সাগর থেকে ভেসে এসেছিল ডাক, বললে ভুল হবে না। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর হিন্দ্ স্বরাজ-কে বলা যেতেই পারে ‘সারমনস অব দি ওশান’। ১৯০৯ সালে লন্ডন থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা ফিরছিলেন তিনি, জাহাজে বসে দশ দিনের মধ্যে লেখা হয়ে গেল সেই বই, ঝড়ের বেগে, একটানা। ডান হাত ব্যথা হয়ে গেল বলে বাঁ হাতে লিখতে শুরু করলেন, তবু থামলেন না। অসাধারণ বইটি যে এমন ভাবে লেখা হয়েছিল, ভাবতে গেলে মনে হয়, তাঁর মনের মধ্যে তখন চলছিল একটা প্রস্তুতি-পর্ব। ভারতে আসবেন, আন্দোলন তৈরি করবেন, ইতিমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় যে অহিংসা আর সত্যাগ্রহ তৈরি হয়েছে, তার একটা বড় মাপের পরীক্ষানিরীক্ষা করবেন— এত সবের প্রস্তুতি।
দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় গোষ্ঠী আর ব্রিটিশ-শাসিত ভারত তো ঠিক তুলনীয় নয়। আকারে প্রকারে বিস্তারে বৈচিত্রে ভেদাভেদে ভারত নামক সম্পূর্ণ এক়টা নতুন মঞ্চে অবতীর্ণ হতে চলেছেন তিনি, সেই তীক্ষ্ণ সচেতনতা থেকেই শুরু হয়েছিল হিন্দ্ স্বরাজ লেখা। একটা সমাজকে আন্দোলনের জন্য তৈরি করতে আসছেন তিনি, যে সমাজ নিজের ভেতরেই নিজের হাজারটা শত্রু-শিবির বানিয়ে রেখেছে। ১৯০৯ সাল— তত দিনে ক্ষয়ে গিয়েছে স্বদেশি আন্দোলন, দুই টুকরো হয়েছেন কংগ্রেসের নেতারা, তৈরি হয়েছে মুসলিম লিগ, এমনকি মুসলিমদের একাংশের আলাদা দাবি মানার প্রথম ধাপ হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছে ব্রিটিশ রাজের মর্লে-মিন্টো সংস্কার। এই সবেরই প্রেক্ষাপটে গাঁধী তৈরি করলেন তাঁর ভারত রাজনীতি দর্শন। দক্ষিণ আফ্রিকার গাঁধী আর ভারতের গাঁধীর মধ্যে যেন যোগসূত্র এই বই। গাঁধী যা ছিলেন আর গাঁধী যা হলেন, তার রসায়ন বোঝার সূত্র।
হিন্দ্ স্বরাজ বিষয়ে গাঁধী বলতেন, ওখানে যে পথের কথা বলা আছে, সেটাই একমাত্র পথ বলে তাঁর বিশ্বাস— ‘‘দি ওনলি ট্রু ওয়ে টু স্বরাজ’’। পথের প্রথম নিশানাই হল পশ্চিমি আধুনিকতার গভীর বিরোধিতা। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার এমন বিরোধী ছিলেন তিনি, যে সেটাকে ‘সভ্যতা’ বলে মানতেই নারাজ ছিল তাঁর মন, কেননা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তিনি দেখতেন অন্যায় আর হিংসা। আধুনিক যুক্তি, প্রযুক্তি আর প্রগতি দিয়ে মানুষ কেবল প্রকৃতিকে ‘বশ’ করে যেতে শিখেছে, যার মধ্যে আসলে হিংসাত্মক প্রবৃত্তির প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নেই। আধুনিকতার ওই নখদন্ত তিনি পশ্চিমের মধ্যে আপাদমস্তক দেখতে পান, আর তার উল্টো দিকে ভারতের গ্রামীণ সভ্যতার দিকে তাকিয়ে খুঁজে পান সেই ভয়ঙ্কর হিংসার একটা সম্ভাব্য প্রতিষেধক। সেখানে তিনি দেখতে পান, প্রতি দিনের জীবনের পারস্পরিকতা ও সহাবস্থানের সম্মান ও সম্ভাবনা। অর্থাৎ, হিন্দ্ স্বরাজ-এর গাঁধীর কাছে ভারত তার ভূগোল দিয়ে বাঁধা নয়— বরং, একটা ইতিহাস— আরও স্পষ্ট করে বললে, একটা সামাজিক ইতিহাস দিয়ে বাঁধা। অর্থাৎ, তাঁর সনাতন ভারত-এর আদর্শে প্রধানত দু’টি নৈতিক কম্পাস, এক, হিংসা-বিরোধিতা, দুই, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যে আধুনিকতা, তার বিরোধিতা। ইতিহাসবিদ ফয়জ়ল দেবজি (দি ইমপসিবল ইন্ডিয়ান) বলছেন, হিন্দ্ স্বরাজ-এর ভারত হল অধিবিদ্যাগত বা মেটাফিজ়িক্যাল ভারত।