Advertisement
E-Paper

হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে

সমীক্ষাটি বলিল, হাসিবার কালে মানুষের চক্ষের পার্শ্বের চামড়া কুঁচকাইয়া যায়, সেই ‘বলিরেখা’র ফলে তাঁহাকে অধিকবয়সি বলিয়া ভ্রম হইয়া থাকে।  

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৮ ০৬:১৬

পশ্চিমবঙ্গে ঘুরিলে-ফিরিলে এখন হাসি চাপিয়া রাখা দায়। অতিরেক হইল কমেডির উপাদান। একটি লোক এক বার পড়িয়া যাইলে লোকে ‘আহা’ বলিয়া উঠেন, কিন্তু পাঁচ বার আছাড় খাইলে অট্টহাস্য করেন। এই রাজ্যবাসী দেখিতেছেন, তাঁহারা এত দিন ধরিয়া পাঁঠা ভাবিয়া খাইয়াছেন সারমেয়র মাংস, মিনারেল ওয়াটার বলিয়া পান করিয়াছেন পুষ্করিণীর জল, গণতন্ত্র ভাবিয়া লাভ করিয়াছেন নিখাদ সন্ত্রাস, বিনামূল্যের চিকিৎসা ভাবিয়া পাইয়াছেন ঘুষ-সাপেক্ষ নিরাময়। চূড়ান্ত ব্যঙ্গব্যবসায়ীও এই পরিমাণ উৎকট নাট্য চট করিয়া লিখিয়া উঠিতে পারিবেন না। যাঁহারা এই রাজ্যবাসী হিসাবে গর্ব অনুভব করিতেন, তাঁহারা হাসিয়া ফেলিতেছেন, কারণ অতিরিক্ত দুঃখে, নিজ অভাবনীয় অধঃপাত দেখিয়া এক প্রকার হাসি পায়। তাহাতে ক্ষতি নাই, পাহাড় হাসিতেছে, জঙ্গল হাসিতেছে, অবশিষ্ট রাজ্য হাসিবে না কেন? মুশকিল বাধিয়াছে অন্যত্র। এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা জানাইয়াছে, মানুষকে হাসিলে বয়স্ক দেখায়। অথচ হাসিমুখ যে সর্বদা কাম্য, এ কথা সকলেই আজন্ম শুনিয়াছেন। মানুষকে হাসিমুখে দেখিলে তাঁহার প্রতি অনুরাগ জন্মে। গম্ভীর বা বিষণ্ণ মুখ দেখিলে, সখ্যের আকাঙ্ক্ষা উবিয়া যায়। এমনকী এই কথাও প্রচলিত: হাসিমুখে থাকিলে মানুষকে কমবয়সি মনে হয়। অথচ সমীক্ষাটি বলিল, হাসিবার কালে মানুষের চক্ষের পার্শ্বের চামড়া কুঁচকাইয়া যায়, সেই ‘বলিরেখা’র ফলে তাঁহাকে অধিকবয়সি বলিয়া ভ্রম হইয়া থাকে।

কিন্তু এই মুহূর্তে সকলের আরাধ্য প্রকল্প: বাহ্যিক বয়স-লক্ষণ যথাসম্ভব কমাইয়া ফেলা। দ্রষ্টা সুকুমার রায় বহু পূর্বেই লিখিয়া গিয়াছিলেন, চল্লিশের পর হইতে মানুষ বয়স ঘুরাইয়া দিবার তালে থাকে। এখন তারুণ্য-উন্মাদনা এমন পর্যায়ে, মানুষ পয়সায় পকেট উপচাইলেও স্বেচ্ছায় অনাহারে থাকিয়া মহাপ্রাণীকে কষ্ট দিতেছে, সকালে উঠিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াইতেছে, কেশে কৃত্রিম রং, মুখে বোটক্স ইঞ্জেকশন, ত্বকে অ্যান্টি-এজিং ক্রিম প্রয়োগ করিয়া হাঁপাইতেছে। বহিরঙ্গে যৌবন সাঁটিয়া রাখিবার পরীক্ষায় কেহ ফেল মারিলে, তাহার আবার যৌবনের উপর এমন প্রকাণ্ড ক্রোধ জন্মাইতেছে, যুবক-যুবতীর প্রণয় দেখিলেই গণধোলাই দিবার জন্য হস্ত সুড়সুড় করিতেছে, কলিকাতার বায়বীয় ‘উচ্চ সংস্কৃতি’র তকমাটির কথা অবধি মনে থাকিতেছে না। ইহাও বুঝিতে হইবে, ‌যাপনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্তর হইল, কষ্টায়ত্ত কৃত্রিম যৌবনটি সহস্রাধিক নিজস্বীর মাধ্যমে বিশ্বময় প্রচার়। কিন্তু নিজস্বীতে হাসিমুখ বাধ্যতামূলক। এত বার হাসিয়া তবে নিজেকে অধিক বয়স্ক বলিয়াই প্রমাণ করা হইয়াছে! এতগুলি এলইডি আলোক ত্রিফলাকে লাউডগা সর্পের ন্যায় জড়াইয়া তবে কলিকাতার অন্তরের দৈন্য ঢাকিতে পারে নাই! তাহার যানজট, ডেঙ্গি, বায়ুদূষণের বাস্তবকে নীল-সাদা পালিশ দিতে গিয়া বলিরেখাই প্রকটতর হইয়াছে! তবে কি নূতন গাম্ভীর্য অনুশীলন করিয়া যৌবনকে অক্ষয় রাখিতে হইবে? কিন্তু এই রাজ্যে বাস করিয়া গম্ভীর গভীর গাঢ় থাকা সম্ভব? কেনই বা নহে, তেলেভাজা শিল্পের পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথে মন ঢালিয়া দিলেই হইবে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও মিনিটে একটি মৃদু বা স্মিত বা কাষ্ঠ বা দেঁতো হাসি ব্যতীত রাজ্যবাসী থাকিতে পারিবেন কি? রাস্তা আটকাইয়া জনজীবন বিপর্যস্ত করিয়া কবি-হাঙ্গামা শুরু হইয়া গিয়াছে যে!

AGE Research
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy