Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ইটের বাড়ি মানেই কি উন্নয়ন

গ্রাম বদলে যাচ্ছে। মাটির বাড়ি ভেঙে ইটের তৈরি হচ্ছে ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’-র অধীনে।

বড় বাস্কে
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

আমার জন্ম বীরভূম জেলার একটি সাঁওতাল গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, মা প্রতি দিন সকালে গোবরের সঙ্গে কালো ছাই ও জল মিশিয়ে তা দিয়ে মাটির ঘরের উঠোন পরিষ্কার করছেন অতি যত্নে। দুর্গাপূজার আগে ধানখেতের সাদা পলি মাটি দিয়ে বাড়ির দেওয়াল পরিষ্কার করার ধুম। বড় পরব সরহায়ের সময় মহিলাদের ফুল-পাখি, জীবজন্তুর ছবি দেওয়ালে আঁকা। মা, বোনকে দেখেছি বাইরের দেওয়ালে মই লাগিয়ে উঠে লম্বা লম্বা লাইন আঁকতে, লাল মাটি, নীল রং দিয়ে। আমরা ছোটরাও অতি উৎসাহে মইয়ে চেপে কাজে সাহায্য করতাম। সে কী আনন্দ!

গ্রাম বদলে যাচ্ছে। মাটির বাড়ি ভেঙে ইটের তৈরি হচ্ছে ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’-র অধীনে। আমাদের গ্রামে একশো পরিবারের মধ্যে প্রায় ত্রিশটি পরিবার সরকারি সহায়তা (এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা) পেয়ে পনেরো ফুট চওড়া, কুড়ি ফুট লম্বা ইটের একটি ঘর ও বারান্দা তৈরি করে তাতে টিন বা অ্যাসবেস্টসের ছাদ দিচ্ছে। অনেকে নিজেদের কিছু অর্থ যোগ করে ছাদ ঢালাই করবেন ভেবে বাড়তি রোজগারের চেষ্টায় আছেন। যাঁরা এখনও অনুদান পাননি, গ্রামের রাস্তায় নির্বাচিত সদস্যের হাতে কাগজ দেখলেই তাঁরা ঘিরে ধরছেন। নাম লিস্টে উঠেছে? কোন বাড়িটা ভেঙে নতুন বাড়ি হবে, বা চাষের কোন জমিটার উপর ঘর হবে, কাকা-ভাইপোদের সঙ্গে অলিখিত বণ্টন করে রেখেছেন।

কাঁচা বাড়ি থেকে ইটের বাড়ি, মাটির রাস্তা থেকে ঢালাই রাস্তা, নিঃসন্দেহে পরিবার ও গ্রামের উন্নয়নের লক্ষণ। বর্ষায় ভাঙা ঘরে যাঁদের থাকতে হয়, তাঁদের কাছে ইটের বাড়ি পাওয়ার আনন্দ ও গুরুত্ব অসীম। ২০২২ সালের মধ্যে না কি দেশের সকল দরিদ্র পরিবারকে থাকার জন্য মার্জিত বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু যে বিষয়টা আলোচনায় আসে না তা হল, ইটের বাড়িতে বাস করার সুবিধের পাশাপাশি সাঁওতালদের পরম্পরাগত সংস্কৃতির সঙ্গে আপস, ও তার জন্য ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপ।

মাটির বাড়ি সাঁওতালদের জীবনযাত্রা থেকে নিশ্চিহ্ন হলে কেবল মাটির বাড়িই শেষ হয় না, তার সঙ্গে যুক্ত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রা শেষ হয়ে যায়। তার থেকে পাওয়া জ্ঞান ও চর্চাও চিরদিনের মতো শেষ হয়ে যায়। যেমন স্বল্প মূল্যের বাড়ি তৈরির বিদ্যা, দেওয়াল-চিত্র রচনার পারদর্শিতা চিরতরে হারিয়ে যাবে, তার সম্ভাবনা দেখা যায়। মাটির বাড়ির খোলামেলা উঠোনে হাঁস-মুরগি-ছাগল পালন, ঘরের চালের নীচে মাটির হাঁড়ির মধ্যে পায়রা পালনের মতো আয়ের উৎসও নষ্ট হয়, কারণ এক কামরা, টিনের ছাউনির বাড়িতে পশুপালন করা কঠিন।

যে সব পরিবার ছাদ ঢালাইয়ের জন্য টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করছে, তাদেরকেও অনেক মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ছাদ ঢালাই করার বাড়তি অর্থ যে কত, সে ধারণা না থাকায় সরকারি অনুদানের সমস্ত অর্থ ও দায়িত্ব রাজমিস্ত্রিদের হাতে সঁপে দেয়। টাকা ফুরিয়ে গেলে মাঝপথে মিস্ত্রিরা কাজ থামিয়ে অন্য কারও কাজ করতে চলে যান। এই রকম অর্ধনির্মিত অনেক বাড়ি গ্রামে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। বিষ্ণুবাটী গ্রামের মঙ্গল মার্ডি বাড়ি তৈরি হওয়ার আগেই মারা যান। তাঁর ছেলে নির্মল চাষের জমি বন্ধক রেখেও বাড়ির ছাদ ঢালাই করতে পারেননি, তার কারণ রাজমিস্ত্রির পরামর্শে তিনি দু’কামরা ঘরের সঙ্গে বারান্দা, রান্নাঘর ও স্নানের ঘর যুক্ত করে ঘরের ভিত তুলেছিলেন, কিন্তু খরচের পরিমাণ তিনি স্বপ্নেও অনুমান করতে পারেননি।

আমার প্রতিবেশী রাসমণি বাস্কে দু’সন্তানের মা, দিনমজুর। ঢালাই ছাদ করার আশায় চার বছর ধরে দিনমজুরি করে টাকা সংগ্রহ শুরু করেছিলেন। দু’মাস আগে বাড়ির ঢালাই শেষ হয়েছে। কিন্তু তাঁকে অনেক কিছু হারাতেও হয়েছে। রোজগারের জন্য হাইস্কুল থেকে বড় ছেলেকে পড়াশোনা ছাড়িয়ে দিনমজুরিতে নামাতে হয়েছে। তাঁর স্বামী দু’বছর আগে অপুষ্টিতে ভুগে যক্ষ্মায় মারা গিয়েছেন। এখন তিনি জানালা-দরজাহীন ইটের বাড়িতে সিমেন্টের বস্তা, পুরনো শাড়ি ঝুলিয়ে ছোট ছেলেকে নিয়ে বাস করেন। সাবেকি ছাদ হত খড়ের, টালির। এখন ছাদ হচ্ছে অ্যাসবেস্টসের। যা থেকে, বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা একমত, রোগ ছড়ায়। এমন রোগ-ছড়ানো ব্যবস্থা আনা কেন?

প্রশ্ন শুধু স্বাচ্ছন্দ্যের নয়, জীবনযাত্রার। সাঁওতালদের নিজস্ব সামূহিক জীবনধারা আছে, যা তাঁদের শত শত বছর ধরে বেঁধে রেখেছে। মাটির বাড়ি, গ্রাম ও প্রাকৃতিক পরিবেশ, সব সেই সামূহিক জীবনযাত্রার অঙ্গ। এই সব উপাদানের একটিরও পরিবর্তন ঘটলে জীবনযাত্রার ছন্দপতন ঘটে।

সময়ের দাবি মেনে পরিবর্তন আবশ্যক, সাঁওতালরা সেটা মেনেও নিয়েছেন। কিন্তু সরকার যখন তাঁদের জীবনের কোনও উপাদানের পরিবর্তন আনে, তখন তাঁদের মতামত জানানোর সুযোগ দেওয়া হয় না কেন? উন্নয়নই লক্ষ্য হলে, সরকার অর্থ দিয়ে এমন ভাবে সহায়তা করতে পারে, যাতে সাঁওতালরা নিজেদের সংস্কৃতি সুরক্ষিত রেখে, পরিবেশ-বান্ধব বাড়ি বা রাস্তা নির্মাণ করতে পারে। নিজেদের রুচি অনুসারে বাড়ি তৈরি করতে পারে। গ্রামের রাস্তা পাথর-সিমেন্টে বাঁধানোর পরিবর্তে মোরাম রাস্তাকে আরও সুন্দর ও মজবুত করে রাখা যায় কি না, সে বিষয়ে গ্রামবাসীরা মতামত দিতে পারেন। উন্নয়নের কাজে সাঁওতালদের যোগদান সুনিশ্চিত করা দরকার। তাতে পরম্পরাগত জীবনযাত্রা থেকে আধুনিক জীবনে পদার্পণটা অনেক সহজ, স্বাভাবিক ও কম যন্ত্রণাদায়ক হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Development Santali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE