গরিষ্ঠের সমর্থন?
সুগত মারজিতের প্রতিবেদন ‘সমালোচনা জরুরি, ভারসাম্যও’ (২৫-৫) পড়লাম। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল, গণমাধ্যম, প্রশাসন, সরকার— প্রত্যেকেরই কিছু নিজস্ব স্বার্থ, আদর্শ, বিশ্বাস, মূল্যবোধ থাকে এবং তাঁরা তার দ্বারাই চালিত হন এবং হবেন এটাই স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু তার মধ্যে সরকার বা প্রশাসন, কোনও ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর নয়, সরকার জনগণের। সে কারণে সরকারের অবস্থান নিরপেক্ষ এবং তার কাজ ভারসাম্যযুক্ত হবে এটাই কাম্য। জনগণ সেটাই আশা করে।
শ্রীমারজিৎ তাঁর প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যমের ‘বিরোধী পক্ষ’ হয়ে পড়াকে গণতন্ত্রের হানি হিসাবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ কথাও ঠিক, বিরোধী পক্ষের উপস্থিতি গণতন্ত্রের পক্ষে মঙ্গলজনক। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা বিগত পাঁচ বছর কার্যত বিরোধী-শূন্য ছিল। সাংবিধানিক নিয়ম এবং বিরোধীদের প্রাপ্ত আসনের সংখ্যার নিরিখে সর্বোপরি শাসক দলের ইচ্ছা সেই ইঙ্গিতই দিয়েছিল ২০১১ সালে। অতঃপর মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী আগামী বেশ কয়েক বছর বিরোধী পক্ষকে মুখ না খোলার বিধানও দিয়েছিলেন বটে। সুতরাং...
তার মানে কি কেউ সরকারি কাজের সমালোচনা করবেন না? বিরোধিতা করবেন না। হ্যাঁ করবেন। করেছেনও। আর তা করতে গিয়ে ব্যক্তি সংগঠন গণমাধ্যম আক্রান্ত হয়েছে, হিংসার শিকার হয়েছে কখনও প্রশাসনের, কখনও সরকারি দলের বা অজ্ঞাতপরিচয়(?) সমাজবিরোধীদের দ্বারা।
এমত অবস্থাতেও সরকারি কাজের সমালোচনা, বিরোধিতা করার সৎসাহস বা ক্ষমতা যদি কেউ রাখে সে গণমাধ্যম। আর গণমাধ্যমের সেই ক্ষমতাকেই পরোক্ষে উৎসাহিত করেছেন কখনও স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর সহকর্মী বা তাঁর দলের নেতা। পার্কস্ট্রিট, মৌসুমী টুম্পা, অম্বিকেশ, বেল-জেল, শিলাদিত্য— এই রকম শব্দবন্ধগুলি আজ প্রতিবাদের নাম। যার জনক পরোক্ষে সরকার, প্রশাসন বা সরকারি দল। আর সেই প্রতিবাদের প্রতিপালক গণমাধ্যম। যে ভূমিকা সে আগেও পালন করেছে— মরিচঝাঁপি ধানতলা বানতলা সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নেতাই প্রভৃতি শব্দবন্ধগুলি জনমানসে স্থান করে নিয়েছে। ছাপোষা আমবাঙালি প্রতিবাদে অতি সরব নয়, কিন্তু প্রতিবাদকে নিশ্চুপ সমর্থন জানায়, মানসিক ভাবে সহনাগরিকের যন্ত্রণার শরিক হয়, সে সবই তো গণমাধ্যমের দৌলতে। এক দিকে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ যেমন সে উপলব্ধি করে, অন্য দিকে তেমনই আতঙ্কিত হয় ভোটপূর্ব ও পরবর্তী সময়ের হিংসায়। ভোটকে কেন্দ্র করে হিংসা রক্তপাত হত্যা, দিনেদুপুরে বন্দুক হাতে ক্ষমতার আস্ফালন — এ সবই তো নাগরিক প্রত্যক্ষ করে। উন্নয়নের অর্থ সুপ্রশাসন থেকে নাগরিককে বঞ্চিত করা নয়, জনগণের জবাব চাওয়াতে শাসকের অধৈর্য হওয়া নয়। ভারসাম্য রক্ষা করা যে কোনও দায়িত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের মূল শর্ত। সরকার হোক বা গণমাধ্যম। ভালর পাশাপাশি মন্দের অস্তিত্ব যদি সরকার অস্বীকার করে তা হলে সরকারি কাজ সম্পর্কেও প্রশ্নচিহ্ন আসা স্বাভাবিক।
প্রতিবেদক শিক্ষাবিদ তথা শিক্ষা প্রশাসক হিসাবে অভিজ্ঞতার কথা লিখলেন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার উল্লেখ করে। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে প্রাথমিক মাধ্যমিক তথা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের বাস্তবতা এ রাজ্যের এক জন সুধী নাগরিক হয়ে কি জানেন না?
পরিশেষে বলি, প্রতিবেদক এ বারের বিধানসভা নির্বাচনের জনাদেশকে দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন বলে আখ্যায়িত করলেও আসলে তা নেত্রীর প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অগাধ প্রত্যয় ব্যক্ত করে না। আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় দলব্যবস্থার প্রকৃতি ও নির্বাচনী পদ্ধতির কারণে গরিষ্ঠ মানুষের শাসন সে অর্থে প্রতিষ্ঠা হওয়া কঠিন। আজ পর্যন্ত গরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন ক’টি দলই বা পেল? সংখ্যাতত্ত্বের খেলায় বহুমুখী প্রতিযোগিতার প্যাঁচে গরিষ্ঠ আসনপ্রাপ্ত সরকারের ছদ্ম অহংকারে হয়তো অদৃশ্য আশঙ্কার খোঁচা থাকে: ‘ওরা’ বুঝি এখনও গরিষ্ঠ।
ভারসাম্যের খেলায় সরকারের এখনও অনেক পথ চলা বাকি। কথায় কাজে আচরণে যত তাড়াতাড়ি সেই ভারসাম্য আসবে ততই মঙ্গল। আমরা-ওরা, পক্ষ-বিপক্ষ, সরকার-বিরোধী, সকলের মঙ্গল।
মানব মিত্র। করিমপুর, নদিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy