Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Labour Organizations

সম্পাদক সমীপেষু: কাজের নকশা

বর্তমানে শ্রমিক সংগঠনগুলির যা অবস্থা, তাতে এ সব অব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলার ক্ষমতা নেই। ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালনায় আমলাতান্ত্রিক মনোভাবের মানুষজনের নেতৃত্ব থাকা।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ০৬:১০
Share: Save:

প্রহেলী ধর চৌধুরীর ‘সস্তা, অসুরক্ষিত শ্রমের দেশ’ (১৫-১২) প্রবন্ধে কেবল এক শ্রেণির শ্রমিকদের দিয়ে একটা বড় প্রেক্ষিত ধরার চেষ্টা হয়েছে। ওই শ্রেণির শ্রমিক অন্য ভাবে, বা অন্য নামেও আমাদের দেশে তথা রাজ্যে বহু আগে থেকেই ছিল। যন্ত্রের মাধ্যমে কাজ করার সুযোগ যত বেশি হয়েছে, তথাকথিত ‘উন্নয়ন’-এর সঙ্গে নতুন ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে গত পাঁচ-ছ’বছরে কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ধান কাটা, ঝাড়া, সেদ্ধ করা, চাষের আগে জমি তৈরির যাবতীয় কাজ যন্ত্রে হয়। অতীতে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বাড়ির অনুষ্ঠানে খাবার তৈরির কাজে পারিবারিক পরিচিত উৎকলবাসীদের নিয়োজিত করত বাঙালি পরিবারগুলি। এখন সে বাজার সম্পূর্ণ ভাবে দখল করে নিয়েছে কেটারিং সংস্থা। এখানে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অবস্থাও এই একই রকম। তাঁদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কেটারিং কোম্পানিগুলোও ঠিকাদারি দেওয়া শুরু করেছে। অর্থাৎ, একটা অনুষ্ঠান বাড়ির নানা রকম খাবার ভিন্ন ভিন্ন কর্মীরা তৈরি করেন। এঁরা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত নন, বা সরাসরি কেটারিং কোম্পানির সঙ্গেও যুক্ত নন।

বর্তমানে শ্রমিক সংগঠনগুলির যা অবস্থা, তাতে এ সব অব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলার ক্ষমতা নেই। ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালনায় আমলাতান্ত্রিক মনোভাবের মানুষজনের নেতৃত্ব থাকা, আন্দোলনে অবতীর্ণ না হয়েই নেতৃত্বে আসা, ও মালিকের সঙ্গে সংঘাতে না যাওয়ার মানসিকতা থেকে তাঁরা কেবলমাত্র তাত্ত্বিক বক্তৃতা দেন, ও কর্মীদের আন্দোলন-বিমুখ করে রাখেন। শ্রমিক-আন্দোলনের এই অচলাবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনে পুঁজিবাদীদের শ্রম-বিরোধী আক্রমণের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার মতো শ্রমিক সংগঠন খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। শ্রমিকদের রাজনীতি বলে আর কিছুর অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা কম। খেটেখাওয়া মানুষের রাজনীতি করার উপাদান সঙ্কীর্ণ পরিসরেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে।

সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৫৯

কেবল গিগ

‘সস্তা, অসুরক্ষিত শ্রমের দেশ’ প্রবন্ধটি বর্তমান সময়ে ভারতে, তথা সমগ্র বিশ্বের অনিশ্চিত ও অসুরক্ষিত ‘শ্রমের বাজার’ সম্পর্কে পাঠকের ধারণা অনেকটাই স্পষ্ট করে দিয়েছে। যে বাঁধাধরা মাস-মাইনের নিশ্চিন্ত জীবন ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের তরুণ-তরুণীদের স্বপ্নের ভুবন, গিগ পদ্ধতিতে নিয়োগের ফলে তা বিলীন হয়ে যেতে শুরু করেছে। সরকারি চাকরি, অথবা বৃহৎ পুঁজির বেসরকারি সংস্থায় স্থায়ী কাজ জোগাড় করে অবসর জীবন পর্যন্ত নিশ্চিন্তে থাকতে পারার ভাবনাটা এখনকার প্রজন্মের কাছে অলীক স্বপ্নমাত্র। একটা সুরক্ষিত কর্মক্ষেত্র পাওয়ার প্রত্যাশায় বসে থাকতে থাকতে চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা অতিক্রান্ত হয়ে যায়। তবুও প্রতীক্ষায় দিন গোনা চলে। দিন যায়, সংখ্যা পাল্টায়। যে তরুণ-তরুণীরা উপযুক্ত কাজের পরিবেশ পেলে দেশ গড়ার সুযোগ পেতেন, তাঁরা আজ চরম হতাশায় নিমজ্জিত। নিয়োগকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণেরজন্য কেশবতী কন্যা তাঁর মাথার চুল পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

সেনাবাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক সৈন্যদের হাতে দেশের নিরাপত্তার ভার তুলে দেওয়া, পথ-নিরাপত্তার দায়িত্ব অনেকটাই সিভিক পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া, অফিস, কলেজে পার্টটাইম লেকচারার দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া, বা স্কুলে আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে সুকৌশলে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, লেখাপড়া শিখে বেকারের দলে নাম লেখাও, অথবা ঘণ্টাপিছু বা কাজপিছু টাকা নিয়ে গিগ শ্রমিকের কাজে নেমে পড়ো। না হলে অটো-টোটো চালিয়ে বা ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করার কথা ভাবতে শুরু করা যেতে পারে। সরকার নির্বিকার ভঙ্গিতে খেলা-মেলা-পুজোয় অনুদান, আর বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ভাতা দিয়ে ভোটারের মন জয় করারজন্য অতীতে যেমন উদ্যোগ করেছিল, ভবিষ্যতেও সম্ভবতসে পথেই হাঁটবে।

‘তোমার কাজ তুমি নিজেই খুঁজে নাও’— এমন একটা অঘোষিত ফরমান যেন প্রচার করা হচ্ছে। তা না হলে, কেন্দ্রীয় স্তরে রেল, ডাক, ব্যাঙ্ক, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে রাজ্য স্তরে পুলিশে, স্কুল-কলেজে বা সরকারি দফতরে লক্ষ লক্ষ শূন্য পদে নিয়োগ বন্ধ রেখে, ক্যাজুয়াল কর্মীদের দিয়ে কোনও মতে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবা হত না। সরকারের দেখানো পথেই হাঁটছেন বেসরকারি উদ্যোগপতিরা। তাঁরাও ‘গিগ’ পদ্ধতিতে ন্যূনতম মজুরিতে বছরের পর বছর ধরে অফিসে, দোকানে, কারখানায় শ্রমিকদেরদিয়ে দিবারাত্র কাজ করিয়ে নিতে সচেষ্ট রয়েছেন।

এই শ্রমিকদের না আছে কোনও চিকিৎসার সুব্যবস্থা, না আছে কোনও অর্থনৈতিক সুরক্ষা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেবার-কন্ট্রাকটরই শ্রমিকের জোগানদার ও নিয়োগকর্তা। পাওনাগন্ডা যা কিছু, সব বুঝে নিতে হবে লেবার-কন্ট্রাকটরদের কাছ থেকে। বহু ক্ষেত্রেই ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার বিধিটুকুও মানা হয় না। সমাজের অধিকাংশ মানুষই এখন জানেন, এ দেশের কর্মক্ষেত্রে গিগ কর্মীদের জন্য প্রায় কোনও আইনসম্মত ব্যবস্থাই চালু করা যায়নি। পেনশনের প্রত্যাশা তো দূর অস্ত্। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, চিকিৎসার সুরক্ষাটুকুও এক জন শ্রমিক কেন পাবেন না, সে প্রশ্ন করার উপযুক্ত মানুষ নেই। সাংগঠনিক তৎপরতাও দেখা যায় না।

গিগ নিয়োগ পদ্ধতিতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মচারী প্রতি দিন নিজেদের মেধা ও শ্রমের বিনিময়ে উপার্জনের সুযোগ নিয়ে কোনও মতে জীবনযাপন করে চলেছেন। শ্রমিক ইউনিয়নগুলি নীরব। ঘেরাও, কর্মবিরতি, ধর্মঘটকে হাতিয়ার করে আজও যে ভাবে ব্যাঙ্ককর্মীরা বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, বা রাজ্য সরকারের কর্মচারীরা মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করেন, ভবিষ্যতে সেটা করা আদৌ আর সম্ভব হবে কি না, তা অনিশ্চিত।

রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

প্রদীপের নীচে

‘স্নাতকদের ১৩.৪ শতাংশেরই কাজ নেই, মলিন ছবি সমীক্ষায়’ (১৮-১২) সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। চিনকে ছাপিয়ে ভারত এখন জনসংখ্যায় বিশ্বে প্রথম। এই জনসম্পদকে উপযুক্ত কাজে লাগাতে পারলে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি মজবুত হতে পারত। ভারতকে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সমান ভাবা, এবং সরকারের তরফ থেকে বিনামূল্যে রেশন প্রদানের তারিখ বর্ধিত করা, এই দু’টি পরস্পরবিরোধী কাজ এক সঙ্গে চলতে থাকলে সমাজের নিচুতলার মানুষের জীবনের অন্ধকার কোনও দিন ঘুচবে না। সরকারি দফতরের চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর পদের জন্য ডক্টরেট প্রাপ্তরাও আবেদন করছেন। অতিমারিতে অসংখ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হয় শপিং মলের সিকিয়োরিটি গার্ড হয়েছেন, নয়তো বহুজাতিক কোম্পানির ডেলিভারি বয়। এই তালিকায় উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও কম নেই। লোকাল ট্রেনগুলিতে চোখ রাখলে দেখা যাবে, গৃহবধূরাও হকারি করছেন বাধ্য হয়ে। এক দিকে বড় বড় বেসরকারি সংস্থার ঋণ মকুবের পরিমাণ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অন্য দিকে, ঋণভারে জর্জরিত ক্ষুদ্র চাষি ও ব্যবসায়ীরা হয় আত্মঘাতী হয়েছেন, নয়তো ভিক্ষাপাত্র হাতে তুলে নিয়েছেন।

এর পাশাপাশি ধনকুবেরদের সম্পত্তি বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরলে প্রদীপের নীচের অন্ধকার জায়গাটি আরও প্রকট হয়ে পড়ে। এ থেকেই বোঝা যায়, দেশ কতটা এগিয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি না করে বেসরকারি উদ্যোগে উন্নয়ন ঘটানোর চেষ্টা শেষ অবধি দেশের শিক্ষিত বেকারদের আরও বেশি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবে। মানবসম্পদ কী করে উন্নয়নের কাজে আরও বেশি করে নিয়োগ করা যায়, এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে। নইলে কর্মহীনের সংখ্যা কমবে না।

রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Catering
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE