নরেন্দ্র মোদী ভাষণ দিতে ভালবাসেন। সেই ভাষণে সারবত্তা কম হইলেও নাটকীয়তা প্রচুর।
শব্দ ব্রহ্ম। ক্ষেত্রবিশেষে শব্দ বুঝি-বা ব্রহ্মদৈত্যও! নরেন্দ্র মোদী হয়তো এই বার তাহা টের পাইয়াছেন। সম্প্রতি চিন-ভারত সংঘর্ষের পরে আহূত সর্বদলীয় বৈঠকে মোদীজি ঘোষণা করিয়া বসেন, (চিন-সীমান্ত পার হইয়া) ‘আমাদের সীমায় কেহ ঢুকিয়া আসে নাই, কেহ ঢুকিয়া বসিয়াও নাই, আমাদের কোনও পোস্ট অন্য কেহ কব্জাও করে নাই।’ এমন ঘোষণার পরে স্বভাবতই দিকে দিকে সেই প্রশ্ন রটি গেল ক্রমে: তবে সীমান্তে এমন রক্তক্ষয়ী লড়াই হইল কেন, সেনাবাহিনী এবং বিদেশ মন্ত্রকই বা কেন চিনা সেনার অনুপ্রবেশের কথা বলিল, আর কী ভাবে যে যাহার আপন জায়গায় ফিরিয়া যাইবে তাহা লইয়া দিনের পর দিন দুই তরফের নিরাপত্তা বাহিনীর এত বৈঠকই বা কিসের? অতঃপর রাষ্ট্রযন্ত্র অচিরেই প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের ‘যথাযথ ব্যাখ্যা’ সরবরাহ করিতে তৎপর হইয়াছে। টীকাভাষ্য রচনা ও সম্প্রচার চলিতেছে। কিন্তু সংশয় ঘুচে নাই। বিরোধীরা, বিশেষত কংগ্রেস, প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলিতেছে। মনমোহন সিংহ বলিয়াছেন, প্রধানমন্ত্রীর আপন কথার গুরুত্ব মাপিয়া মুখ খোলা বিধেয়, তাহা না হইলে তাঁহার মন্তব্যকে কাজে লাগাইয়া প্রতিপক্ষ কূটনীতির লড়াইয়ে সুবিধা আদায় করিতে পারে। বস্তুত, ইতিমধ্যেই চিনের প্রচারযন্ত্রীরা মোদীর মন্তব্যকে কাজে লাগাইয়া বলিতে শুরু করিয়াছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীই তো বলিতেছেন চিন সীমান্ত লঙ্ঘন করে নাই!
নরেন্দ্র মোদী ভাষণ দিতে ভালবাসেন। সেই ভাষণে সারবত্তা কম হইলেও নাটকীয়তা প্রচুর। এই ব্যাপারে পূর্বসূরির সহিত তাঁহার পার্থক্য দুই মেরুর দূরত্বের কাছাকাছি। মনমোহন সিংহ স্বভাবত মিতভাষী। ইউপিএ জমানায় প্রধানমন্ত্রী তাঁহার নীরবতা লইয়া বিরোধী বিজেপির ব্যঙ্গবিদ্রুপের অন্ত ছিল না। তাঁহাকে মৌনমোহন নামও দেওয়া হইয়াছিল। বিরোধী আসনে বসিয়াও মনমোহন আপন বাক্সংযমে সুস্থিত থাকিয়াছেন। তিনি কথা কম বলেন, যখন বলেন, তাহার ওজন মাপিয়াই বলেন। যাঁহারা ‘মুখেন মারিতং জগৎ’ মন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁহারা এই সংযমের মর্ম বুঝিবেন না, হয়তো-বা বুঝিতে চাহিবেনও না। তাঁহারা এমন তর্কও তুলিতে পারেন যে, যিনি কথা বলিতে পারেন, যাঁহার বক্তৃতা মানুষ শুনিতে ভালবাসে, তিনি কেন স্বল্পবাক হইবেন? সত্য বটে, সকল নেতা সমান বাগ্মী হন না। ইহাও সত্য যে, বাগ্মিতায় মনমোহন সিংহ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীদের তালিকায় সামনের সারিতে থাকিবেন না। অন্য দিকে, নরেন্দ্র মোদী জনারণ্যে বাগ্মী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন। সুতরাং ছুটিলে কথা, থামায় কে?
তবে কিনা, বাগ্মী প্রধানমন্ত্রী বা জননেতা যে এই প্রথম ভারতের ভাগ্যাকাশে উদিত হইয়াছেন, এমন তো নহে! অন্যে পরে কা কথা, মোদীভক্তরাও নিশ্চয় অটলবিহারী বাজপেয়ীর বাক্পটুতা অস্বীকার করিবেন না। তিনি প্রচুর কথা বলিতেন, কিন্তু বেফাঁস কথা বিশেষ বলিতেন না। হয়তো নিজেকে অতিমানব প্রমাণ করিবার দায় নিজের কাঁধে তুলিয়া লন নাই বলিয়াই প্রধানমন্ত্রিত্বও তাঁহার স্বাভাবিক বাকশৈলী হরণ করিতে পারে নাই। আবার অনেক কথা উহ্য রাখিয়া কী ভাবে ব্যক্তিত্ব ধরিয়া রাখিতে হয়, তাহার নমুনাও ভারতবাসী দেখিয়াছে, যেমন, জ্যোতি বসু। মাঝেমধ্যে ‘এ রকম তো কতই হয়’ গোছের কুবাক্য তাঁহাকেও বিপাকে ফেলিয়াছে, কিন্তু ‘গাড়িতে কুকুরছানা চাপা পড়িলেও দুঃখ হয়’ বা ‘ক্ষমতায় আসিলে বিদেশে পাচার করা কালো টাকা উদ্ধার করিয়া প্রত্যেকের হাতে পনেরো লক্ষ টাকা তুলিয়া দিব’ ইত্যাদি মণিমুক্তা বিতরণের প্রতিভা সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের। নিজের রেকর্ড নিজে ভাঙিতে পারাও বিশেষ প্রতিভার চিহ্ন। তাই নিজের পুরাতন রেকর্ডকে ম্লান করিয়া দিয়া চিন-ভারত দ্বন্দ্বের মতো গুরুতর প্রশ্নে এমন একখানি বাক্য উচ্চারণ অতুল কীর্তি হিসাবেই পরিগণিত হউক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy