অসহায়: তিন কন্যাকে নিয়ে মৃত পল্টু শবরের স্ত্রী ময়না। নিজস্ব চিত্র
সেটা ছিল ২০০৪ সাল। আর এটা ২০১৮। মাঝে চোদ্দটা বছর। আর সেই চোদ্দটা বছরের এ ধার থেকে ও ধার পর্যন্ত ছড়িয়ে অন্তত চোদ্দটা অনাহারক্লিষ্ট, অপুষ্টিপীড়িত, রুগ্ন মানুষের শব।
২০০৪ সালে সনাতন মুড়া, সময় শবর, মঙ্গলী শবর, নাথু শবর, শম্ভু শবর, কোকিলা শবর। ২০০৫ সালে পার্বতী শবর। ২০১৮ সালে মঙ্গল শবর, কিসান শবর, লেবু শবর, সুধীর শবর, সাবিত্রী শবর, পল্টু শবর, লাল্টু শবর।
না, এতটা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। আসলে সংবাদমাধ্যমের নজরে এসেছে এই চোদ্দটা শব। আরও অনেক শব নজর এড়িয়েই পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গিয়েছে কি না, জানা যায় না। নিশ্চিতও হওয়া যায় না। কিন্তু সেই ২০০৪ সালে আমলাশোলের সনাতন মুড়ার মৃত্যু গোটা ভারতকে কাঁপিয়ে দিলেও বাংলার প্রশাসন অনাহারের তত্ত্ব কিছুতেই স্বীকার করতে চায়নি। আজ জঙ্গলখাসে ১৫ দিনের মধ্যে ৭ শবরের মৃত্যুর পরেও একই মেজাজ প্রশাসনের। ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক আয়েশা রানি জানিয়ে দিলেন, অপুষ্টির কারণে মৃত্যু নয়, এই মৃত্যুগুলোর জন্য দায়ী শবরদের জীবনযাত্রা।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
বলিহারি প্রশাসন! বলিহারি! একটা জনবিরল অরণ্যভূমির একটা ক্ষুদ্র গ্রামে মাত্র ১৫ দিনে ৭ জনের মৃত্যু হল। অনাহার, অপুষ্টির অভিযোগ উঠল। জেলাশাসক সপাটে অস্বীকার করলেন। যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁরা যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন,তাঁদের যকৃতের সমস্যা ছিল, তাঁরা চিকিৎসা করাতেন না, তাঁরা মদ্যপান করতেন— মৃত্যুর কারণ এই সবই, মৃত্যুর কারণ অপুষ্টি নয়। দাবি জেলাশাসকের। প্রশাসন কতখানি ‘সংবেদনশীল’, স্পষ্ট প্রশাসকের বক্তব্যেই।
আরও পড়ুন: কতটা ফাঁপা উন্নয়ন, বোঝা যাচ্ছে মৃত শবরদের গ্রামে পা রাখলেই
একবিংশ শতাব্দীর ভারত। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে গর্ব করা ভারত। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলোর অন্যতম হিসেবে সদর্প ভারত। সেই ভারতেরই এক অঙ্গরাজ্যে গণ-অনাহার, গণ-অপুষ্টির ছায়া! গণ-মৃত্যুর মতো পরিস্থিতি! অভিযোগটা ওঠা মাত্র লজ্জায় সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ার কথা প্রশাসনের, মাথা হেঁট হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই যেন কারও। ৭ শবরের মৃত্যুর খবর নিয়ে সংবাদমাধ্যমে হইচই শুরু হতেই প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসল, বিভিন্ন স্তরের কর্তারা গাত্রত্থান করলেন, ঘরে-ঘরে পৌঁছে সমস্যা জানার একটা লোক দেখানো চেষ্টাও হয়তো হল। কিন্তু কেউই যেন তেমন বিচলিত নন, সবটাই যেন রাজনৈতিক ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এর একটা নিরাসক্ত প্রক্রিয়া। ‘ড্যামেজ’টা কেন হল, কী ভাবে এমনটা ঘটতে পারল, এ মৃত্যু আমাদের পক্ষে কতটা লজ্জার— সে নিয়ে শাসকদের ভাবনা রয়েছে বলে প্রতীত হল না অন্তত।
আরও পড়ুন: অন্ধকারেই শবররা, বিপদ মদের ভাটিতেই, মানছে শাসক
জঙ্গলখাসে কান পাতলে ঘরে ঘরে অসহায়তার আখ্যান। দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে রয়েছে বাতাস। মৃতদের কেউ যক্ষ্মায় আক্রান্ত ছিলেন, কারও হাত-পা-পেট ফুলে যাচ্ছিল। কেউ ওষুধ খেয়েছিলেন, কিন্তু নিরাময় পাননি। কেউ নিয়মিত ওষুধ কিনতেই পারেননি। কাউকে হাসপাতাল ভর্তি নিতে চায়নি বলে অভিযোগ। শবরদের বিকাশে ব্রতী স্বেচ্ছাসেবীরা জানাচ্ছেন, যাবতীয় অসুস্থতা ছিল অপুষ্টিজনিত। গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পের আওতায় ১০০ দিন করে কাজ পাওয়ার কথা বছরে। ৫০ দিনও কাজ দেওয়া যায়নি বলে স্বীকার করছেন পঞ্চায়েত সদস্য। কিন্তু প্রশাসন বা সরকারের নিয়ন্ত্রকদের, রাজ্য বা দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের কান বন্ধ, মুখটা খোলা। জঙ্গলখাসের ঘর-ঘর থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ তাঁদের কানে ঢুকছে না যেন। তাঁদের উন্মুক্ত মুখটা থেকে যেন শুধু বেরিয়ে আসছে নিরাসক্ত, নির্মম, অসংবেদনশীল একটা ভাষ্য।
প্রশাসক, আপনি কি জানেন না, যক্ষ্মারোগ কেন হয়? আপনি কি জানেন না যক্ষ্মারোগের সঙ্গে অপুষ্টির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে? একটা ছোট্ট গ্রাম এবং তার যৎসামান্য জনসংখ্যা। সেই জনসংখ্যার মধ্যে থেকেই ৭ জন মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পরে যখন আপনারা বলেন, যক্ষ্মায় মৃত্যু হয়েছে, তখন কি একবারও ভাবেন না, যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার হারটা মারাত্মক রকম অস্বাভাবিক ওই গ্রামে? একবারও কি মনে হয় না, কোথাও একটা বিরাট গলদ রয়ে গিয়েছে? মনে হয় না যে, কর্তব্যে ভয়াবহ গাফিলতি ঘটে গিয়েছে?
সনাতন মুড়ার মৃত্যুর পরেও এই ধরনের প্রশ্নগুলোর জবাব মেলেনি। এ বারও মিলবে না সম্ভবত। মিলবেই বা কেন? ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আরণ্যক গ্রামে আচমকা মৃত্যুহার বাড়লে শাসকবর্গের কি খুব একটা সঙ্কট হয়? ওই সুদূর প্রান্তিক খণ্ডটায় ঘনিয়ে ওঠা সঙ্কটের আঁচে কি রাজধানীর গায়ে ছেঁকা লাগানোর মতো উত্তাপ রয়েছে আদৌ?
শুধু জঙ্গলখাসের উত্তাপে হয়তো ছেঁকা লাগবে না। কিন্তু যদি এই মুহূর্ত থেকে যত্ন নেওয়া শুরু না হয়, তাহলে এই উত্তাপ নিভেও যাবে না। আশপাশের আরও নানা উত্তাপের সঙ্গে সে সমন্বিত হবে আর সেই সমন্বিত উত্তাপ কিন্তু অচিরেই আরও একটা বস্তার বা অবুঝমাঢ়ের জন্ম দেবে। প্রশাসন ভেবে নিক, প্রশাসন আর কত দিন অবুঝ থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy