Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Barb Wire

সম্পাদক সমীপেষু: কার হাতে ছিল রাশ

সুভাষ বসু এবং শরৎ বসু গোষ্ঠী কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে পুরোপুরি হিন্দু স্বার্থে নেমে পড়ে।

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৩৯
Share: Save:

‘পালাবদলের পর হিন্দুরাষ্ট্র?’ (৩০-৩) শীর্ষক প্রবন্ধে পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “১৯৪৭-এ বাংলা ভাগ দাবি করেছিল মুসলিম দলগুলো নয়, প্রধানত শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে বাংলার হিন্দুরা।” তথ্যগত ভাবে এটা কতটা ঠিক? সে সময়ে প্রদেশ কংগ্রেসের ভূমিকা কী ছিল? এই প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর নিহিত আছে। ওই প্রবন্ধে এর ঠিক আগেই পার্থবাবু লিখেছেন, “... চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বের অল্প কয়েক বছর বাদ দিলে বাংলায় কংগ্রেসের প্রাদেশিক নেতৃত্ব ধনী উচ্চবর্ণ হিন্দুদের হাতেই ছিল।” তথ্য বলে, ১৯৪৭-এর বাংলায় পার্টিশন আন্দোলনের নেতৃত্বের রাশও ছিল প্রদেশ কংগ্রেসের হাতেই। ১৯৪৬-এর কলকাতা ও নোয়াখালি দাঙ্গার পর বাঙালি হিন্দুরা বুঝতে পারেন বাংলা বিভাজন অনিবার্য। ১৯৪৬-এর শেষ দিকেই কিছু বাঙালি বুদ্ধিজীবী তৈরি করেন ‘বেঙ্গল পার্টিশন লিগ’। হিন্দুপ্রধান জেলাগুলোকে নিয়ে আলাদা রাজ্য গঠনের পক্ষে প্রচার শুরু হয়। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন হেমন্ত কুমার সরকার, নলিনাক্ষ সান্যাল, সুবোধ চন্দ্র মিত্র এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।

সুভাষ বসু এবং শরৎ বসু গোষ্ঠী কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে পুরোপুরি হিন্দু স্বার্থে নেমে পড়ে। কলকাতার দাঙ্গার আগে, ১৯৪৬-এর নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, হিন্দু মহাসভা ২৬টি সাধারণ আসনে লড়ে একটি আসনও পায়নি। স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ কংগ্রেসের এক অনামী প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়ে মাত্র ৩৪৬টি ভোট পান। যদিও পরে বিশেষ ইউনিভার্সিটি সংরক্ষিত আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁকে জিতিয়ে আনা হয়। বাঙালি হিন্দু ভোটের ২.৭৩% হিন্দু মহাসভার পক্ষে যায়, আর কংগ্রেসের পক্ষে যায় প্রায় ৯০% ভোট।

সেই সময় বাংলা ভাগের দাবিতে ৭৬টি সভা হয়েছিল বলে জানা যায়। তার মধ্যে ৫৯টি সভা কংগ্রেস স্বাধীন ভাবে আয়োজন করে, ৫টি সভা হয় কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার যৌথ উদ্যোগে। আর ১২টি সভা হিন্দু মহাসভা নিজের উদ্যোগে করে (বেঙ্গল ডিভাইডেড, জয়া চট্টোপাধ্যায়, ১৯৯৪)। এ রকম আরও বহু তথ্য থেকে বোঝা যাবে, রাজ্যব্যাপী সংগঠনের জোরে বিধান রায়ের নেতৃত্বে প্রদেশ কংগ্রেস ছিল ‘পার্টিশন মুভমেন্ট’-এর নেতৃত্ব ও চালিকাশক্তি। শ্যামাপ্রসাদ ও হিন্দু মহাসভা তার সহকারী শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। বর্তমানে হিন্দুত্ববাদী আরএসএস যে দাবি করে শ্যামাপ্রসাদই বঙ্গভঙ্গ রূপায়িত করে বাঙালি হিন্দুদের বাঁচিয়েছেন, তা প্রকৃত ইতিহাসের বিকৃতি।

প্রত্যুষ দত্ত, গল্ফ গ্রিন, কলকাতা

দেশভাগ

পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন যে, “১৯৪৭-এ বাংলা ভাগ দাবি করেছিল মুসলিমরা নয়, প্রধানত শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে বাংলার হিন্দুরা।” স্বতন্ত্র বাক্য হিসেবে কথাটা হয়তো সত্য, কিন্তু তাতে কিছুটা আড়াল আছে। ১৯৪৬-৪৭ সাল নাগাদ মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলিমদের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা যদি ধরে নিই (এবং তা নেওয়াটা সঙ্গতও বটে), তা হলে মুসলিমদের বঙ্গভঙ্গের দাবি না-তোলার পশ্চাতে একটা প্রতিচ্ছায়া লক্ষিত হয়। সংক্ষেপে বললে, লীগ সমগ্র বাংলাকেই হস্তগত করতে চেয়েছিল।

সত্যব্রত দত্ত বাংলা বিধানসভার একশো বছর: রাজানুগত্য থেকে গণতন্ত্র গ্রন্থে লিখেছেন, “ভারত ও বঙ্গবিভাগ আসন্ন জেনেও ‘অখণ্ড সার্বভৌম সমাজবাদী’ বাংলা গঠনের জোর তৎপরতা শুরু হয় ১৯৪৭ সালের প্রথম দিকে। এই আন্দোলন পরিচালনার নেতৃত্বে ছিলেন— শরৎচন্দ্র বসু, মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম এবং বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী (সে-সময়ে প্রিমিয়ার বলা হত) হোসেন সুরাবর্দি। প্রথম দু’জন আন্তরিক ভাবেই চেয়েছিলেন অখণ্ড সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলার অভ্যুদয়। সুরাবর্দির কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না। কংগ্রেসের কাছে যেমন, তেমনই তাঁর নিজের দল মুসলিম লীগের কাছেও তিনি নির্ভরযোগ্য ছিলেন না। ইংরেজ সরকার, দিল্লির বড়লাট ও বাংলার লাট বারোজ়ও সুরাবর্দিকে বিশ্বাস করতেন না।”

সুরাবর্দি বলেছিলেন, “বাংলাকে যদি আমরা অবিভক্ত রাখিতে এবং উহাকে বড় করিয়া তুলিবার নিমিত্ত সমবেতভাবে প্রয়াস পাই তাহা হইলে… সেই বাংলা যে কোনও দেশ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইবে। এই কারণে আমি বরাবর বাংলাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে কল্পনা করিয়া আসিয়াছি, ভারতের কোনো ইউনিয়নের অংশ বলিয়া কল্পনা করি নাই।” সত্যব্রতবাবু লিখেছেন, স্বাধীন বাংলার পাকিস্তানে যোগ দে‌ওয়ার প্রসঙ্গে সুরাবর্দি বলেন, “এ বিষয়ে আমার কোনও কিছু বলা চলে না।” বদরুদ্দিন উমর বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি-তে জানিয়েছেন যে, স্বাধীন বাংলার পক্ষ নিয়ে পাকিস্তান-প্রীতি বর্জনের প্রসঙ্গে সুরাবর্দি অস্পষ্ট ছিলেন। সুরাবর্দি সাহেবের ঠিক একই রকমের অস্পষ্টতা ১৯৪৬ সালের ১৬ অগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের প্রাক্কালে লক্ষ করা গিয়েছিল। সুতরাং, স্বাধীন বাংলা গঠনের পর তা যে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিত না, বা যোগ দেওয়ার জন্য আর একটা ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’-র ডাক দেওয়া হত না, তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। মুসলিম লীগ নেতৃত্বের একাংশের এই অখণ্ড বাংলা গঠনের দাবিকে সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানে সমগ্র বাংলার অন্তর্ভুক্তির উপায় হিসেবে ধরে নেওয়া অসঙ্গত হবে না। সে ক্ষেত্রে লীগ যে বাংলা ভাগের দাবি সে ভাবে করেনি, তার নেতিবাচক অর্থটাই প্রকট হয়ে ওঠে।

অশোক মিত্র তাঁর আত্মজীবনী তিন কুড়ি দশ (২য় খণ্ড)-এ লিখেছেন, “...ব্রিটিশ সরকার নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিল যে বঙ্গপ্রদেশ জিন্নার ভাগে যাবে এবং সেই উদ্দেশ্যসাধনে যোগ্য যন্ত্র হবেন সুরাবর্দি ও বারোজ়। তার কারণ বাংলাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে না পারলে ভারত, অঙ্গচ্ছেদ সত্ত্বেও মোটামুটি সম্পূর্ণ, সতেজ ও বলিষ্ঠ থাকবে।” ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা-জাত এমন জটিল ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয় যে, তার আশু সমাধানে বাংলা বিভাগ ভিন্ন উপায়ান্তর ছিল না। এ ব্যাপারে বাংলা প্রদেশ কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার মধ্যে এক বোঝাপড়া তৈরি হয়ে যায়।

সোহম সেন, রিষড়া, হুগলি

পরিণাম

পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আশঙ্কা অমূলক নয়। কিন্তু তাঁর মতো শুভানুধ্যায়ীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন আগে বলেননি, মানুষকে ভোট দিতে দিন, বিরোধীদের রাজনৈতিক কার্যক্রম করতে দিন? বাংলায় আজ সিপিএম, কংগ্রেস বা অন্য বিরোধীরা থাকলে বিজেপির কি উত্থান হত? বর্তমান শাসকের উপর ক্ষুব্ধ হয়েই মানুষ বিজেপিকে লোকসভায় ভোট দিয়েছে। এখন আর বিজেপির ভয় দেখিয়ে কী হবে?

পুলক চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমান

বঙ্গে শিল্প

অমিতাভ গুপ্ত লিখেছেন (‘দুর্ভাগ্যের সাক্ষী, পরিবর্তনের প্রবক্তা’, ২৮-৩ ) “নবজাত রাজ্য ছিল দেশের ধনীতম প্রদেশ। মাথাপিছু আয়ে গোটা দেশে সবচেয়ে এগিয়ে। দ্বিতীয় স্থানে মহারাষ্ট্র। তার দু’দশক পরে ১৯৬৬ সালে গোটা দেশে পশ্চিমবঙ্গ দাঁড়াল অষ্টম স্থানে।”

এর অনেক কারণ। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা এক লাফে দু’কোটি বেড়ে গেল। লাইসেন্স রাজ চালু হওয়ায় ইচ্ছে করে শিল্পের লাইসেন্স কমাতে শুরু করল দিল্লির সাউথ ব্লক। পর্যটন শিল্পে বাংলা অবহেলিত থেকে গেল। বিদেশি মুদ্রার আয় কমল। এর পরে এল মাসুল সমীকরণ নীতি। সর্বনাশ হল বঙ্গদেশের শিল্পের। কয়লা, লোহা সারা দেশে এক দাম, কিন্তু তুলো আমদাবাদে সস্তা। পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো পিছিয়ে পড়ল। জ্যোতি বসুর আমলে একমাত্র বড় শিল্প হয় হলদিয়া পেট্রোরসায়ন শিল্প। বুদ্ধবাবু শিল্পের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তৃণমূলের আন্দোলনে টাটা কোম্পানি সিঙ্গুর ছাড়ল। এখন নতুন সরকার কী করে, অপেক্ষায় আছি।

সঞ্জয় চৌধুরী, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Barb Wire Division of Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE