Advertisement
১০ মে ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: ‘‘আগে কী সোন্দর...’’

লেখক বাঙালির বিশ্বায়নে হিন্দি-ইংরেজির শাসন-শোষণ এবং দাদাগিরি/দিদিগিরির প্রভাবের কথা লিখেছেন। সবিনয়ে প্রশ্ন করি: পুরনো বাঙালিরা কি আদি বাঙালিদের মতো বাংলা, ইংরেজি বা সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ ছিলেন?

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

‘নতুন বাঙালি’ নামে জহর সরকার (রবিবাসরীয়, ৩০-১২) নতুন প্রজন্মকে দায়ী করেছেন। ইংরেজি ২০১৯ নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের আগে শুধু নিউ জেনারেশনের উদ্দেশে যদি এ লেখা হয়, তবে বড্ড একপেশে। পুরনো বাঙালিরা কী রেখে গিয়েছেন তাদের জন্য? সেই তো ১৯৪০ থেকে ১৯৭০ ভাঙিয়ে আজকের পুরনো বাঙালিরা করে খাচ্ছেন। আর তা সম্ভব হয়েছিল ১৯০৫ থেকে ১৯৪০ আদি বাঙালিরা যে জমি রেখে গিয়েছিলেন সে জন্যই। সেই জমিতেই শত ফুল ফুটেছিল।

লেখক বাঙালির বিশ্বায়নে হিন্দি-ইংরেজির শাসন-শোষণ এবং দাদাগিরি/দিদিগিরির প্রভাবের কথা লিখেছেন। সবিনয়ে প্রশ্ন করি: পুরনো বাঙালিরা কি আদি বাঙালিদের মতো বাংলা, ইংরেজি বা সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ ছিলেন? ধ্রুপদী সাহিত্য, শিল্পসংস্কৃতিতেই বা দৌড় কেমন ছিল? পূর্ব বাংলা বা অধুনা বাংলাদেশ বাংলাকে মাথায় করে রেখেছে। কিন্তু পুরনো বাঙালিরা কী করেছেন পশ্চিমবঙ্গে? নাম পরিবর্তন করলেই সমাধান হবে? ভাগ্যিস আদি বাঙালিরা ভারত তথা বাংলা স্বাধীন করেছিলেন, যেখানে পুরনো বাঙালিরা হাহুতাশ করেন— সেই আদি বাংলা ভাষা ধার নিয়ে— ‘‘আহা কী সোন্দর দিন কাটাইতাম!’’

লেখক স্বয়ং স্বীকার করেছেন, ‘‘আমাদের মেনে নিতেই হবে যে, পশ্চিমবঙ্গ ভারতের ২৯টি রাজ্যের মধ্যে একটি।’’ এই সর্বভারতীয় সীমাবদ্ধতার মধ্যে হিংসাত্মক বাঙালিয়ানার প্রাদেশিকতা নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে উস্কানো যায় বটে, কিন্তু তা আত্মহত্যার নামান্তর হয়ে যাবে গোষ্ঠীপ্রধান রাজনীতির অন্ধগলিতে। গর্বের কথা, নতুন বাঙালির ডিএনএ তা জানে। এই জ্ঞান উত্তরাধিকারসূত্রেই প্রাপ্ত। তাই বাংলায় এলে অবাঙালি যে-কেউ তাঁর ভাষায় কথা বলেন স্বচ্ছন্দে, আর ভেতো বাঙালি মনের আনন্দে সেই অবাঙালির মাতৃভাষায় ভাষায় বোঝাতে চেষ্টা করেন, হাজার ভুল হলেও। এটা দুর্বলতা নয়, ‘অতিথি দেবো ভব’-র স্বতন্ত্র সংস্করণ। প্রত্যেকের কাছে তার মাতৃভাষা যে মাতৃদুগ্ধ, তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বাঙালি। বাঙালি যখন অন্য রাজ্যে যায় খুব অসুবিধা হয়, কারণ অন্যেরা এত উদার নয়। তখন খুব রাগ হয়, কিন্তু ঘরে এসে সেই বাঙালি এক্কেবারে আন্তর্জাতিক। রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরদের উদার, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষায় শিক্ষিত এই বাঙালির জন্য আজ বাংলায় নির্ভয়ে আসেন অবাঙালি।

হ্যাঁ, যাঁরা আসছেন অনেকেই ধান্দা করছেন, বিজ়নেস করছেন বাংলায়। সেই ধান্দা, বিজ়নেস, কল-কারখানা, অফিসে, দোকানে কাজ করবেন যে বাঙালি, তিনি শুধুই বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারবেন? সম্ভব? মোবাইল, টেলিভিশন, ল্যাপটপ ব্যবহার করব কিন্তু ইংরেজি ছোঁব না, এত রাঁধিব, বাড়িব, ব্যঞ্জন বাটিব তবু হাঁড়ি ছুঁইব না! আধুনিক ইতিহাস মনে রাখছে, ১৯৯০ থেকে ২৮ বছর হয়ে গেল আধুনিক বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ, বাণিজ্যের জগৎকে কায়দা করে বাংলা ভাষায় আনতে পারেননি পুরনো বাঙালিরা।

লেখকের আক্ষেপ, এই নতুন বাঙালি ১২ জুলাই কমিটির নাম জানে না ইত্যাদি। কেন জানে না? আসলে পুরনো বাঙালি তাঁদের নিজেদের ভাষা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। নিজেরাও নিজেদের ভাষা কতটা বুঝতেন প্রশ্ন থেকে যায়। কথা হল, ১৯৯০-পরবর্তী যুগে সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার এসে প্রচলিত সব মেশিন প্রায় বাতিল করে নতুন ভাষা তৈরি করল। এই পরিবেশে নতুন বাঙালি, যে তার শিশু-কিশোর-যৌবন বয়সে নানা ভাষা শিখছে, তার মানসিক গড়নও বদলে গেল।

লেখক শেষে খোঁচা দিয়েছেন, দাদা বাড়ি গেলে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেন, “কী দেব, জল না সোডা?” জল বা সোডা যা-ই দিন দাদা, পিয়াসি দেখে নেন তা কতটা খাঁটি। নতুন বাঙালি বসে নেই। কবিতা, গান, গল্প সব বাংলা ভাষায় চলছে ফেসবুকে। হোয়াটসঅ্যাপে রোমান হরফে বাংলা লিখছে। অর্থাৎ এখন দরকার নিজের জল নিজে তৈরি করা। এই ফাঁকে নতুন বাঙালির গোটা বাংলা ভাষা দারুণ বদলে যাচ্ছে অনিবার্য ভাবে।

শুভ্রাংশু কুমার রায়

ফটকগোড়া, হুগলি

হিন্দি আগ্রাসন

জহর সরকার তাঁর নিবন্ধে মন্তব্য করেছেন “এমন কিন্তু নয় যে, কোনও হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী বসে বসে ছক করছেন— কী করে বাঙালিদের হিন্দির দাস বানানো যায়।” আসলে এমনটাই। অনেক দিন ধরেই কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দিভাষী এমপিদের সংখ্যাধিক্যের জোরে দেশের সমস্ত রাজ্যে হিন্দি চাপানোর খেলায় মেতেছে। পশ্চিমবঙ্গ তার ব্যতিক্রম নয়। ফলে এই রাজ্যে কী করে ‘নতুন বাঙালি’ তৈরি হল, বুঝতে বাকি থাকে না। ভারতের দক্ষিণের রাজ্যগুলি অবশ্য এর বিরোধিতা করে আসছে। রাজ্যে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসগুলিতে সুকৌশলে হিন্দির ব্যবহার ক্রমশ বাড়ানো হচ্ছে। কর্মচারীদের নানা রকম প্রলোভনের মাধ্যমে আকৃষ্ট করে তাঁদের হিন্দিতে কাজ করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। এটাও বলা হচ্ছে, আগামী দিনে কেন্দ্রীয় দফতরগুলিতে কেবল হিন্দিই থাকবে, ইংরেজির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে। কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক ভাবে প্রবীণ, প্রবোধ ইত্যাদি কোর্স করানো হচ্ছে। এই সব পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে তাঁদের বেতনও বাড়নো হচ্ছে। প্রতি বছর রাজ্যগুলির কেন্দ্রীয় দফতরগুলিতে হিন্দি সপ্তাহ আয়োজিত হয়। সেখানে সমস্ত অনুষ্ঠান হিন্দি ভাষায় করা হয়। আকর্ষক পুরষ্কার দেওয়া হয়। এই ভাবে হিন্দির আগ্রাসন সমস্ত দফতরে সুচারু ভাবে হচ্ছে কি না দেখার জন্য সংসদীয় কমিটি আছে। সে কমিটি দফতরগুলি পরিদর্শন করে এবং হিন্দির প্রসার যাতে ঠিকমতো হয় তার জন্য নির্দেশ জারি করে।

রাজ্যে অবস্থিত কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়গুলিতে হিন্দি মাধ্যমের আধিক্য ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অভিভাবক এবং ছাত্ররা দিশাহারা। রাজ্যগুলিতে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কেবলমাত্র হিন্দির প্রসারের জন্য।

টেলিভিশনে হিন্দি বিনোদন চ্যানেলে সারা ভারতে কদর্য ভাঁড়ামো ভরা অনুষ্ঠান ২৪ ঘণ্টা হয়ে চলেছে। সর্বশ্রেণির মানুষকে এর দর্শক বানাতে হবে তো! ফলে মানুষের রুচি বদলে যাচ্ছে। সঙ্গে তার মুখের ভাষাও বদলে যাচ্ছে।

ব্যতিক্রম ছাড়া বলিউডি ফিল্মের রমরমা তো ক্ষমতা, যৌনতা এবং হিংসা প্রদর্শনের জন্যই। কে না জানে? বহু বছর এ ভাবে চলতে চলতে পশ্চিমবঙ্গে এক শ্রেণির ‘নতুন বাঙালি’ তৈরি হয়েছে। যা দেখে লেখক ভাবিত হয়েছেন। ঠিকই, এ রকম চললে বাংলা ভাষা বাঙালিরা অবশ্যই ভুলে যাবে। তারা হিন্দিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে, শরৎচন্দ্র হিন্দিতে পড়বে। তবে আরও বেশি দিন এ ভাবে চললে এক জন বাঙালিও আর রবীন্দ্র বা শরৎচর্চা করার মতো অনুভূতিশীল থাকবে না। ফলে বাংলায় কোনও সাহিত্যিক বা লেখক তৈরি হবে না। কেননা বাংলা কেউ বুঝতেই পারবে না।

নিবন্ধের পরবর্তী ধাপে লেখক কর্মঠ নবীন প্রজন্মের ছোট ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টাকে প্রশংসা করেছেন। কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু এখানে লেখক উল্লেখ করেছেন, এঁরা কেউ জীবনানন্দ বা সাহিত্যপত্রিকা পড়েননি। তবে আজ থেকে ৪০ বছর আগেও চানাচুর বিক্রেতা, হকার, ডিম বিক্রেতা, সব্জি বিক্রেতারা হেমন্ত, মান্নার অনুষ্ঠানে ভিড় করতেন। আমার নিজের চোখে দেখা। জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে, সাহিত্যপত্রিকা পাঠের সঙ্গে, শ্রমের তো কোনও বিরোধ নেই। প্রথিতযশা লেখক সমরেশ বসু প্রথম জীবনে ডিম বিক্রেতা ছিলেন।

আমার মনে হয় বাংলা ভাষার উন্নতি এবং প্রসারের জন্য বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলির বাংলা ভাষা সাহিত্যের পঠনপাঠন আদর্শ স্তরে নিয়ে যেতে হবে। তৎসহ অঙ্ক এবং বিজ্ঞান শিক্ষার পঠনপাঠন বিশ্বমানের করতে হবে। যাতে অভিভাবক এবং ছাত্ররা আকৃষ্ট হন। তৎসহ পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত বিদ্যালয়ে বাংলাভাষা শিক্ষা আবশ্যিক করতে হবে। ভুললে চলবে না, ভারতের প্রতিটি রাজ্যই ভাষাভিত্তিক। পশ্চিমবঙ্গ ব্যতিক্রম কেন হবে? তবে সঙ্গে ইংরেজিকে রাখতেই হবে। কেননা বাংলার সাহিত্য এবং বিজ্ঞান চর্চায় ইংরেজি ভাষার অবদান আছে এবং থাকবে।

অশেষ দাস

কলকাতা-১১০

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

New Year Bengali People Culture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE