Advertisement
E-Paper

জেলবন্দি ও নাগরিক সমাজ

মার্কিন দেশের এই ঘটনা এই রাজ্যের নাগরিক সমাজকেও কিঞ্চিৎ নাড়া দেবে না কি? এ দেশে এমন নাগরিক উদ্যোগ বেশি প্রয়োজন, কারণ এখানে জেলবন্দিদের প্রতি সরকারি বঞ্চনা, উদাসীনতা অনেক বেশি।

রঞ্জিত শূর

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৯ ০০:০০

চরম ঠান্ডার মধ্যে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন জেলে। ফলে ঘর গরম করার যন্ত্র কাজ করছিল না। তার পরে যা হল, তা গোটা দুনিয়ায় ‘খবর’ হয়ে উঠল। জেলের ষোলোশো আবাসিক গরম জামা, জল ও খাবারের অভাবে মরিয়া হয়ে জেলের দেওয়াল চাপড়াতে থাকেন। ওই শব্দ বাইরে নাগরিকদের কানে যায়। তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন তাঁরা। বন্দিদের জন্য কম্বল, জামাকাপড়, জল, খাবার নিয়ে জেল-গেটে বিপুল সংখ্যায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। মাইকে ভিতরের বন্দিদের সাহস জোগানোর বার্তা দেন। বন্দিদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে প্রবল শীতের মধ্যে জেল-গেটের বাইরে ক্যাম্প করে দিবারাত্রি থাকতে শুরু করেন অনেকে। সরকার ও জেল কর্তৃপক্ষ বলপ্রয়োগ করে, লঙ্কাগুঁড়ো ছিটিয়ে জনতাকে হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ‌অতঃপর প্রাথমিক উদাসীনতা দ্রুত সক্রিয়তায় পরিণত হয়। বিদ্যুৎ যোগাযোগ ফেরে, দুর্দশার অন্ত হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলি এবং নাগরিকরা কিন্তু এখনও সরব। এই অবস্থা কার গাফিলতিতে হল, তা খুঁজে বার করে শাস্তি দাবি করছেন তাঁরা। ভবিষ্যতে এমন আর হবে না, তার নিশ্চয়তা চাইছেন।

মার্কিন দেশের এই ঘটনা এই রাজ্যের নাগরিক সমাজকেও কিঞ্চিৎ নাড়া দেবে না কি? এ দেশে এমন নাগরিক উদ্যোগ বেশি প্রয়োজন, কারণ এখানে জেলবন্দিদের প্রতি সরকারি বঞ্চনা, উদাসীনতা অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গের জেলে সম্প্রতি যা ঘটল, সে দিকে নজর দিলেই তার ইঙ্গিত মেলে। দক্ষিণ কলকাতার আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে (আলিপুর সেন্ট্রাল জেল বলে অধিক পরিচিত) ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হল সুদীপ চোংদার নামে এক রাজনৈতিক বন্দির। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও উচ্চ-রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ না পেয়ে স্ট্রোক এবং মৃত্যু হল তাঁর। এ বিষয়ে তাঁরা লিখিত অভিযোগও করেছেন কারা দফতরের শীর্ষ কর্তার কাছে। কিন্তু তদন্ত শুরু হয়নি। সুদীপ অপরিচিত নন। তিনি এক সময়ে নিষিদ্ধ মাওবাদী দলের রাজ্য সম্পাদক ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ বা কার্যকলাপের সঙ্গে ভিন্নমত যে কেউ হতে পারেন। কিন্তু তাঁর চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার, মানুষের মতো বাঁচার অধিকার নিয়ে কি সংশয় থাকতে পারে? তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন বছর বয়সে, সাধারণ কিছু ওষুধের অভাবে তাঁর মৃত্যু হল কি না, সে প্রশ্নটা কি কাউকে নাড়া দেবে না?

সুদীপবাবুর মৃত্যু এই রাজ্যের জেল ব্যবস্থা, বিশেষত তার চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ফের বেআব্রু করল। পরিবারের অভিযোগ, বার বার ওষুধ চাইলেও প্রতি বারই বলা হয়েছে, ‘নো স্টক’ অর্থাৎ ওষুধ নেই। কলকাতারই প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দিদের অভিযোগ, ওষুধের জন্য আবেদন বা ‘রিকুইজ়িশন’ এক পাতা পূর্ণ না হলে কেনার জন্য পাঠানোই হয় না। বিকেল চারটের পরে ফার্মাসিস্ট এলে তবেই ওষুধ মেলে। আর ওষুধ বলতে সর্বরোগহর অ্যান্টাসিড আর প্যারাসিটামল!

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের হিসাব মতো রাজ্যে ২০১৮ সালে বিরানব্বই জন বন্দির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। ২০১৭ সালে মৃত্যু হয়েছে একশো দশ জনের। হবে না-ই বা কেন? মানবাধিকার সংগঠন ‘এপিডিআর’ তথ্যের অধিকার আইনের অধীনে যে আবেদন করেছিল, তার জবাবে রাজ্য কারা দফতর জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের সাতান্নটি জেলে স্থায়ী পদে ডাক্তার আছেন মাত্র চার জন। অস্থায়ী এবং আংশিক সময়ের ডাক্তার আছেন পঁচিশ জন। ন’জন স্থায়ী এবং ছাব্বিশ জন অস্থায়ী ফার্মাসিস্ট আছেন। এই হিসেব পয়লা জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত। যত দূর জানা যায়, এর পরেও সংখ্যার হেরফের হয়নি।

সাতান্নটি জেলে কত বন্দিকে সেবা করেন এই ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টরা? কমবেশি ত্রিশ হাজার। এ রাজ্যের জেলগুলিতে ঠিক কত বন্দি আছেন জানা যাবে না, কারণ কারা দফতরের ওয়েবসাইট কাজ করে না। রাজ্য তথ্য কমিশনারের নির্দেশ আছে প্রতি সপ্তাহে প্রতিটা জেলের বন্দিদের তথ্য আপডেট করতে হবে। পাত্তাই দিচ্ছে না কারা দফতর। গত জুলাই মাসে কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, ছ’মাসের মধ্যে জেল হাসপাতাল-ফার্মাসির সমস্ত শূন্যপদ পূরণ করতে হবে। সেই নির্দেশও মান্যতা পায়নি। একটি পদও পূরণ হয়নি।

পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে, তার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আলিপুর সেন্ট্রাল জেল, প্রেসিডেন্সি জেল এবং আলিপুর মহিলা জেল খালি করা হবে। এই তিন জেলের প্রায় পাঁচ হাজার বন্দি কোথায় যাবেন? বারুইপুরের নির্মীয়মাণ জেলে হাজার দেড়েক বন্দির জায়গা হবে। বাকিদের, কারামন্ত্রী বলেছেন, ‘‘অন্যান্য জেলে ‘খাইয়ে’ দেওয়া হবে।’’ ইতিমধ্যেই জেলগুলোয় অতিরিক্ত বন্দিতে দমবন্ধ অবস্থা। শুয়ার জায়গা পর্যন্ত নেই। আরও সাড়ে তিন হাজার বন্দিকে ঢোকানো হলে জেলের দশা তো খোঁয়াড়কেও হার মানাবে। তবে কি জেলবন্দিরা নেহাতই একটা সংখ্যা? তিন বার খাওয়া আর ছ’বার গুনতি, হিসেব মিললেই হল?

জেলের খাবারের মান যাচাইয়ের তো প্রশ্নই নেই। জল প্রায়ই এত দুর্গন্ধযুক্ত যে মুখে দেওয়া যায় না। ক্ষমতা থাকলে জারিকেনের জল কেনা যায়। দমদম জেলে স্নানের জল থেকে চুলকানি হওয়ার অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। সম্প্রতি বারুইপুরের নতুন জেলে জলের দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়ে বেধড়ক মার খেলেন বন্দিরা। প্রশ্ন করলেই দূরদূরান্তরে বদলি, না হয় সলিটারি সেলে ঢুকিয়ে মশারি কেড়ে নিয়ে রাতভর মশার কামড় খাওয়ানো হয়, এমনই অভিজ্ঞতা বন্দিদের। শীতকাল হলে কাঁথা-কম্বল কেড়ে ঠান্ডায় ফেলে রাখা হয়। তেমন মারকুটে অফিসার হলে নাকি পিঠে লাঠিও ভাঙা হয়।

জেলবন্দির আর্তস্বর কি কারও কানে যায় না? মার্কিনরা যা শুনতে পান, বাঙালি তথা ভারতীয় কেন তার প্রতি বধির?

Prisoners Human Rights
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy