Advertisement
০৫ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

কাহার স্বার্থে

সদিচ্ছার সহিত নরকের পথের সম্পর্কটি বহু প্রাচীন। জনস্বার্থ মামলাও বিচারব্যবস্থার উপর অবহ বোঝা সৃষ্টি করিয়া চলিতেছে। তাহার মূল কারণ, এই গোত্রের মামলা দায়ের করিবার কোনও খরচ নাই— আর্থিক খরচও নহে, অন্য কোনও খরচও নহে।

শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৭ ০০:১৩
Share: Save:

নিজে ক্ষতিগ্রস্ত না হইলেও যে অপরের ক্ষতির সুবিচার চাহিয়া মামলা করা যাইতে পারে, তিন দশকের কিছু বেশি সময় পূর্বে এমন একটি ধারণা রীতিমত বৈপ্লবিক ছিল। সুপ্রিম কোর্টে সেই বিপ্লবের দুই কান্ডারি ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র নটবরলাল ভগবতী এবং ভি আর কৃষ্ণ আয়ার। পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন বা পিআইএল, অর্থাৎ জনস্বার্থ মামলার ভগীরথ এই দুই বিচারপতি। সম্প্রতি বিচারপতি ভগবতীর জীবনাবসান হইল। তাঁহাদের খুলিয়া দেওয়া পথে জনস্বার্থ মামলা অবশ্য ভারতীয় বিচারব্যবস্থার নাভিশ্বাস তুলিতেছে। যে সব জনস্বার্থ মামলা এজলাসে উঠে, তাহাদের কত শতাংশ প্রাসঙ্গিক বা গুরুত্বপূর্ণ, তাহা লইয়া প্রশ্ন উঠিতে পারে। এই প্রশ্নের দায়টি ভগবতী বা কৃষ্ণ আয়ারের উপর চাপাইয়া দিলে অন্যায় হইবে। জনস্বার্থ মামলার দর্শনটি গণতন্ত্রের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। কেহ আনুষ্ঠানিক ভাবে বিচার চাহিতেছেন কি না, সেই বিবেচনা তাঁহার ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথে বাধা হইয়া দাঁড়াইতে পারে না— এই কথাটি ন্যায্যতার প্রেক্ষিতে অনস্বীকার্য। বিচার চাহিতে না পারিবার বহুতর কারণ থাকিতে পারে— অর্থের অভাব, জ্ঞানের অভাব, সাহসের অভাবও বটে। প্রশাসনিক অসহযোগিতা বা ঔদাসীন্যের সহিত কী উপায়ে লড়িতে হয়, তাহা অনেকেরই অজানা। ন্যায্যতার দর্শন বলিবে, দেশের প্রতিটি নাগরিকের যেন ন্যায়বিচার প্রাপ্য হয়, তাহা নিশ্চিত করা বিচারবিভাগের প্রধানতম কাজ। সেই প্রেক্ষিতে জনস্বার্থ মামলার গুরুত্ব অপরিসীম।

কিন্তু, সদিচ্ছার সহিত নরকের পথের সম্পর্কটি বহু প্রাচীন। জনস্বার্থ মামলাও বিচারব্যবস্থার উপর অবহ বোঝা সৃষ্টি করিয়া চলিতেছে। তাহার মূল কারণ, এই গোত্রের মামলা দায়ের করিবার কোনও খরচ নাই— আর্থিক খরচও নহে, অন্য কোনও খরচও নহে। বুলবুলিতে ধান খাইয়া গেলেও, অতএব, মামলা হয়। জনস্বার্থ মামলার স্বার্থেই এই প্রবণতাটি বন্ধ করা প্রয়োজন। তাহার একাধিক পথ আছে। প্রথমত, কোন মামলাটি সত্যই জনস্বার্থে, আর কোনটির পিছনে ভিন্নতর কারণ আছে, সেই বিচারে কঠোর হইতে হইবে। নিয়ম করা যাইতে পারে, জনস্বার্থ মামলা করিতে হইলে আদালতের নিকট একটি মোটা অঙ্কের টাকা গচ্ছিত রাখিতে হইবে। আদালত যদি মামলাটিকে গ্রহণযোগ্য বলিয়া বিবেচনা না করে, তবে সেই টাকা আর ফেরত পাওয়া যাইবে না। মামলায় হারিলেও এই গচ্ছিত অর্থ হইতেই বিবাদী পক্ষের মামলার খরচ এবং আদালতের ব্যয় মিটাইতে হইবে। অবান্তর মামলা দায়ের করিবার প্রবণতার ক্ষেত্রে ইহা নেতিবাচক প্রণোদনা হইতে পারে।

একটি বিকল্প রীতি অনুসরণও সম্ভবপর। সমবেত ভাবে মামলা দায়ের করিবার রীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাহা ‘ক্লাস অ্যাকশন স্যুট’ নামে পরিচিত। কোনও ঘটনায় যে ব্যক্তির নিজস্ব স্বার্থ জড়িত নহে, নিছক পরার্থপরতা বা অন্য কোনও তাগিদ হইতে সেই ঘটনায় মামলা ঠুকিবার অনুমতি এই ব্যবস্থায় নাই। ‘ক্লাস অ্যাকশন স্যুট’ হইল সংগঠিত আবেদন— ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা সমবেত ভাবে এই গোত্রের মামলা দায়ের করেন। এই পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী তিনি বা তাঁহারাই হইতে পারেন, যিনি বা যাঁহারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত, অথবা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত বলিয়া মনে করেন, অন্যের হইয়া ন্যায়বিচার দাবি করিবার মধ্যে নিশ্চয়ই মহান নৈতিকতার অবস্থান রহিয়াছে, কিন্তু সেই নৈতিকতা সমাজের পরিসরেই সীমিত থাকা শ্রেয়, তাহার দায় আদালতের উপর চাপাইলে বিচারব্যবস্থার ক্ষতি সাধিত হইতে পারে। আদালত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করুক, তাহাতে সকল নাগরিকের সমানাধিকারও নিশ্চিত হউক, কিন্তু জনস্বার্থ মামলার অপব্যবহার বন্ধ হওয়া কাম্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE