প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু
অবগুণ্ঠনের ঈষৎ বাকি ছিল, এই বার শেষ প্রান্তটুকুও খুলিল। ইজ়রায়েল আইনত ইহুদি রাষ্ট্র হইল। আইনসভা ‘ক্নেসেট’-এ বৃহস্পতিবার ৬২-৫৫ ভোটে অনুমোদিত ‘বেসিক’ বা বুনিয়াদি আইনটির কারণে আপাতদৃষ্টিতে দেশ চালনার ব্যবস্থায় কোনও পরিবর্তন ঘটিবে না। সাত দশক আগে তৈয়ারি দেশটির রাষ্ট্রীয় পরিসরে ইহুদি সত্তা ও সমাজের ব্যবহারিক এবং সাংস্কৃতিক প্রাধান্য বরাবর বহাল, বস্তুত তাহা উত্তরোত্তর প্রবলতর হইয়াছে। নববিধানে সেই বাস্তবকেই স্বীকৃতি দেওয়া হইয়াছে মাত্র। কিন্তু সেই স্বীকৃতির তাৎপর্য বিস্তর। বাস্তবে যাহা চলিতেছে, সংবিধানপ্রতিম বুনিয়াদি আইনে তাহাকে মানিয়া লইলে সেই বাস্তবকেই স্বাভাবিক এবং একমাত্র সত্য বলিয়া রাষ্ট্রীয় সিলমোহর দেওয়া হয়, সুতরাং যাঁহারা এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন বা প্রচলিত ব্যবস্থা যাঁহাদের স্বার্থের পরিপন্থী, তাঁহাদের মতামতকে, এমনকি অস্তিত্বকেও অগ্রাহ্য করা হয়। ইহুদি পরিচিতির সার্বভৌমত্বকে গণতন্ত্র ও সাম্যের উপরে স্থান দিয়া, হিব্রুকে (একমাত্র) রাষ্ট্রভাষার শিরোপা এবং আরবিকে নিছক ‘বিশেষ মর্যাদা’র পিটুলিগোলা দিয়া, ইহুদি বসতিকে আরও প্রসারিত করিবার আয়োজন করিয়া প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার বুঝাইয়া দিল, উগ্র জায়নবাদী ধারাকে আরও বেগবান করিতে তাহারা বদ্ধপরিকর। এবং সফল।
৬২ বনাম ৫৫ ভোটের পরিসংখ্যান জানাইয়া দেয়, এই সাফল্যে সর্বসম্মতির জোর নাই। কেবল ইজ়রায়েলের ২১ শতাংশ আরব অধিবাসীরা নহেন, ইহুদিদেরও একটি বড় অংশ এই আধিপত্যবাদী আইনের বিপক্ষে। কিন্তু শতাংশের হিসাব নহে, সংখ্যাগুরুর আধিপত্য বিস্তারের পক্ষে জনসমর্থনের প্রবল হইতে প্রবলতর হইবার প্রবণতাটিই বড় সত্য, এবং সেই সত্য গভীর উদ্বেগের কারণ। লক্ষণীয়, এই প্রবণতা কেবল ইজ়রায়েলে নহে, দুনিয়ার বহু ভূখণ্ডেই প্রকট। গণতন্ত্র ও সাম্যের আদর্শকে অগ্রাহ্য করিয়া, বহুমাত্রিক সমাজ ও রাজনীতির উদারনীতিকে বিসর্জন দিয়া একাধিপত্যবাদী দল তথা নায়কনায়িকার বিজয় অভিযান দেশে দেশে অব্যাহত, নরেন্দ্র মোদীর ভারতও সেই অভিযানের শরিক। প্রসঙ্গত, ইজ়রায়েলের আইনসভায় নেতানিয়াহুর সাধের বিলটি পাশ হইবার কিছু ক্ষণ আগেই তিনি যে রাষ্ট্রনায়ককে স্বভূমিতে সাদর অভ্যর্থনা জানাইয়াছেন, তাঁহার নাম ভিক্তর ওরবান— হাঙ্গারির এই প্রধানমন্ত্রী উগ্রজাতীয়তার প্রতিভূ হিসাবে জগৎসভায় প্রথম সারিতে আপন স্থান অর্জন করিয়া লইয়াছেন। সমাপতন অনেক সময়েই বিশেষ অর্থবহ।
একাধিপত্যের অভিযানই কি তবে ইজ়রায়েল-প্যালেস্তাইনের নিয়তি? ‘দুই রাষ্ট্র’-এর পথে দীর্ঘ ও অসমাপ্ত যাত্রা উত্তরোত্তর জায়নবাদের কানাগলিতে ঘুরিয়া মরিবে এবং এক সময় পরিত্যক্ত হইবে? বিশ্বরাজনীতির লীলায় সাত দশক আগে স্বদেশহারা প্যালেস্তাইনিরা কোনও দিনই সূচ্যগ্র স্বভূমি খুঁজিয়া পাইবেন না? শেষ অবধি নিরঙ্কুশ ইহুদি শাসনের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়া দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবেই তাঁহাদের বাঁচিয়া থাকিতে হইবে? ইতিহাসের গতি, দেবা ন জানন্তি। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা তাহা ঠেকিয়া শিখিয়াছিলেন। বর্তমানের অন্দরে দাঁড়াইয়া ভবিষ্যৎকে জানা যায় না। বিশেষত পশ্চিম এশিয়ার মতো ভূখণ্ডের ভবিষ্যৎ, যে ভূখণ্ডের রাজনীতি অস্বাভাবিক জটিল। অধুনা জটিলতা আরও বাড়িয়াছে, তাহার চরিত্রও বদলাইয়াছে, বদলাইতেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান এবং আরব দুনিয়া— এই তিন শিবিরের পারস্পরিক টানাপড়েনের পরিপ্রেক্ষিতেই ইজ়রায়েলের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হইবে। ইতিহাসের দেবী হয়তো নূতন পথও দেখাইয়া দিবেন। তবে তাহা ভবিষ্যতের কথা। আপাতত অবগুণ্ঠন উন্মোচিত। আপাতত ইজ়রায়েল একটি ইহুদি রাষ্ট্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy