Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: স্বাবলম্বনের শিক্ষা

অতিমারির দুর্বিপাকে রাস্তায় নেমে-আসা জীবনে এই প্রজন্ম অভিজ্ঞতায় বৃদ্ধ হয়ে গেল বললেও কম বলা হয়।

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২১ ০৪:৪৫

‘ক্লাস ছেড়ে বাজারে ব্যস্ত সৌরভ-শচীন’ (৯-৬) প্রতিবেদনটিকে অনির্বাণ রায় খোলা খাতার মতো সাজিয়েছেন। তাতে এক দিকে স্কুলজীবনের অকাল সমাপ্তিতে কেউ যেমন হা-হুতাশ করতে পারেন, অন্য দিকে, নতুন প্রজন্মের নতুন জীবন শুরুর গল্প অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে। নবম শ্রেণির আনাজ-বিক্রেতা ছাত্রটি বীজগণিতের একটিও সূত্র বলতে না পারলেও বাজারদরের ওঠা-নামা আর মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার নিরন্তর দড়ি টানাটানির রসায়নে রপ্ত করে নেয় অন্য পাঠ। যেটা জীবনের পাঠশালা থেকে দেখে এবং ঠেকে শেখা। এই শিক্ষা কি শ্রেণিকক্ষে সম্ভব? গণিত বইতে থাকা লাভ-ক্ষতির যে অঙ্কটি সে হয়তো অনলাইন ক্লাস করলেও পরীক্ষায় পারত না, এখন পারবে— ৫ টাকায় ৬টি কলা কিনে ৬ টাকায় ৫টি কলা বিক্রি করলে লাভের শতকরা হার কত?

একটা আদর্শায়িত বলয়ে, প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরে থেকে পুঁথিসর্বস্ব শিক্ষা অতিমারি পরিস্থিতিতে বন্ধ আছে। অনলাইনে যা চলছে, তা সেই পুঁথি-পোকা বানানোর আধুনিক আয়োজন। অতিমারির দুর্বিপাকে রাস্তায় নেমে-আসা জীবনে এই প্রজন্ম অভিজ্ঞতায় বৃদ্ধ হয়ে গেল বললেও কম বলা হয়। সচ্ছল বাড়ির ছেলেমেয়ের থেকে সে তাড়াতাড়ি বুঝে যায় স্বাবলম্বনের গুরুত্ব। মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে, এই সভ্যতা শুধু শ্রমক্ষম শরীর তৈরির একটা সুযোগ দিতে পারে। তাই যা কিছু করতে হবে, নিজেকেই করতে হবে। এই প্রকৃত শিক্ষার পাঠ অতিমারি যেন তার হৃদয়, মস্তিষ্কে গেঁথে দিয়ে গেল। আনাজ বিক্রির অঙ্কে জীবন অঙ্কের সহজ সমাধান তার জানা হয়ে গেল। জীবনটাকে তাই তার কখনওই আর বোঝা বলে মনে হবে না। জীবনের ঝড়ঝাপ্টা আরও ভাল ভাবে সামলে উন্নততর জীবনযাপনের পন্থা তারা নিজেরাই আবিষ্কার করতে পারবে।

পার্থপ্রতিম চৌধুরী

কোন্নগর, হুগলি

বৈষম্যের বীজ

কুমার রাণা ‘এ যে কত বড় ক্ষতি’ (১১-৬) নিবন্ধে যথার্থই বলেছেন, এই অতিমারি শিক্ষাঙ্গনে বৈষম্যের বীজ বপন করল। শিক্ষায় দু’টি সুস্পষ্ট শ্রেণি তৈরি করে ফেলল। প্রথম শ্রেণি শহুরে, বিত্তবান পরিবারের শিশু। সে অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতির সহজলভ্যতায় পুঁথিগত শিক্ষায় এগিয়ে গেল অনেকটাই। কিন্তু নির্বান্ধব হয়ে, বদ্ধ ঘরে বন্দি হয়ে রইল। লাফালাফি, দৌড়োদৌড়ি, হাসি, কান্না, খুনসুটি, রাগারাগির অভাব হেতু যথার্থ চরিত্র গঠনের খামতি রয়েই গেল, যা অপূরণীয় এবং প্রকৃত ‘মানুষ’ হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক।

দ্বিতীয় শ্রেণি গ্রামের দরিদ্র পরিবারের শিশু। সে স্মার্টফোনের অভাবে পাঠছুট হয়ে গেল। সারা দিন গেঁড়ি, গুগলি, কাঠ কুড়িয়ে, পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ ধরে বা আনাজ, ফলমূল জোগাড় করে বাবা-মা’র সংসারে ঠেকনদারের কাজ করল। দৈহিক কসরতের পরীক্ষায় সে অনেকটাই এগিয়ে থাকল। কিন্তু ভবিষ্যতে সে কাজের বাজারের প্রতিযোগিতায় টক্কর দিতে পারবে তো? এই শিশুটিরও প্রকৃত মানুষ হওয়ার পথটি গেল আটকে। আশঙ্কা হয়, ভবিষ্যতে শিক্ষা হবে একটি বিপণন ব্যবস্থা। আমাদের ভুলতে
হবে এর অবৈতনিক, সর্বজনীন প্রকৃতির কথা।

সুলতানা ওয়াজেদা

চুঁচুড়া, হুগলি

অনুষ্ঠানের টান

কুমার রাণার পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ যথাযথ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, এই দীর্ঘ বিরতির পর ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ স্কুলে আসাই বন্ধ করে দেবে। এদের মধ্যে অনেকেই যে আবার অচিরে শিশুশ্রমিক হয়ে উঠবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

একটা ঘটনার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিই। আমার স্কুলে বাৎসরিক অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল ২০ মার্চ, ২০২০। ঠিক সেই সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন, অর্থাৎ ১৬ মার্চ থেকে স্কুল বন্ধের নোটিস দেওয়া হল। তত দিনে অনুষ্ঠানের আয়োজন একদম শেষ পর্যায়ে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে স্কুলে ক্লাসের শেষে বন্ধুদের সঙ্গে রিহার্সাল, অভিভাবকদের মধ্যে উদ্দীপনা— সব কিছু যখন এক লহমায় শেষ হয়ে গেল, কী প্রচণ্ড মানসিক চাপ যে পড়েছিল, তা সহজেই অনুমেয়। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলোর এবং সাংস্কৃতিক চর্চার ঠিক সুযোগ পেলে যে স্কুলছুট কমে যায়, তা নিজের চোখে দেখা।

শীর্ষেন্দু পাল

বেগমপুর, হুগলি

জীবন আগে

‘এ যে কত বড় ক্ষতি’ নিবন্ধে লেখক কিছু উন্নত দেশ, বিশেষ করে সুইডেনের স্কুলগুলিতে শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা চালু রাখার কথা উপস্থাপন করেছেন। প্রশ্ন হল, আমাদের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে অল্পসংখ্যক শিশুদের নিয়েও কোনও বিশেষ উপায়ে ক্লাস করাটা কি স্বাস্থ্যসম্মত হবে, যেখানে বড়দের পারস্পরিক মেলামেশা নিয়ন্ত্রণ করতেই কর্তৃপক্ষের ঘাম ছুটছে? সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্তর ত্রুটি আছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। তবু বলতে হয়, আজকের পরিস্থিতিতে এক দিকে যেমন মানুষের জীবনকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে অন্য দরকারি বিষয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্য দিকে জীবনধারণের প্রধান উপাদানগুলোকে পূর্বাবস্থায় ফেরানোর চেষ্টা করতে গিয়েও প্রাণসংশয় হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। শিশুদের থেকে অনেক বেশি যারা বোধবুদ্ধিসম্পন্ন, সেই কিশোর-কিশোরীদের জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় (যেটা মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যাপার) সশরীরে অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগও করে দেওয়া গেল না। জীবাণুদের এই অতিমারি-সুলভ উপদ্রবের জন্য পরোক্ষ ভাবে হয়তো মানুষের কৃতকর্মই দায়ী, কিন্তু, অতিমারিকে পরাস্ত করে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনার ব্যর্থতার প্রশ্নে মানুষকে হয়তো সেই ভাবে দায়ী করা যায় না।

গৌতম নারায়ণ দেব

কলকাতা-৭৪

হারাচ্ছে শৈশব

কুমার রাণার নিবন্ধটি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। দীর্ঘ দিন ধরে স্কুল বন্ধ থাকার ফলে শিশুদের জীবন থেকে শৈশব হারিয়ে যেতে বসেছে। একটা শিশুর ধুলোমাটিতে লুটোপুটি খেলার মধ্য দিয়ে তার মানসিক বিকাশ, দৈহিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রস্ফুটিত হয়। স্কুলের মধ্য দিয়েই তা সম্ভব। আজ দেড় বছর হয়ে গেল, সরকারি-বেসরকারি সমস্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়, নার্সারি স্কুল বন্ধ। এই শিশুদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র ছিল এই স্কুল। ফলে শিশুরা আজ মানসিক অবসাদে ভুগছে। এ দিকে এই সময়কালে তাদের বাবা-মা আর্থিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছেন। ফলে, অনেক সময়ে সন্তানের আবদার, চাহিদা পূরণ করতে না পারার জন্য, তাঁদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। তাঁরাও মানসিক চাপে আছেন। প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের দরিদ্র বাবা-মা বুঝতে পারছেন, শিশুকে তাঁরা ঠিক সময়ে খাবারটুকু মুখে তুলে দিতে পারছেন না।

স্কুল খোলা থাকলে অন্তত সপ্তাহে পাঁচ দিন দুপুরের খাবার খেতে পারত তারা। আজ এই শিশুদের জন্য সব রাস্তাই বন্ধ। না খেলার মাঠ, না বিনোদন, না বন্ধুবান্ধব, না আইসক্রিমওয়ালার ঘণ্টি শোনার শব্দ, না এই বর্ষায় স্কুলের জল-জমা মাঠে কাগজের নৌকা ভাসানো, না কলাপাতা, কচুপাতা মাথায় দিয়ে আনন্দ করতে করতে বাড়ি ফেরা— সবই যেন এই শিশুদের জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই শিশুরা আজ একদম ভাল নেই। আমাদের ভবিষ্যৎ এই শিশুরা। তারা ভাল থাকলে সবাই ভাল থাকবে, এই চিন্তাভাবনা নিয়েই প্রশাসন দ্রুত স্কুল খোলার ব্যবস্থা করুক। কোভিড বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা হোক, কী করে নিরাপদে স্কুল চালানো যায়। আমাদের শিশুরা স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসুক।

স্বপন আদিত্য কুমার

অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

coronavirus
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy