তিষ্ঠ: চিন ও ভারতের দ্বন্দ্ব প্রশমিত করার দাবিতে নেপালে চিনা দূতাবাসের সামনে মানবাধিকার কর্মীদের জমায়েত। কাঠমান্ডু, জুলাই। ছবি: এএফপি।
ডেটলাইন ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯। ভুটানের তৎকালীন রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘চিনের সঙ্গে ভুটানের সরাসরি কথা হওয়া প্রয়োজন।’ আজকের ভুটানের রাজার বাবা ছিলেন সিংগে ওয়াংচুক। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) হাভানা থেকে থিম্পু ফেরার পথে সাংবাদিক সঈদ নকভিকে তিনি বলেছিলেন, চিনের সঙ্গে কথা বলা মানে ভারতের বিরোধিতা করা নয়। চিনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলায় বাধা কী? আমরা তো ভারতকে জানিয়েই কথা বলছি। আর কথা বলতে চাইছি ভুটান নিয়েই।
১৯৪৯ সালের ভারতে-ভুটান চুক্তিতে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়, বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে ভুটান ভারতের উপদেশ মেনে চলবে। তা হলে ১৯৭৯ সালে ভুটান রাজা এই চুক্তির সুরে সুর না মিলিয়ে উপরোক্ত কথাটি বলেছিলেন কেন?
ফোন করলাম সঈদ নকভিকে। প্রবীণ সাংবাদিক বললেন, রাজা হাভানা থেকে ন্যামের বৈঠক সেরে মুম্বইতে আসেন। তিনি নিজেই সাক্ষাৎকারটি দিতে চেয়েছিলেন মুম্বইতে।
আজ এত বছর পর যখন ডোকলাম নামক ভূখণ্ডটি নিয়ে ভারত-চিন বিবাদ সংকটজনক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে তখনও কিন্তু সার্বভৌম ছোট্ট রাষ্ট্র ভুটান তার নিজের কথাটি নিজের মতো করে বার বার বলে চলেছে। ভুটান বলছে, (ডোকলামে নিরাপত্তা রক্ষার জন্য) তারা কখনওই নিজস্ব ভূখণ্ডের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ভারতকে অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর সুপারিশ করেনি। বরং বিতর্ক শুরুর আদিপর্ব থেকেই থিম্পু বার বার বলার চেষ্টা করছে, চিন ও ভারত, দু’পক্ষই ভুটানের ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিক। ভুটান শান্তিকামী দেশ। গ্রস হ্যাপিনেস ইনডেক্সকে গুরুত্ব দিয়ে চলা রাষ্ট্র। তারা দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শত্রুতার বলি হতে যাবে কেন? তাই তাঁর বাবাও সে দিন চিনের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন আর আজ তাঁর পুত্র, বর্তমান রাজাও থিম্পুতে চিনের দূতাবাস খুলতে চাইছেন। আর এই কাজটি ভুটান ভারতকে না জানিয়েও করছে না। চিনে ভুটানের দূতাবাস রয়েছে, আর থিম্পুতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দূতাবাস থাকবে না কেন?
১৯৪৯ সালের চুক্তি ১৯৯৬ সালে বদলে গেছে। চিনের সঙ্গে ভুটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত না হলেও ঘরোয়া ভাবে পারস্পরিক সম্পর্কে অনেক উন্নতি হয়েছে। তাই সংশোধিত চুক্তিতে ভুটানের সার্বভৌম বিদেশনী তির রাজনৈতিক নিজস্ব পরিসর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকের এক অফিসার অবশ্য চুক্তির কথা ফুৎকারে উড়িয়ে দেন। ‘চুক্তি ওই কাগজেই। ভুটানের আবার নিজস্ব সেনা আছে নাকি। ভারতই তো ভুটানের সেনা। তাই ও সব কাগুজে কথা অর্থহীন।’
ঘটনা হল, এ বার ডোকলাম বিতর্কে ভুটানকে এতখানি অবজ্ঞা করা মোদী সরকারের এক মস্ত ভুল। মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়েই প্রথম ভুটানে যান, সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু বাস্তবে ভুটান না চাইলেও তার দেশের নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাতে ভুটানে ভারত সেনা পাঠিয়ে দেবে, এটা কোনও যুক্তি হতে পারে? সেই ভুটান কামড়াতে না পারুক, ফোঁস যে করতে শুরু করেছে, তাতেও তো ভারতের উদ্বেগ বেড়েছে।
টানাপড়েনটা নতুন নয় আদৌ। ১৯৭৯ সালের সেই সাক্ষাৎকারেই তো ভুটানের যথার্থ সার্বভৌম হওয়ার বাসনা স্পষ্ট। অবশেষে ১৯৮৪ সালে ভুটানের প্রতিনিধি দল চিনে গিয়ে আলোচনা শুরু করে। ১৯৯৮ সালে চিন-ভুটান চুক্তি হয়।
এখানে একটু পুরনো ইতিহাসটা পর্যালোচনা করা দরকার। ১৯৭১ সালেই ভুটান রাষ্ট্রপুঞ্জে তার মিশন খোলে, কিন্তু সে সময়ে পি-ফাইভ অর্থাৎ দুনিয়ার স্বীকৃত পরমাণু-শক্তিধর পাঁচটি রাষ্ট্রের কাউকেই থিম্পুতে দূতাবাস খোলার পাল্টা অনুমতি ভারত দেয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পরে প্রথমে দিল্লিতে ভুটানের রাষ্ট্রদূতই বাংলাদেশে তার রাষ্ট্রদূত হিসাবেও কাজ করতেন। ১৯৭৭ সালের পর থিম্পুতে বাংলাদেশের দূতাবাস খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। মোরারজি দেশাই ১৯৭৭ সালে ক্ষমতাসীন হন। ভুললে চলবে না, তার আগেই হেনরি কিসিংগার ও তার পর প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭২ সালে চিন সফর করে এক নতুন প্রেম-পর্ব শুরু করেন। মোরারজির দৃষ্টিভঙ্গিও কিঞ্চিৎ ভিন্ন ছিল। তিনি অন্ধ সোভিয়েত-ভক্ত ছিলেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এমনকী চিনের সঙ্গেও বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন। মোরারজি ক্ষমতাসীন হওয়ার পরেই নয়াদিল্লিতে ভুটানের মিশন উন্নত হয়ে হাই কমিশনের মর্যাদা পায়।
ফিরে আসি সমকালে। সরকার ভেবেছিল, ভুটানের ভূখণ্ডে ভারতীয় সেনা দেখে ভয় পাবে চিন। বিদেশ মন্ত্রকের অফিসাররা বার বার বলেছেন, আপনারা সত্তরের দশকের মানসিকতায় বন্দি, তাই চিন শুনলেই ভয় পান। এ বার ভারত ডোকলামে সেনা পাঠিয়ে চিনের মনোবল ভেঙে দেবে। বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। ঘটনা হল, যুদ্ধ না করেও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে চিন ভারতকে দশ গোল দিয়েছে। মোদী সরকার বুঝতে পেরেছে চিন-পাক অক্ষ মজবুত। আমেরিকার নীতিও বাস্তবে সে রকম চিন-বিরোধী নয়। তাই নেহরুবাদী হতাশার একটি জোরদার কাউন্টারন্যারেটিভ রচনা করতে গিয়ে এখন মোদী সরকার বিদেশ নীতির ব্যর্থতায় জর্জরিত। উল্টে চিন এখন বলছে যে, ভারতীয় সেনার সম্পূর্ণ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত শান্তি আলোচনা শুরুই হবে না। এখন বোঝা যাচ্ছে, দেশের সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়ত থেকে বহু মন্ত্রী ও নেতার যুদ্ধ-জিগির সরকারকে আরও বিপদে ফেলে দিল। এখন চিনের চেয়েও ভারত শান্তি প্রয়াসে বেশি আগ্রহী।
সামন্ততান্ত্রিক এবং ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বেরোতে হবে। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার মাথার চাল উড়ে গেছে। এখন সবাই সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখবে, এই কূটনৈতিক অভিস্রবণ হল সব চেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা। সঈদ নাকভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে দিন ভুটানের রাজা বলেছিলেন, ‘ভারতীয় কিছু অফিসার ভাবছেন আমরা বোধহয় চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে আমাদের সাবেক বন্ধু ভারতকে ভুলতে চাইছি। এটা সত্যি নয়। আমরা চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক করতে চাই না। কিন্তু চিনের সঙ্গে কোনও সরকারি বোঝাপড়াই থাকবে না, এ কেমন কথা?’
আজ এত বছর পর যখন গোটা পৃথিবী এক আধুনিক মানসিকতায় সমৃদ্ধ হয়ে এগোতে চাইছে তখন ভুটানকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার প্রচেষ্টাই মুর্খামি। ভুটান সম্পর্কে ঔপনিবেশিক সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতাই চিন নীতির এই ভয়াবহ ব্যর্থতার জন্য অনেকটাই দায়ী। পেশি প্রদর্শন না করে আপাতত শান্তি পথেই সমাধান খোঁজা হবে উচিত কাজ!
১৯৫৮ সালে প্রধানমন্ত্রী নেহরু ইন্দিরাকে সঙ্গে নিয়ে চুম্বি উপত্যকায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা বন্ধু, কিন্তু ভুটানের সার্বভৌমত্বে আমরা বিশ্বাস করি। তার নিজের বিদেশ নীতি সে নিজেই স্থির করুক।’ নেহরু যে পরিসর দেওয়ার প্রয়োজনীয় অনুভব করেছিলেন, আজ সেই পরিসর প্রতিবেশীকে না দিলে বিপদ যে আমাদেরই বাড়বে, ডোকলাম বিতর্কের শিক্ষা এটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy