Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Kazi Nazrul Islam

ছোটদের জন্যও সমান ভাবে লিখেছিলেন

সম্প্রতি ছিল তাঁর জন্মদিন। আমরা তাঁকে বিদ্রোহী কবি হিসেবে মান্যতা দিই, কিন্তু বাংলা শিশুসাহিত্যেও কাজী নজরুল ইসলামের অবদান কম নয়। ছোটদের মনের কথা বুঝতে পারতেন তিনি। শিশুদের সঙ্গে মিশে যেতেন। লিখলেন ঈষিকা বন্দ্যোপাধ্যায়মাত্র আট বছর বয়সে নজরুলের বাবা মারা যান। ছন্নছাড়া হয়ে যায় তাঁর শৈশব।

কাজী নজরুল ইসলাম। ফাইল চিত্র

কাজী নজরুল ইসলাম। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২০ ০০:০২
Share: Save:

ভোর হলো দোর খোল/ খুকুমণি ওঠ রে/ ওই ডাকে জুঁই শাখে/ ফুলখুকি ছোট রে...কবিতার মধ্যে দিয়েই কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ছোটদের আলাপ হয়। সব ছোট ছেলেমেয়ারাই হয়তো মায়ের কাছে এই কবিতা শুনে থাকবে। বাংলায় তথা আমাদের দেশে তাঁকে বিদ্রোহী কবি হিসাবে দেখা হলেও ছোটদের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের বেশ বন্ধুত্ব ছিল। ১৮৯৯ সালের ২৫ মে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। অভাবের সংসারে নানা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে জন্ম নেওয়া ছেলেটির নাম রাখা হয় দুখু মিঞা। পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জায়েদা খাতুন।

মাত্র আট বছর বয়সে নজরুলের বাবা মারা যান। ছন্নছাড়া হয়ে যায় তাঁর শৈশব। ছোট থেকেই কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল তাঁকে। কখনও লেটো দলে গান গেয়েছেন, কখনও মসজিদে কাজ করেছেন। ছোট থেকেই তাঁর জীবনে নেমে এসেছিল দুঃখ-দুর্দশা। তবু তিনি হেরে যাননি। সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে নিয়েছিলেন। জীবন যুদ্ধে অপরাহত থেকেছেন তিনি। ছোটদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে তাঁর হারানো শৈশবকে খুঁজে পেতেন নজরুল। শিশুদের মাঝে মিশে যেতেন। নিজেকে আবিষ্কার করতেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘‘আমি চির শিশু, চির কিশোর।’’ সেজন্যই তিনি সহজ ভাষায় শিশুদের জন্য যে কোনও সময় লিখতে পারতেন মজার মজার ছড়া-কবিতা-গান।

শিশুদের মনের কথা বুঝতে পেরেই তিনি লিখেছিলেন, ‘‘আমি হব সকাল বেলার পাখি/সবার আগে কুসুম-বাগে/উঠব আমি ডাকি!/সুয্যি মামা জাগার আগে/উঠব আমি জেগে,/হয়নি সকাল, ঘুমো এখন,/মা বলবেন রেগে।…তাঁর এই কবিতাটি শোনেনি এমন লোক খুব কমই আছে।

নজরুল শিশু মনের নির্মল অনুভূতিগুলো উপলব্ধি করতেন। নজরুলের ছোটদের লেখাগুলো শুধু ভাবনা থেকে নয়। তিনি ছোটদের নিয়ে যে সব রচনা করেছেন সব কিছুর মধ্যে এক একটা গল্প রয়েছে।

কাঠবিড়ালী, কাঠবিড়ালী

পেয়ারা তুমি খাও?

গুড় মুড়ি খাও, দুধ ভাত খাও?

বাতাবি লেবু, লাউ?

বেড়াল বাচ্চা কুকুর ছানা তাও?

নজরুলের খুকি ও কাঠবিড়ালী শীর্ষক এই কবিতার পেছনে রয়েছে এক মজার গল্প। নজরুল বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। তিনি যেখানেই যেতেন শিশুদের সঙ্গে তাঁর বন্ধু গড়ে উঠতো। ১৯২১ সালে তিনি কুমিল্লায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। তিনি উঠেছিলেন ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে। অঞ্জলি নামের ইন্দ্রবাবুর একটি মেয়ে ছিল। নজরুলের বন্ধুদের তালিকায় এই মেয়েটিও ঢুকে গেল। নজরুল একদিন দেখলেন এই মেয়েটি একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে উপরে তাকিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। নজরুল কাছে গিয়ে দেখলেন মেয়েটি একটি কাঠবিড়ালীর সঙ্গে কথা বলছে। তিনি অবুঝ মেয়েটির সারল্য দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন। তিনি লিখলেন, খুকি ও কাঠবিড়ালী কবিতাটি।

নজরুলের ছোটদের কবিতাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পিলেপটকা, খাদু দাদু, লিচু চোর, মটকুল মাইতি, খুকি ও কাঠবিড়ালী প্রভৃতি। ছোটদের আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হোক বা আবৃত্তির আসর নজরুলের লেখা লিচু চোর খুবই জনপ্রিয়।

বাবুদের তাল পুকুরে

হাবুদের ডাল কুকুরে

সেকি ব্যস করলো তাড়া

বলি থাম একটু দাঁড়া।

এই কবিতার সঙ্গে নাট্যরূপ শিশুদের মন কাড়ে। সব শিশুদের কাছেই লিচু চুরির গল্প বেশ মনোরঞ্জনের। নজরুলের ছোটদের রচনার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। তিনি মধ্যে অমিত সম্ভাবনার শক্তি দেখতে পেতেন। তিনি মনে করতেন এঁরাই ভারতের ভবিষ্যত। ছোটদের তিনি দুর্বল ভাবতেন না। তিনি ছোট থেকেই শিশুমনে গভীর ভাব সঞ্চার করার চেষ্টা করতেন। ছোটদের জ্বলে ওঠবার প্রেরণা জোগাতেন। নজরুল ছোটদের সম্ভাবনাকে সকলের নজরে আনার জন্যই লিখেছিলেন—

তুমি নও শিশু দুর্বল,

তুমি মহৎ মহীয়ান

জাগো দুর্বার, বিপুল বিরাট

অমৃতের সন্তান।

যে কোনও ছোটদের স্কুলের অনুষ্ঠানেই শোনা যায়,

প্রজাপতি প্রজাপতি

কোথায় পেলে ভাই

এমন রঙিন পাখা!

টুকটুকে লাল নীল

ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা।…

এটাও নজরুলের কলম থেকেই বেড়িয়েছে। ছোটদের মনের গভীরে পৌঁছে যেতেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলাম শিশুদের প্রতি অন্তরের ভালোবাসা দিয়ে শিশুসাহিত্যকে করে তুলেছিলেন আবেগময় ও হৃদয়স্পর্শী। ছোটদের জন্য রচিত তাঁর প্রতিটি কবিতায় ফুটে উঠেছে শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। শিশুদের মাঝে নজরুল অপার সম্ভাবনা দেখতে পেতেন। ছোটদেরকে দেখলে নজরুল ছুটে যেতেন, অবিচ্ছেদ্য মমতার সম্পর্কে বেঁধে ফেলতেন। শিশুদের প্রতি তিনি ছিলেন সহমর্মী ও সংবেদনশীল।

কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বিদ্রোহী কবির অভিধা নিয়ে বিপ্লবের কবিতা লিখেছেন, শেকল ভাঙার গান গেয়েছেন, তেমনি তাঁর লেখনিতে উঠে এসেছে শিশু মনের নানা ভাবনা। নজরুল তাঁর ছন্দের যাদু দিয়ে ছোটদের মনে নানা ভাব জাগিয়ে তুলতেন। তাঁদের সম্ভাবনা উস্কে দিতেন। ছোটদের আগামীর স্বপ্ন দেখাতেন।

কবি কখনও বদ্ধ ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে চাননি। কবি সব সময় ঘুরে বেড়াতে চেয়েছেন। কবির মন পাখিটা বড়ই চঞ্চল। ফুরুৎ ফুরুৎ করে ডানা মেলে উড়তে চায় আকাশে বাতাসে। কবি পাখির ডানায় ভর করে উড়ে বেড়াতে চায় দেশ হতে দেশান্তরে। সুন্দর এই পৃথিবীর সব কিছু দেখতে চায় দু’চোখ ভরে। তাই কবি লিখেছেন—‘‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে/ দেখব এবার জগৎটাকে/ কেমন করে ঘুরছে মানুষ/ ঘুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।’’

তাঁর ‘সংকল্প’ কবিতায় নজরুল কিশোরমনের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন এভাবে। সত্যিই কিশোরমন ঘরে থাকতে চায় না। অজানাকে জানার আর অদেখাকে দেখার জন্য ঘুরে বেড়াতে চায়। তাই তো আজও স্কুল-কোচিং ফাঁকি দিয়ে ছেলেরা মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kazi Nazrul Islam Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE