেল যোগাযোগ গড়ে তোলার পথে পা বাড়িয়েছে চিনও। চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিন ফিংয়ের স্বপ্নের প্রকল্প ওয়ান বেল্ট ওয়ান রো়ড-এ অংশগ্রহণ করছে নেপাল। কাঠমান্ডুর এই সব পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে নয়াদিল্লির মাথাব্যথা বাড়িয়েছিল। এ বার নয়াদিল্লির পদক্ষেপ বেজিংয়ের মাথাব্যথা বাড়াবে। নেপালের জন্য ভারত নিজের জলপথ খুলে দেবে এবং ভারতীয় রেলকে নেপাল কাঠমান্ডু পর্যন্ত স্বাগত জানাবে, এমন খবর চিনের অস্বস্তি বাড়াবেই।
আরও পড়ুন: লগ্নি চেয়ে সুর নরম ওলির
ভারত সফরে আসার আগে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর একটি সাক্ষাৎকার বিতর্ক বাড়িয়েছিল। কে পি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন নেপাল ভারতের চেয়ে চিনের দিকে ঝুঁকে থাকতেই বেশি পছন্দ করবে, এমন আভাস মিলেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর তরফেও তাই ঈষৎ শীতলতার বার্তা যায়। ওলিকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে যাননি মোদী। পাঠান রাজনাথকে। বিমানবন্দরে রাজনাথকে পাঠানো যদি হয় শৈত্যের বার্তা, তা হলে বৈঠকে উষ্ণতা উপহার দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন মোদী। অতএব দিনের শেষে ভারসাম্যের বার্তা গেল কাঠমান্ডুর কাছে। অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস নয়, আবার দূরে ঠেলাও নয়— নেপালের জন্য ভারতের নীতি আপাতত এই ওলিকে তা বুঝিয়ে দেওয়া হল।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
দু’টি ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করল দিল্লি। প্রথমত, ভারত-নেপাল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি। চিনের সঙ্গে নেপালের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধিকে ভারত ভাল চোখে দেখছে না, কিন্তু দীর্ঘ দিনের আত্মীয়তাও ভুলে যাচ্ছে না। নয়াদিল্লি প্রথমত এই রকম অবস্থানই নিল। দ্বিতীয়ত নয়াদিল্লি চিনকে বুঝিয়ে দিতে চাইল, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে অন্য সব দেশের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার চেষ্টা কোনও ভাবেই সফল হওয়ার নয়। পশ্চিমে পাকিস্তান এবং উত্তরে চিন— এই দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপড়েন বিস্তর। কিন্তু বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানকেও ভারতের থেকে দূরে সরানোর যে চেষ্টা চিন চালাচ্ছে, তা সহজে সফল হওয়ার নয়। কারণ এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি ভারতের উপর নানা ভাবে নির্ভরশীল এবং ভারত প্রয়োজন মতো প্রতিবেশীদের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতেও থাকবে। এমনটা বুঝিয়ে দেওয়া হল চিনকে।
সতর্ক পদক্ষেপই করেছে নয়াদিল্লি। অতিরিক্ত আগ্রাসন নিয়ে চিনের মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টা খুব একটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়, মোদীর সরকার একটু দেরিতে হলেও তা বুঝল। আবার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিকে চিনা প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে ভারত যে খুব বেশি মাথা নোয়ানোর নীতিতে হাঁটবে না, সে কথাও এক প্রতিবেশীকে বুঝিয়ে দেওয়া হল। কূটনীতির পরিসরে আপাতত এ হেন সতর্ক পদক্ষেপই জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy