Advertisement
E-Paper

ক্ষমতার নিবিড় আনন্দ

হিটলারের কর্মসূচি যদি সত্যি সত্যিই সফল হত, তবে ‘মস্তিষ্কহীন এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠত। যেখানে যুবকদের, অন্য কিছু নয়, শুধু যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। কামানের গোলার অন্তহীন উৎপাদন হয়ে চলত।’

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০

অ্যাডলফ হিটলারের বিশ্বখ্যাত আত্মজীবনী ‘মাইন ক্যাম্ফ’-এর ইংরেজি অনুবাদের হার্স্ট অ্যান্ড ব্ল্যাকেট সংস্করণটি ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়। ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’-এর স্রষ্টা জর্জ অরওয়েল ১৯৪০ সালের ২১ মার্চ ‘নিউ ইংলিশ উইকলি’-তে হিটলারের এই আত্মজীবনীর পর্যালোচনা করেন।

সেখানে অরওয়েল লিখেছেন, ‘প্রথমে হিটলার ছিলেন মানুষের কাছে এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। হিটলার জার্মান শ্রমিক আন্দোলনকে একদম নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ায় সম্পত্তিবান ধনী শ্রেণি খুব খুশি ছিল।’

হিটলারের কর্মসূচি যদি সত্যি সত্যিই সফল হত, তবে ‘মস্তিষ্কহীন এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠত। যেখানে যুবকদের, অন্য কিছু নয়, শুধু যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। কামানের গোলার অন্তহীন উৎপাদন হয়ে চলত।’

অরওয়েল বলেছেন, ‘এ কথা আমি অন রেকর্ড স্বীকার করতে চাই, হিটলার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রথমে তাঁকে অপছন্দ করবার কোনও কারণই আমি খুঁজে পাইনি। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই মনে হতে লাগল, খুব কাছাকাছি পেলে আমি ওঁকে মেরেই ফেলব। ঘটনা হল, ওঁর মধ্যে একটা প্রচণ্ড আবেদন আছে। তাই কোনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষও খুঁজে পাইনি।’ হার্স্ট অ্যান্ড ব্ল্যাকেট-এর সংস্করণে প্রকাশিত হিটলারের খাকি জামা পরা নবীন বয়সের ছবি দেখলে এই দুর্বলতা তৈরি হয়। ছবিটা বড় দুঃখের। কুকুরের মতো মুখ, কিন্তু ছবিটা একটা নিপীড়িত মানুষের। নানা রকম অন্যায় হয়েছে তাঁর শৈশবে। আত্মজীবনী পড়লে জানা যায়, শৈশব থেকে নানা অন্যায় অবিচারের শিকার হয়ে হিটলার গোটা পৃথিবীর উপরেই যেন রেগে আছেন। তাই তিনি যেন শহিদ। প্রমেথিউসের মতো। এর পরেই লিখেছেন সেই মোক্ষম বাক্যটি। হিটলার যদি একটি ইঁদুর মারেন তা হলেও তার প্রচারে মনে হবে তিনি একটা ভয়ংকর ড্রাগন মেরেছেন।

সাধারণত মানুষ নিরাপত্তা চায়, স্বাচ্ছন্দ্য চায়, কাজ করার সময়সীমা কমাতে চায়, জন্মনিয়ন্ত্রণ চায়, পরিচ্ছন্নতা চায়। কিছু মানুষ লড়াই সংঘর্ষ চায়, আত্মত্যাগ চায়। কিন্তু হিটলার তাঁর আনন্দহীন মনের জন্য অন্য পথে যান। অরওয়েল লিখেছেন, হিটলার বলেছেন, আই অফার ইউ স্ট্রাগল, ডেঞ্জার অ্যান্ড ডেথ। আর এ কথায় গোটা জাতি ওর পায়ে পড়ে যায় কষ্ট করার জন্য। হিটলারের দর্শন, ভয় (হরর) তবু ভাল। কেননা, তারও শেষ আছে। অন্তহীন ভয়ের চেয়ে পাকাপাকি ভয়মুক্ত হওয়ার জন্য কিছু দিনের জন্য ভয়কে সহ্য করা ভাল।

আজকের দিনের রাজনীতির সঙ্গে অরওয়েলের ব্যাখ্যার কোনও সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন? নোট-স্থগিত? সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, জিএসটি? কষ্ট করুন এক নতুন ভব্য ভারত গঠনের জন্য। কেষ্ট পাবেন।

হিটলারের গপ্পো হলে মুসোলিনিও আসবেন। সাদৃশ্য যেমন ছিল, দু’জনের মধ্যে তফাতও ছিল। হিটলার সেনা-পোশাক পরিহিত শাসক। মুসোলিনির নিখাদ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। তিনি ভোটে জেতেন। আবার হারেনও। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে ইতালিতে গিয়ে মুগ্ধ হন। পরে অবশ্য দ্য ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ানে ১৯২৬ সালের ৫ অগস্ট চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, এটা ঠিক নয় যে আমি ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করেছি। প্রবাসী-তেও বিতর্ক হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের দু-দু’বার ইতালি সফর নিয়ে। আসলে, সেখানেই তো হিটলার-মুসোলিনি দুই চরিত্রের মজা। আপনি সমর্থন করেন না। আবার বিস্ময়ের ঘোরও তৈরি হয় এঁদের ঘিরে।

এ বার স্তালিন। লেখক বার্ট্রান্ড রাসেলের একটি রচনার কথা শোনাই। ১৯৫৪ সালে রাসেল ‘নাইটমেয়ার্স অব এমিনেন্ট পারসন্‌স’ নামে একটি বই লেখেন। এই বইতে পৃথিবী বিখ্যাত কিছু ব্যক্তির কল্পিত দুঃস্বপ্ন লিপিবদ্ধ করা হয়। এই বইয়ের একটি অধ্যায় স্তালিনের দুঃস্বপ্ন। স্তালিনের মৃত্যু হয় ১৯৫৩ সালে। এই লেখাটি রাসেল লিখেছেন তাঁর মৃত্যুর এক বছর পর। মানে, স্তালিন এই লেখাটি পড়ার সুযোগ পাননি।

কল্পিত পটভূমি হল এ রকম। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। স্তালিন এ বার হেরে গেছেন। পশ্চিমে মিত্রশক্তির হাতে স্তালিন এখন বন্দি। লাল মরিচ মেশানো এক গ্লাস ভদকা গলায় ঢেলে স্তালিন তাঁর চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমোতে ঘুমোতে তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেন। তাতে দেখা যায়, এক ছোট্ট গ্রামের একটি ঘরে তিনি বন্দি। সারাক্ষণ দরজা-জানলা বন্ধ। সারা দিনে এক বার দরজা খুলে তাঁকে খোলা হাওয়ায় হাঁটিয়ে আনা হয়। পড়ার জন্য বাইবেল দেওয়া হয়। আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে স্তালিনের মনের পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা চলে।

স্তালিন রাগে ফেটে পড়ে বলেন, ভদ্রমহোদয়গণ, জীবনের আনন্দের আপনারা কতটুকু জানেন? একটা গোটা জাতিকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখার মধ্যে কী মাদকতাময় সুখের অনুভূতি আছে, সেটা কি বোঝার ক্ষমতা আছে আপনাদের? যখন বুঝতে পারছেন, সবাই আপনাকে ঘৃণা করছে, অথচ প্রকাশ্যে সে কথা বলার লেশমাত্র সাহস পাচ্ছে না কেউ, সেটার এক নিবিড় আনন্দ। শুধু শত্রু নয়, ক্ষমতা রক্ষার জন্য বন্ধুকেও বিনাশ করার প্রয়োজন। স্তালিনের এই বক্তব্য অবশ্যই কল্পিত— রচয়িতা স্বয়ং রাসেল।

এ সবই হল স্বৈরতন্ত্রের ব্যাকরণ। আজকের ‘পোস্ট ট্রুথ’ যুগে স্বৈরতন্ত্র আসছে গণতন্ত্রের হাত ধরে, বজ্রনির্ঘোষে। নিজের মহিমা কীর্তন করে হিটলার ‘ট্রায়াম্ফ অব দ্য উইল’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করান। সরকারি প্রোপাগান্ডা কী ভাবে করতে হয় তা শেখার জন্য এই ছবিটি দেখা প্রয়োজন। আর এখন তো চার দিকে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি গোয়েবল্স জন্ম নিয়েছে। একে বলা হচ্ছে ‘দ্য রাইজ অব দ্য মিস-ইনফর্মেশন ইন্ডাস্ট্রি’। গোটা পৃথিবী জুড়েই এখন ‘পোস্ট ট্রুথ’-এর জয়জয়কার।

চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ (উপরের ছবিতে এই চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য) দেখে হিটলার তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিছু দিন আগে প্রকাশিত পিটার অ্যাক্রয়েড চার্লির জীবনীতে পাওয়া গেল একটি তথ্য: নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও নিজের ঘরের মধ্যে একা একা চার্লি চ্যাপলিনের এই ছবিটি হিটলার দু’বার দেখেছিলেন।

আজ এক দিকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সমীক্ষায় নরেন্দ্র মোদী জনপ্রিয়তম নেতা। অন্য দিকে, কর্মহীন, দুঃখী প্রজন্ম। গোরক্ষপুরে শিশুমৃত্যু। মুখ্যমন্ত্রীর স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় দূরদর্শনে নিষেধাজ্ঞা জারি। এই স্ববিরোধী দৃশ্যপটের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, হিটলার-মুসোলিনি-স্তালিন এঁরা কেউ অতীত নয়। তাঁরা কোনও ব্যক্তি নন। এক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রবণতার মুখপাত্র তাঁরা। মানবজমিনে তাঁরা নব নব রূপে আসেন।

Adolf Hitler Mein Kampf অ্যাডলফ হিটলার
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy