বালকেরা একে অপরের চাহিতে অধিক মার্বেল কিংবা কাচের গুলি পকেটে পুরিয়া খেলায় জিতিতে চায়। বাংলার রাজনৈতিক দলগুলি বোধ করি তেমনই বিদ্বজ্জন দলে পুরিবার খেলায় নামিয়াছে। সম্প্রতি কলিকাতায় ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধান অমিত শাহ প্রেক্ষাগৃহ ভরাইলেন ‘বিদ্বজ্জন’ দিয়া। অতঃপর তৃণমূল কংগ্রেস এত ‘বিদ্বজ্জন’ জড়ো করিল যে প্রেক্ষাগৃহ উপচাইয়া ভিড় নামিল রাস্তায়। এই খেলা নূতন নহে। বামফ্রন্ট জমানার অন্তিম পর্বে এই ভাবেই সাহিত্যিক, নাট্যকার, শিল্পী, শিক্ষকদের লইয়া টানাটানি পড়িয়াছিল। তাঁহাদের দেখাইয়া সভা ও পাল্টা-সভা, মিছিল ও পাল্টা-মিছিল, বিজ্ঞাপন ও পাল্টা-বিজ্ঞাপনে রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলিয়াছে। দেখিয়া রাজ্যবাসীর ধাঁধা লাগিয়াছে। কোথায় নাগরিক সমাজের কার্যসূচির শেষ হইয়া রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের শুরু, বুঝিতে নাকাল হইয়াছেন তাঁহারা। সেই ঘোরতর সংঘাতপূর্ণ ‘নাগরিক’ আন্দোলনের পরিণতিতে গায়ক-নায়ক, নাট্যকার-চিত্রনির্মাতাদের রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগ পাইতেও দেখিয়াছেন রাজ্যবাসী। তাহার ফলে ‘বিদ্বজ্জন’ কথাটিই সাধারণ সংলাপে লঘু হইতে হইতে প্রায় ভরশূন্য হইয়া গিয়াছে।
বাংলার মানুষ ভুলিতে বসিয়াছে, নাগরিক সমাজে বিদ্বজ্জনের প্রথম পরিচয় হইল রাজনৈতিক দল, প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রক্ষমতা হইতে তাহাদের স্বাতন্ত্র্য। রাষ্ট্রশক্তি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিধির সীমা নির্দিষ্ট করাই নাগরিক সমাজের কাজ। প্রশাসনের কার্যকলাপ বিষয়ে স্বাধীন মতামত প্রকাশের ক্ষমতা, প্রয়োজনে তাহাকে আঘাত করিবার সাহসই চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের জনসমাজের নেতৃত্বে আনিয়া দেয়। চিন্তা ও কথার স্বাধীনতা, যাহার স্থান গণতন্ত্রে কেন্দ্রে, তাহারই প্রয়োগ অবাধ ও নিরাপদ করিতে তাঁহাদের সদা সতর্ক থাকিতে হয়। আশ্বাসের কথা, সেই দায়িত্বটি সকলে বিস্মৃত হন নাই। নিদর্শন মিলিয়াছে এই রাজ্যেই। শিক্ষা, সাহিত্য, নাট্যচর্চা, সমাজ আন্দোলনের সহিত জড়িত নানা সুপরিচিত ব্যক্তি ভাঙড়ের আন্দোলনের বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়াছেন। তাহাতে বৈদ্যুতিন গ্রিড-বিরোধী গ্রামবাসীদের মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ করিবার প্রতিবাদ করিয়াছেন স্বাক্ষরকারীরা। শঙ্খ ঘোষ, নবনীতা দেবসেন, তনিকা সরকার, পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখদের বক্তব্য, সরকারি নীতি সমর্থন না করিবার অধিকার মানুষের আছে, কিন্তু তাহার প্রয়োগ করিতে গিয়া গ্রামবাসীরা আক্রমণের শিকার হইতেছেন। ভাঙড়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সংগঠকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনেরও প্রয়োগ করিয়াছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এই আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দীর্ঘ দিন বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করিয়া রাখা চলে। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা আবেদন করিয়াছেন, এই দমননীতি হইতে সরিয়া আসুক রাজ্য সরকার।
এই অবস্থান লইয়া বিতর্ক চলিতে পারে। কিন্তু বিদ্বজ্জনের জন্য নির্দিষ্ট কাজটি যে এই স্বাক্ষরকারীরা করিয়াছেন, সেই বিষয়ে দ্বিমত থাকিতে পারে না। নাগরিক সমাজ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অতন্দ্র প্রহরী। রাষ্ট্র তাহার সীমা লঙ্ঘন করিলে প্রতিবাদ করিতে হইবে নাগরিক সংগঠনকেই। গোটা দেশেই এই প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের পর্ব চলিতেছে। ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসিবার পর উগ্র হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন, ও তাহার ফলে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতার যে বাতাবরণ সৃষ্টি হইয়াছে, সাহিত্য-শিল্প-বিজ্ঞানের একাধিক ব্যক্তিত্ব তাহার প্রতিবাদ করিয়াছেন। কখনও রাষ্ট্রের দেওয়া পুরস্কার ফিরাইয়া, কখনও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখিয়া, কখনও সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়া তাঁহারা বুঝাইয়াছেন, ভারতের সমাজ সহনশীলতা ও বাক্স্বাধীনতার আদর্শ হইতে সরিবে না। ব্যক্তির অধিকারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সহিবে না। প্রবল প্রতিপক্ষের সম্মুখে সত্যভাষণের সাহসই বিদ্বজ্জনের পরিচয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy