Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Rabindranath Tagore

সম্পাদক সমীপেষু: বিকৃত উদ্ধৃতি

সত্য মিথ্যা বিচার করার চেষ্টা বা ইচ্ছা আর থাকে না। এ এক বিপজ্জনক প্রবণতা। মানুষের যুক্তি বুদ্ধি গুলিয়ে গিয়ে অসত্য কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা।

An image of Rabindranath Tagore

রবীন্দ্রনাথের জীবনের মূল ভাবধারা বিশ্ব মানবতাবাদ। ফাইল ছবি।

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২৩ ০৫:৩২
Share: Save:

সেমন্তী ঘোষ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করেছেন (ঠিক কী বলতেন তিনি, ১০-৫)। বর্তমানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য নিয়ে যে ভাবে দড়ি টানাটানি শুরু হয়েছে, যে ভাবে সমস্ত রাজনৈতিক দলই নিজেদের মতাদর্শের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ থেকে যথেচ্ছ উদ্ধৃতি দিতে শুরু করেছে, তাতে সাধারণ মানুষের হতবুদ্ধি দশা। রবীন্দ্রনাথের জীবনের মূল ভাবধারা বিশ্ব মানবতাবাদ। তাকে বিকৃত করে কৌশলে আরএসএস-এর উগ্র জাতীয়তাবাদের অনুসারী হিসাবে প্রচার করা শুরু করেছে। কোনও বক্তব্যকে সম্পূর্ণ ভাবে না নিয়ে আগুপিছু কাঁচি চালিয়ে মূল ভাবকে পরিবর্তন করে নিজেদের পক্ষে চালানো বর্তমানে এক অতি সাধারণ প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন তাঁকে এমন ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে যে, তাঁর লেখা না পড়ে যদিকেউ শুধু এই সব উদ্ধৃতি পড়েন, তা হলে হয়তো তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ এক হিন্দু মৌলবাদী হিসাবেই পরিচিত হয়ে যাবেন।

সাধারণ মানুষ, যাঁরা হয়তো সে ভাবে রবীন্দ্র সাহিত্য পড়ে উঠতে পারেননি, কিংবা তাঁর গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতার ভাবধারার সঙ্গে সম্যক অবহিত নন, ‘হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়’-এর সৌজন্যে তাঁরা প্রায়শই বিপথে চালিত হচ্ছেন। অনেকেই সমাজমাধ্যমের যে কোনও পোস্টকেই সত্য বলে ধরে নেন এবং আইটি সেলের সৌজন্যে ক্রমাগত ওই অর্ধসত্য পোস্ট দেখতে দেখতে, অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলেও ধীরে ধীরে সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করেন। সত্য মিথ্যা বিচার করার চেষ্টা বা ইচ্ছা আর তাঁদের থাকে না। এ এক বিপজ্জনক প্রবণতা। মানুষের যুক্তি বুদ্ধি গুলিয়ে গিয়ে অসত্য কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা। সচেতনতা বাড়াতে গেলে কোনও তথ্য যাচাই করার যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সেটা এখন বিলুপ্তির পথে। এই প্রবণতা আটকানো না গেলে খণ্ড রবীন্দ্রনাথ, বিকৃত রবীন্দ্রনাথই আগামী দিনের ভবিতব্য বলে মনে হয়।

সুরজিত কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি

ছদ্ম ভক্ত

সেমন্তী ঘোষের লেখাটি পড়ে খুব ভাল লেগেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মূঢ় ধার্মিকতা, ধর্মমোহ, ধর্মীয় গোঁড়ামি, জাতপাত আচারসর্বস্বতার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। তিনি বলেছেন— “...ধর্ম আর ধর্মতন্ত্র এক জিনিস নয়। ও যেন আগুন আর ছাই। ধর্মতন্ত্রের কাছে ধর্ম যখন খাটো হয় তখন নদীর বালি নদীর জলের উপর মোড়লি করিতে থাকে।... ধর্ম বলে যে মানুষ যথার্থ মানুষ সে যে-ঘরেই জন্মাক পূজনীয়। ধর্মতন্ত্র বলে, যে মানুষ ব্রাহ্মণ সে যত বড়ো অভাজনই হোক মাথায় পা তুলিবার যোগ্য। অর্থাৎ মুক্তির মন্ত্র পড়ে ধর্ম আর দাসত্বের মন্ত্র পড়ে ধর্মতন্ত্র।” (কর্তার ইচ্ছায় কর্ম)। তিনি অস্পৃশ্যতা, জাতপাত প্রবল ভাবে ঘৃণা করতেন। এক বার শিলাইদহে জমিদারি দেখাশোনা করতে গিয়ে মুসলমান প্রজাদের জন্য পৃথক, জাজিম-হীন জায়গা নির্দিষ্ট করা রয়েছে দেখে তিনি অত্যন্ত আহত হয়েছিলেন।

‘রাশিয়ার চিঠি’-তে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— “এ-পর্যন্ত দেখা গেছে, যে-রাজা প্রজাকে দাস করে রাখতে চেয়েছে সে-রাজার সর্বপ্রধান সহায় সেই ধর্ম যা মানুষকে অন্ধ করে রাখে। সে-ধর্ম বিষকন্যার মতো; আলিঙ্গন করে সে মুগ্ধ করে, মুগ্ধ করে সে মারে।... ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো।” বিজেপি এবং আরএসএস নেতৃত্ব বাংলায় রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, নেতাজির প্রভাবকে অস্বীকার করতে না পেরে রবীন্দ্রনাথ ও নেতাজির ছদ্মভক্ত সাজছেন। তবে হিন্দুত্ববাদীরা শিক্ষার পাঠক্রম থেকে রবীন্দ্রনাথের ধ্যানধারণাকে বাদ দিতে চাইছে। কী বিচিত্র এদের রবীন্দ্রপুজো। এরা স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন ধারার বিপ্লবী চরিত্রগুলোকে ইতিহাস থেকে তুলে দিতে চাইছে। নেতাজি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মহাপুরুষদের বাংলা তথা দেশবাসীর মন থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা কোনও দিন সফল হবে না। বরং এই সব মনীষীর শিক্ষা ও চিন্তাধারাকে পাথেয় করেই হিন্দুত্ববাদীদের জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন করা সহজ হবে।

বিদ্যুৎ সীট, জগদল্লা, বাঁকুড়া

ধর্মের মোহ

‘ঠিক কী বলতেন তিনি’ প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারাবাহিক বক্তব্য আমাদের কাছে স্পষ্ট। তিনি ধর্মে আস্থাবান, ধর্মের বিকৃতিতে, আচারসর্বস্বতায়, আগ্রাসী ভঙ্গিতে আস্থাবান নন। ‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধে তিনি স্মরণ করেছেন, ফরাসি বিপ্লব, মেক্সিকোর বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, স্পেন বিপ্লবে বিদ্রোহীরা প্রচলিত ধর্মের জাড্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। যে হিন্দু মুসলমানকে ম্লেচ্ছ মনে করে, যে মুসলমান হিন্দুকে কাফের মনে করে, সেই হিন্দু-মুসলমানের ধর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন না হলে সমস্যার সমাধান অসম্ভব। ধর্ম মানুষকে সঙ্কীর্ণ করে দেয়।

সঙ্কীর্ণতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথও কী তুচ্ছ সাম্প্রদায়িক কারণে আক্রান্ত হতে পারেন, তার উদাহরণ এই ধর্মান্ধ আন্দোলনের তীব্রতার মধ্যেই পাওয়া যায়। ১৩৪৩ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় মোহাম্মদী পত্রিকার এক লেখক প্রবেশিকার বাংলা পাঠ্য বিষয়ে নানান রকম প্রতিবাদ জানান। যে সব রচনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, তার মধ্যে রবীন্দ্র রচনাও ছিল। ‘পূজারিণী’ কবিতায় অজাতশত্রু পৌত্তলিকতা প্রচার করেছেন, গান্ধারীর আবেদনে ধৃতরাষ্ট্র অধর্মের যৌক্তিকতা দেখিয়েছেন, ‘বিচারক’ কবিতায় রঘুনাথ রাওয়ের “চলেছি করিতে যবন নিপাত/ জোগাতে যমের খাদ্য” অত্যন্ত আপত্তিকর। ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ জানালেন, এর পর কি মুসলমানেরা প্যারাডাইস লস্ট-এর আর্চফিল্ড, শেক্সপিয়রের লেডি ম্যাকবেথের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করবে? মার্চেন্ট অব ভেনিস-এ ইহুদিদের বার বার কুকুর বলা হয়েছে, অতএব ওই নাটক ত্যাজ্য? এই সমালোচকেরা কি বোঝেন না যে, সাহিত্যের পাত্রপাত্রীর মতামত লেখকের নয়, সেই পাত্রপাত্রীরই? এ ভাবেই যুগ যুগ ধরে স্বার্থান্বেষীর দল সাম্প্রদায়িকতার ছিদ্র অন্বেষণে ধর্মের মোহে আচ্ছন্ন থেকেছেন। দুষ্ট জনেরা কবির ভাবনাচিন্তাগুলি কেটেছেঁটে আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার করে চলেন।

রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গী করে বাঙালি সমাজের অনেকাংশের কাছে পৌঁছনোর সহজ পথটিকে রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা স্বাভাবিক ভাবেই বেছে নিয়েছেন। তবুও হিন্দুত্ববাদীদের হাতে পড়ে রবীন্দ্রনাথের নাকাল দশার হাত থেকে উদ্ধার পেতে আমাদের বেশ কিছু প্রবন্ধ সাহায্য করবে। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলি হল— ‘ইংরাজ ও ভারতবাসী’, ‘ইংরাজের আতঙ্ক’, ‘সুবিচারের অধিকার’, ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’, ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’, ‘হিন্দু-বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘লোকহিত’, ‘স্বরাজসাধন’, ‘বৃহত্তর ভারত’, ‘হিন্দুমুসলমান’ প্রভৃতি। ধর্মান্ধতা নিয়ে তিনি কী বলতে চেয়েছেন, তার জন্য উক্ত প্রবন্ধগুলিই আমাদের পথপ্রদর্শক।

সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

উদারতা

সেমন্তী ঘোষের লেখাটি প্রয়োজনীয়। সঙ্ঘ পরিবারের সর্বগ্রাসী অসহিষ্ণুতার বিপরীতে এই ধরনের উদাহরণ তুলে ধরা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথই বাঙালির মজ্জায় গ্রথিত করেছেন এই উদারতার বোধ। যে কোনও বিষয়ে তাঁর উদ্ধৃতি ব্যবহার বাঙালি আবেগ-এর কারণে নয়, তা অনিবার্য। ভারত বলতে যাঁরা বোঝেন হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান, বাঙালির আদর্শের সর্বাঙ্গে সাম্প্রতিক এই আঘাতগুলি দেখেও লুম্পেন রাজনীতি বা কাটমানির দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে যাঁরা আশ্রয় খোঁজেন মিথ্যা প্রতিশ্রুতির কাছে, তখন জয়সিংহের মতো তাঁদের উদ্দেশে বলে উঠতে তো হবেই, “মিথ্যারে রাখিয়া দিই মন্দিরের মাঝে বহু যত্নে, তবু সে থেকেও থাকে না। সত্যেরে তাড়ায়ে দিই মন্দির বাহিরে অনাদরে, তবুও সে ফিরে ফিরে আসে।”

পার্থ প্রতিম কুন্ডু, কলকাতা-৫৬

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Nationalism Bengali Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE