Advertisement
E-Paper

লাইক আর প্রশংসার মোহে, আসল নকলের বোধ হারিয়ে ফেলছি অনেকেই

চোখ কান একটু খোলা রাখলেই ইন্টারনেট অ্যাবিউজের কথা আমরা নানা ভাবে দেখতে ও জানতে পাই। ইন্টারনেট এসে যেন বিভিন্ন ধরণের অপরাধমূলক কাজকারবারকে একটা অন্য আঙ্গিক প্রদান করেছে! লিখছেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:০০

অন্তর্জাল বা ইন্টারনেট ছাড়া আমাদের এখনকার জীবন আর ভাবাই যায় না! কারণ সভ্য পৃথিবীর অনেক কিছুই এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত বা লিপিবদ্ধ! সে আপনি নিজের পরিচয় লিপিই বলুন বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা পয়সার লেনদেন, ঘুরতে যাবার বুকিং-ই বলুন বা পথ চেনার জিপিএস পদ্ধতি, ফোন কল-ই বলুন বা ভিডিও কল অথবা শপিং, কোনওটাতেই এখন আর ইন্টারনেট-এর বিকল্প নেই। বাষ্প-শক্তির দ্বারা চালিত যন্ত্র উনিশ শতকের পৃথিবীতে যতটা বিপ্লব ও পরিবর্তন এনেছিল, বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংগঠিত বিপ্লব বা পরিবর্তন তার চেয়ে কোনও অংশে কম তো নয়ই, বরং অনেকাংশে বেশিই বলা যায়।

কিন্তু মানুষের ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, যে কোনও যুগান্তকারী আবিষ্কার, যা মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, তার আলোর সঙ্গে বেশ কিছুটা অন্ধকারও বহন করে নিয়ে এসেছে! যেমন ডিনামাইট, জাইক্লন বি বা ফিউশন রিঅ্যাকশান! আমরা দেখেছি, কেউ না কেউ যেন বসেই থাকে ভাল জিনিসের থেকে খারাপ জিনিস বের করার জন্য। অমৃত মন্থনে উঠে আসা গরল থেকে এ পৃথিবী রক্ষা পায় না কিছুতেই। ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি।

চোখ কান একটু খোলা রাখলেই ইন্টারনেট অ্যাবিউজের কথা আমরা নানা ভাবে দেখতে ও জানতে পাই। ইন্টারনেট এসে যেন বিভিন্ন ধরণের অপরাধমূলক কাজকারবারকে একটা অন্য আঙ্গিক প্রদান করেছে! এমন নানাবিধ ক্রাইমও যে হতে পারে, সে কথা আগে কেউ ভাবতেই পারত না! এই সব ক্রাইম ইন্টারনেটের একটা অবকেজটিভ বা বস্তুবাদী ভাবে ঋণাত্মক দিক। কিন্তু ইন্টারনেট অ্যাবিউজের আর একটা সাবজেক্টিভ বা ভাববাদী দিকও রয়েছে, যা আমরা ইন্টারনেটের নানান সোশ্যাল সাইটে প্রত্যক্ষ করতে পারি! এ এমন এক অন্ধকার দিক যা সহজে হাতে ধরা যায় না, বা যার প্রভাব তৎক্ষণাৎ বোঝা যায় না। কিন্তু গোপনে, আমাদের মনোজগতে এ এক দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি সাধন করে।

এখনকার এই হাই স্ট্রেসের যুগে কম বেশি সব মানুষকেই রোজ নানা ভাবে কঠিন পৃথিবীর মুখোমুখি হতে হয়। তার ফলে সেখান থেকে উদ্ভুত হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে চান সকলেই। ইন্টারনেটের নানান সোশ্যাল মিডিয়া তার একটা দরজা খুলে দেয়। যেখানে, দু লাইন লিখলেই বাহবা পাওয়া যায়! চারটে ছবি আপলোড করলেই লাইক আর কমেন্ট পাওয়া যায়! কোনও কিছু সম্বন্ধে মতামত দিলেই বিপক্ষ বা স্বপক্ষ যুক্তিতে বেশ আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে এসে যাওয়া যায়! আমিও যে গুরুত্বপূর্ণ। এই পৃথিবীতে আমারও যে একটা ফুট প্রিন্ট আছে। আমার কথাতেও যে লোকের যায় আসে, এমন একটা ভাব মানুষের মনে দানা বাঁধে। অর্থাৎ রোজকার ডাল ভাতের আর লাঞ্ছনার জীবন থেকে মুক্ত হয়ে এই অন্তর্জাল এমন একটা মায়া-পৃথিবীতে মানুষকে নিয়ে যায়, যেখানে সে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করে।

আর এখানেই নীরবে রোপিত হয়ে যায় সর্বনাশের বীজ! কারণ নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার মোহের একটা স্নো-বলিং এফেক্ট আছে। মানুষ অচিরেই ভুলে যায় যে, সেই সব প্রশংসা আসলে অপর পক্ষ থেকে আসা নিছক ভদ্রতা। বা, আমি ওকে লাইক দিলে ও আমার লেখায় বা আঁকায় লাইক দেবে এমন একটা অকথিত বার্টার সিস্টেম! এটা মানুষের একটা বড় ক্ষতি করে দেয়, কারণ সে তখন ঠিক-ভুল গুলিয়ে ফেলে। কাছের মানুষের সঠিক সমালোচনার চেয়ে অজানা, ইন্টারনেটে আলাপ হওয়া মানুষের প্রশংসাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সে আসলে নিজের অজান্তেই কাছের মানুষের সঙ্গে তার সামাজিক বন্ধনগুলোকে আলগা বা নষ্ট করে ফেলে। সত্যি আর মায়ার মধ্যেকার ভেদাভেদ করার শক্তি সে হারিয়ে ফেলে। রিয়্যাল আর ভার্চুয়াল পৃথিবী গুলিয়ে যায় তার। নিজের প্রশংসা শোনার এক ধরনের নেশা বা অ্যাডিকশন তৈরি হয়। নিজের বলয়ে আটকে পড়ে সে বাকিদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে।

এর থেকে একটা মেগালোম্যানিয়াও জন্ম নেয় অনেকের ক্ষেত্রে। মানুষের সঙ্গে মানুষের মুখোমুখি সংযোগ, যেটা সভ্যতাকে এতটা এগিয়ে নিয়ে এসেছে, সেটাই হারিয়ে যায়।

‘পিয়ার প্রেশার’ তৈরি হওয়ায়ও ইন্টারনেটের আর একটা ঋণাত্মক দিক। সবাই যেখানে ব্যস্ত, সে কতটা ভাল আছে প্রমাণ করার জন্য, সেখানে এমনটা যে হবে সেটাই স্বাভাবিক। অন্যের ঘুরতে যাওয়ার ছবি, রেস্টুরেন্টে খাবারের ছবি, শপিং-এর ছবি থেকে শুরু করে এই ধরনের লাইফ স্টাইলের নানান ছবি দেখে অনেকেরই মনে হয় যে, সে অন্যের তুলনায় খারাপ আছে। এতে তার ডিপ্রেশন আসে। মনখারাপ হয়। আর সেখান থেকে একটা অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতাও শুরু হয়, যা আসলে আত্মপ্ররোচনারই আর এক নাম। ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ!

এ ছাড়াও ট্রোল নামক একটি জিনিস তো রয়েইছে। ইন্টারনেটে যে হেতু সামনে গিয়ে কিছু বলার আর দরকার পড়ে না, তাই আড়াল থেকে কাউকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে সাইবার বুলিং করাটা সহজ হয়ে যায়। এতে যার ওপর এটা করা হচ্ছে সে প্রায়শই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এমনকি সাইবার বুলিং-এর জন্য আত্মহত্যার কথাও খবরে শোনা যায়।

বেঁচে থাকার মূল মন্ত্র হল শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা। সেটা লাভ করাই মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাই সব কিছুর মতো ইন্টারনেট ব্যবহারেও আমাদের একটা ভারসাম্য রাখা উচিত। কোনটা সঠিক আর কোনটা নকল, সেটার বোধ থাকা সবচেয়ে জরুরি। ইন্টারনেটে জনপ্রিয় হতে গিয়ে কাছের মানুষদের দূর করে দিলে বা নিজের আসল জীবনকে হেলাতুচ্ছ করলে বিপদ তো আসবেই। যদিও সেই বিপদ হবে নিঃশব্দ ঘাতকের মতো। কারণ ইন্টারনেটের যে মত্ততা বা তাৎক্ষণিক ঝলকানি আছে, তা অনেককেই অন্ধ করে দেয়! সেই জন্যই সবার সতর্ক হওয়া দরকার। বোঝা দরকার, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ডুব দিয়ে সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া আর ছোটবেলার ব্যবসায়ী খেলায় ধনী হওয়া কতকটা একই জিনিস! তাই, সাধু সাবধান হওয়ার সময় এসেছে।

অলঙ্করণ- সুমন চৌধুরী

Digital Revolution Internet Social Media Tech Technology
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy