Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Letters to Editor

সম্পাদক সমীপেষু: হরপ্রসাদ ও বঙ্কিম

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শনের সহযোগীদের শেষ সদস্য’ হরপ্রসাদের সঙ্গে সাহিত্যসম্রাটের প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটিও উল্লেখযোগ্য।

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২০ ০১:২৫
Share: Save:

শিশির রায়ের লেখা ‘আত্মবিস্মৃত জাতির কথাকার’ শীর্ষক নিবন্ধের (পত্রিকা, ৩১-১০) প্রেক্ষিতে এই চিঠি। সাহিত্যগুরু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন, “...বাংলাদেশের ইতিহাস লিখবার একজন লোকের আগ্রহ ছিল, তিনি বঙ্কিমবাবু; তিনি আমার প্রতিবেশী, তাঁর সঙ্গে সৌহার্দ্য ছিল।... তাঁর আগ্রহ ছিল এবং মালমসল্লা খোঁজার ভার আমার উপর ছিল। কাঁটালপাড়ায় তাঁর বাড়িতে যেতাম, আলোচনা হত। মোটের উপর সাতটা প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল।” বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শনের সহযোগীদের শেষ সদস্য’ হরপ্রসাদের সঙ্গে সাহিত্যসম্রাটের প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটিও উল্লেখযোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িতে তাঁকে প্রথম নিয়ে গিয়েছিলেন রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। হরপ্রসাদ লিখেছেন, “তাঁহারা চারি ভাই শ্যামাচরণবাবুর বাড়িতে বসিয়া গল্প করিতেছেন। তারের বেড়া ডিঙাইলেই শ্যামাচরণবাবুর বাড়ির দরজা। রাজকৃষ্ণবাবু বাড়ি ঢুকিলেন, তাঁহার সঙ্গে আমারও এই প্রথম প্রবেশ। রাজকৃষ্ণবাবুকে তাঁহারা খুব আদর-অভ্যর্থনা করিয়া বসাইলেন, আমিও বসিলাম।” চার ভাইয়ের নাম হরপ্রসাদের জানা ছিল, তিনি অনুমানক্রমে কোন জন কে চিনে নিলেন। এক সময় বঙ্কিমচন্দ্র রাজকৃষ্ণের কাছে হরপ্রসাদের পরিচয় জানতে চাইলে রাজকৃষ্ণবাবু বললেন, “বাড়ি নৈহাটি, সংস্কৃত কলেজে পড়ে, এবার বি এ পাশ করিয়াছে।” শুনে হরপ্রসাদকে বঙ্কিমের প্রশ্ন, “আমাদের এখানে আসো না কেন?” হরপ্রসাদ মৃদুস্বরে জানালেন, সঞ্জীববাবুর ভয়ে, কামিনী গাছের ফুল ছিঁড়লে তিনি নাকি মারেন। শুনে সকলে হোহো হেসে উঠলেন।

প্রসন্নকুমার কোলে

শ্রীরামপুর, হুগলি

কাঁচা সোনা

বিচিত্র বিষয়ে বহু পুঁথি সংগ্রাহক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’-র সমাধানেও এগিয়ে আসেন। দীনেশচন্দ্র সেন এক জন চণ্ডীদাসের কথা বলেছিলেন, কিন্তু হরপ্রসাদ মনে করতেন, তিন জন চণ্ডীদাস ছিলেন— চৈতন্য-পূর্ব বড়ু চণ্ডীদাস, চৈতন্য-পূর্ব পদাবলির চণ্ডীদাস এবং চৈতন্য-পরবর্তী দীন চণ্ডীদাস। আবার কাশীরাম-বিশেষজ্ঞ হিসেবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী জানান, কাশীরাম দাস মহাভারতের মাত্র চারটি পর্ব রচনা করেছিলেন (কবির ভাই গদাধর অবশ্য এ বিষয়ে জানান, কাশীরাম সবটাই রচনা করেন)। ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত জয়গোপাল গোস্বামীর ‘গোবিন্দদাসের কড়চা’ বিষয়ে পণ্ডিতমহলে আলোড়ন ওঠে। দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ এটিকে বাংলায় লেখা প্রথম চৈতন্য-জীবনীগ্রন্থ বলে মনে করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কিন্তু এ বিষয়ে ‘গোবিন্দদাসের কড়চা’-র প্রামাণ্যতা গ্রহণ করেননি। পরবর্তী কালে সুকুমার সেন, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও এটিকে নকল বলে মনে করেন।

‘ভারতমহিলা’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে শাস্ত্রীমশাই নিজে কী বলেছেন, তা দেখা যেতে পারে। আর্যদর্শন মাসিক পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধটি প্রকাশের জন্য প্রথমে তিনি যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাভূষণের কাছে যান। বিদ্যাভূষণ বলেন, “তুমি বাপু যে সকল ‘ভিউ’ দিয়াছ, আমার সঙ্গে তা মেলে না। আমূল পরিবর্তন না করিলে আমার কাগজে উহা স্থান দিতে পারি না।” হরপ্রসাদের উত্তর ছিল, তাঁর নিজের কোনও ‘ভিউ’ নয়, পুরাণ পুঁথিতে যা পেয়েছেন, তিনি তা-ই সংগ্রহ করে লিখেছেন। (‘বঙ্কিমচন্দ্র কাঁটালপাড়ায়’, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ, বঙ্কিম সংখ্যা, ১৪০২) আর্যদর্শন-এ ‘ভারতমহিলা’-র ঠাঁই হয়নি। পরে বঙ্গদর্শন-এ এই প্রবন্ধের প্রথম তিন পরিচ্ছেদ ছাপা হয়, বাকি পরিচ্ছেদ চলবে কি না জানতে চাইলে সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র হরপ্রসাদকে বলেন, “যাহা ছাপাইয়াছি সে রূপা, এসব কাঁচা সোনা।” লখনউ থাকাকালীন বঙ্গদর্শন-এর জন্য হরপ্রসাদ লিখে পাঠিয়েছিলেন প্রবন্ধ ‘বঙ্গীয় যুবক ও তিন কবি’, তা পড়েও খুশি হয়েছিলেন বঙ্কিম। হরপ্রসাদ লখনউয়ের ক্যানিং কলেজে সংস্কৃত পড়াতে গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের আশীর্বাদ নিয়ে। তাঁর মানসিক চরিত্র গঠনে এই মানুষটির গভীর প্রভাব ছিল। সে জন্যই হয়তো সাহসী ও প্রখর যুক্তিবাদী হরপ্রসাদ অনেক পরে তাঁর ‘বেণের মেয়ে’ উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছেন, “বাঙালী এখন কেবল এ-কেলে ‘গণিকাতন্ত্রের’ উপন্যাস পড়িতেছেন। একবার সে-কেলে সহজিয়াতন্ত্রের একখানি বই পড়িয়া মুখটা বদলাইয়া লউন না কেন?” এ উপন্যাস হিন্দু ও বৌদ্ধ সমাজ-সংস্কৃতির বিচিত্র নিদর্শনের অপূর্ব সমাহার।

সুদেব মাল

খরসরাই, হুগলি

জীবনের উদ্দেশ্য

মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য বিষয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভাবনা আমাদের অবাক করে। মুক্তি, পরমাত্মায় মিশে যাওয়া, এ সবের ধারেকাছে যাননি, মানুষকে দয়া, শিবজ্ঞানে জীবসেবার ধারণাও তাঁর নয়। আমরা সকলেই মানুষের কাছে নানা ভাবে ঋণী। আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য সে ঋণ শোধ করা। সমাজের জন্যে, মানুষের মঙ্গলের জন্যে কাজ করার কারণ হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধতার যে তার তিনি বেঁধে দিয়েছিলেন, তা অনন্যসাধারণ। বঙ্গদর্শন-এ প্রকাশিত ‘মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধে হরপ্রসাদ লিখছেন: “মনুষ্যজীবনের দেনা যে যাহার নিকট হইতে লইয়াছি তাহাকেই শোধ দিতে হইবে তাহা নহে। লইলাম সমাজের নিকট দিলাম সমাজকে; পিতামাতার খাইয়া মানুষ হইলাম, মানুষ করিলাম সন্তানকে। দাতার খাইয়া মানুষ হইলাম, দিলাম অনাথকে। দরিদ্রালয় হইতে মানুষ হইলাম, স্থাপন করিলাম বিদ্যালয়। গুরুর নিকট উপদেশ পাইলাম, শিক্ষা দিলাম ছাত্রকে। গ্রন্থকারের নিকট উপদেশ পাইলাম, নিজে গ্রন্থ পাঠ করিয়া রচনা করিয়া তাহার ঋণ শোধ দিলাম। কিন্তু সর্বত্র চেষ্টা করা উচিত যাহা পাইয়াছি তাহার অধিক দেওয়া।... অনেকে মনে করেন বিদ্যা জীবনের উদ্দেশ্য, আত্মোন্নতি জীবনের উদ্দেশ্য। কিন্তু বিদ্যা যদি খরচ না হইয়া শুদ্ধ পেটে গজগজ করে তবে বিদ্যায় কাজ কী? যদি সেই বিদ্যা দ্বারা তুমি আপন দেনা শোধ দিয়া সমাজকে কিছু ঋণ দিয়া যাইতে পারো তবে তো জানি তোমার জীবন সার্থক।... বিদ্যা যশ ধন মান পরোপকার এ সকল অতি উৎকৃষ্ট পদার্থ হইলেও ইহার কোনটিই জীবনের উদ্দেশ্য নয়। নিজের শরীর ও মনের উন্নতি হইয়া নিজের কর্তব্যকর্ম সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া তাহার পর বিদ্যা দ্বারা হউক, ধন দ্বারা হউক, পরিশ্রম দ্বারা হউক সমাজকে কিঞ্চিৎ ঋণী করিয়া যাইতে পারিলে জীবনের উদ্দেশ্য সফল হইল। নচেৎ শুদ্ধ বিদ্যা লইয়া, ধন লইয়া, শক্তি লইয়া, স্বাস্থ্য লইয়া ধুইয়া খাইলে কিছুই হইবে না।”

ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়

শ্রীরামপুর, হুগলি

সহজ ভাষা

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বাংলা পড়লে অবাক হতে হয়— কী অনায়াস সহজ প্রকাশভঙ্গি, চলিত এমনকি দেশজ শব্দের ব্যবহারে ভরা! এ যুগে বাংলা শব্দের ব্যবহার বিষয়ে পণ্ডিতমহলে এবং সমাজমাধ্যমেও নানা চর্চা ও তর্ক, তাঁদের সকলকে ‘নূতন কথা গড়া’ নামে প্রবন্ধটি পড়তে অনুরোধ করব। এই প্রবন্ধ থেকে শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে শাস্ত্রীমশাইয়ের দেওয়া একটা-দুটো উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। ‘ভঙ্গপ্রবণ’, ‘ভঙ্গুর’ ও ‘ঠুনকো’, এই তিনটে শব্দ পাশাপাশি এনে তিনি শেষে বলছেন, ‘ভঙ্গপ্রবণ’ শব্দের ভাব ‘ভঙ্গুর’-এ তত নেই, যতটা আছে তথাকথিত ‘ইতর ভাষা’ ‘ঠুনকো’ শব্দের মধ্যে। ‘অবজার্ভেটরি’ শব্দের বাংলা তাঁর সময়ের লেখকরা করেছেন ‘পর্যবেক্ষণিকা’, কিন্তু তিনি বলছেন ‘মানমন্দির’-এর কথা। এমনকি গাড়োয়ানরা জায়গাটাকে ‘তারা ঘর’ বলে ডাকে, এই শব্দবন্ধ তাঁর কাছে স্পষ্টতর। তাঁর নিদান: “যাহা সকলে বুঝে— তাহাই চালাও; যাহা চলতি নয়, তাহাকে আনিও না।” “যাহা চলতি, তাহা ইংরেজীই হউক, পারসীকই হউক, সংস্কৃতই হউক— চলুক।” শেষ জীবনে নিজের লেখায় সাধারণ সংস্কৃত শব্দও বদলে দিতেন, ‘সহস্র’-কে ‘হাজার’ করে দিতেন। সংস্কৃত বিভক্তি প্রত্যয় বাংলায় ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন না।

মঞ্জুশ্রী রায়

কলকাতা-৮৪

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE