নয়ের দশকের শেষে পাড়ার এক দেওয়ালে দেখেছিলাম এক নেতাকে জাতীয় পশুর সঙ্গে তুলনা করে লেখা হয়েছে ‘... বসু/ জাতীয় পশু’। আবার ওই দেওয়ালেই কয়েক বছর পর দেখেছিলাম ‘আয়... দেখে যা/... এর ক্ষমতা ’।
তখন আমি খুবই ছোট। দেওয়ালে এই পরস্পর-বিরোধ না জেনেই সে দিন প্রশ্ন করেছিলাম পাড়ার এক ঝান্ডাধারী কাকুকে। উত্তর দেননি, রেগেছিলেন খুব। ‘এঁচোড়ে পাকা’ আমি সে দিন থেকেই। এত দিনে সেই ‘পাকা’ ভাব আরও বেড়েছে। আজ জানি না, কাকুর ছেলেরা কী বলবে। আমি শঙ্কিত। তবুও লিখছি। লিখতে হচ্ছে ওঁদের নাতিদের কথা ভেবেই।
কারণ, এখন দেওয়ালের সেই ভাষার প্রতাপ আরও বেড়েছে।
সেই তীব্রতায় পুড়ছি আমরা, পুড়ছে আমাদের ভবিষ্যৎও। অথচ আমরা কেমন যেন নির্বিকার! অনেকেই অসহায়। দেওয়ালের কদর্য চেহারা দেখেই বড় হয়েছি। তখন থেকেই মনে-মনে ভাবতাম, রাজনীতি মানেই বোধ হয় এ রকম কিছু শব্দের খোঁচায় কিছু মানুষকে উগ্র করে দেওয়া। কিছু মানুষকে দেখতাম, এই উগ্রতাকে বেশ গ্রহণ করছেন, উপভোগ করছেন, আকৃষ্ট হচ্ছেন। না হলে মানুষ ভোট দেবে কেন?
তখন থেকেই উপলব্ধি করলাম, যে দল যত বেশি মানুষকে উত্তপ্ত করবে, ভিতরে-ভিতরে একটা বাংলা চলচ্চিত্রের পরিচিত সংলাপের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়বে আমাদের অবুঝ মননে, সেই দলই এগিয়ে থাকবে। মনে হয়, সস্তা জনপ্রিয়তার রাজনীতির এই দৈন্য নামক রোগটা তখন থেকেই শুরু। অনেকটা ক্যানসারের মতো।
আবার এই আমিই তো এক দিন প্রেসিডেন্সিতে গিয়ে দেখলাম, দেওয়ালে দেওয়ালে ছাত্র রাজনীতি ঝুলিয়ে রাখা। কত সচেতন তার লেখা। পাঠে যেন কবিতার স্বাদ! ভাবলাম, এ রকম হতে পারে না আমাদের গ্রাম-শহরের পরিচিত রাজনীতির ভাষা?
অবশ্যই রাজনৈতিক নেতারা কবিতার ভাষায় কথা বলবেন না। কিন্তু বর্তমানে যে দেওয়ালের কদর্য চেহারাটি পাল্টে গিয়েছে তা সকলেই জানেন। এখন আর দেওয়ালের দিকে তাকানোর দরকার নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মুখের যে ভাষা আমরা শুনছি এবং দেখছি তা দেওয়ালের কদর্যতাকেও হার মানায়। রাজ্যে পালাবদলের আগে থেকেই চলছে এই ধরনের নোংরামি। কটুভাষা অবশ্য শুনি তারও আগে ব্যবহৃত হয়েছে। পালাবদলের আগে থেকেই দেখছি, তৎকালীন শাসকেরা কী ভাবে কটুবাক্য ব্যবহার করেছেন। তখনকার বিরোধী দলের নেতারাও বাদ যাননি।
তখন থেকেই স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল, কী ভাবে নীচে নেমে যাচ্ছি আমরা। কী ভাবে ভাষার কদর্যতায় এগিয়ে যাচ্ছি আর আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অজান্তেই শেখাচ্ছি সে সব। যখন টিভিতে বাচ্চাদের সামনে এই ভাষা ভেসে ওঠে তখন কী অসহায় লাগে! এ কথা যিনি ঠেকেছেন, তিনিই জানেন। ভাষা ব্যবহারের ক্রমাগত এই অবনয়ন দেখে শুধু ভাষাবিদেরাই যে শঙ্কিত, তা নয়। প্রতিটি অভিভাবক এ বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এখন আলোচনার বিষয়, কী ভাবে এই সব নোংরা ভাষার ছোঁয়াচ থেকে ছেলেমেয়েদের বাঁচাবেন।
কয়েক দিন আগেই দেখছিলাম, এক জন নেতা সিনেমার অভিনেতার মতো বলছেন, ‘মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে’। এর পাল্টা চলছে আরও মারাত্মক। কেউ বলছেন ‘পাঁচনের বাড়ি দেব’, ‘গুড়জল খাইয়ে দেব’। আবার কেউ আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলছেন, ‘মেরে ঠ্যাং ভেঙে দেব’। এ রকম অজস্র উদাহরণ। প্রকাশ্য জনসভায়, রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে বলে যাচ্ছেন নেতা-মন্ত্রী থেকে বিরোধী দলও।
আসলে এগুলো সবই রাজনৈতিক নেতাদের দৈন্য। রাজনীতির বিষয় এখন আর তুলে আনতে পারছেন না বেশ কিছু নেতা। আসলে তাঁরা নেতা হওয়ার যোগ্যই নন। পড়াশোনার কথা বাদই দিলাম, তাঁদের বোধ এবং কথা বলার ভঙ্গিমাও নিম্ন মানের।
তবে প্রতিটি দলেই তো এখনও কিছু ভাল মানুষ আছেন। আমি মনে করি, সব দলেই কিছু না কিছু রুচিশীল বক্তাও আছেন, যাঁরা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বক্তৃতা করতে পারেন। তাঁরা কেন এ ভাবে চুপ থেকে এগুলোকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন? তা হলে কি তাঁদেরও এক প্রকার দীনতা গ্রাস করেছে? আমরা এখন দেখছি, ঐতিহ্যময় সংসদ ভবনে চলছে কী রকম ক্লাবস্তরীয় কার্যকলাপ। কেউ চোখ টিপছেন তো কেউ বুক ঠুকছেন! অদ্ভুত! এ সবই দেখছে আমাদের আগামীর শিশুরা! তাদের কী বার্তা দিচ্ছি আমরা?
সবাই ভাবছি, ‘আসলে ক্ষতি তো আমার হচ্ছে না’। এই ‘আমার’-সর্বস্ব চিন্তা এ বার তুলে রাখার সময় হয়েছে। যে ভাবে রাজনীতি থেকে সৎ মানুষ সরে গিয়েছেন অভিমানে এবং ভয়ে; সব ভুলে আবার ফিরে আসুন। আমাদের ভবিষ্যৎকে বাঁচাতে। নইলে কোনও দিন হয়তো শুনতে হবে আপনাকেই আপনার বাড়ির কেউ ওই সব নেতাদের ভাষা নকল করে বলছে, ‘মেরে ঠ্যাং ভেঙে দেব’! অথবা দেখবেন, আপনার-আমার সন্তানেরা লাঠি নিয়ে যাচ্ছে কলেজে। শিখেছে যা, শেখাবে আরও মারাত্মক বেশি!
সীতানগর বিদ্যালয়ের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy