Advertisement
২৭ জুলাই ২০২৪
Student Suicide Cases

সম্পাদক সমীপেষু: অসম লড়াই

কিশোর বয়সে আত্মহননের মুখ্য কারণ অনপনেয় হতাশা। অধিকাংশ সময় এটি তৈরি হয় পারিবারিক অবহেলা ও অনাদর, অভিভাবকদের স্বপ্নপূরণে ব্যর্থতা কিংবা অপরিণত বয়সে ভালবাসার জটিলতা থেকে।

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২৪ ০৪:২৫
Share: Save:

শুভঙ্কর ঘোষের ‘ফার্স্ট বয়দের দেশ’ (২৫-৪) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। সংবাদপত্রের পাতায় দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভে অসফল ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মহননের ঘটনা পড়তে আমরা যেন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আজ এই ঘটনাগুলি সমাজে আদৌ কোনও আলোড়ন তোলে কি? অথচ, আত্মহননের পথ বন্ধ করাও দুরূহ। প্রবন্ধকার লিখেছেন, কিশোর বয়সে আত্মহননের মুখ্য কারণ অনপনেয় হতাশা। অধিকাংশ সময় এটি তৈরি হয় পারিবারিক অবহেলা ও অনাদর, অভিভাবকদের স্বপ্নপূরণে ব্যর্থতা কিংবা অপরিণত বয়সে ভালবাসার জটিলতা থেকে। এ ছাড়াও জিনগত কারণ, ও পরীক্ষায় সফল হতে না-পারার হতাশাও দায়ী।

উল্লিখিত কারণগুলি প্রতিটিই যুক্তিপূর্ণ। কিন্তু এর জন্য যে আর্থসামাজিক পরিস্থিতিও অনেকটা দায়ী, সে কথা প্রবন্ধকার উল্লেখ করেননি। মনে রাখতে হবে, সামাজিক প্রতিষ্ঠার ইঁদুর-দৌড়ে নিজের সন্তানকে জুতে দিতে এক জন অভিভাবক বাধ্য হন তখনই, যখন বিজ্ঞাপনের অলঙ্ঘনীয় প্রলোভন তাঁকে প্রলুব্ধ করে। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে সন্তানকে যুগোপযোগী শিক্ষিত করে না তুললে আর আশা নেই। মনে রাখতে হবে, মধ্যবিত্তরা বিজ্ঞাপনের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। এঁদের যে বিস্তর অর্থ আছে এমন নয়, তবে যা আছে তা দিয়েই অসম লড়াইয়ে নামতে বাধ্য করেন পরবর্তী প্রজন্মকে।

সাহিত্য-সংস্কৃতি, কলাবিদ্যার চর্চায় যে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন, এই ভাবনার সৃষ্টিকর্তা আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। তাই জটিল জ্যামিতিক সমাধান করতে বাধ্য করা হয় সেই ছেলে বা মেয়েটিকে, যে হয়তো সেই সময়ে খুব সুন্দর একটা ছবি আঁকত কিংবা কবিতা লিখতে পারত। বাস্তব জীবনের একটি পর্যায়েও কঠিন বীজগণিতের সূত্র কাজে লাগবে না জেনেও অভিভাবকদের স্বপ্নপূরণে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অগণিত সন্তান। বিদেশের উদাহরণ প্রবন্ধকার তাঁর লেখায় দিয়েছেন বটে, কিন্তু যে পরিকাঠামো এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার ছাপ বিদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে, তার ছিটেফোঁটাও কি আমাদের দেশটিতে আছে?

সবাই তো অসামান্য প্রতিভাবান হয়ে জন্মায় না। প্রতিভাহীনদের উপরে যদি প্রতিভাবানদের মতো সফল হওয়ার মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয়, তা হলে আত্মহত্যা অপ্রত্যাশিত নয়। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা ছেলেমেয়েরা পরিশ্রমী হয়েও যে যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়, তা লিখে বোঝানো যায় না। দিনের শেষে বুঝতে হবে, জীবনে প্রতিষ্ঠা মানে একটা দামি ফ্ল্যাট বিদেশি গাড়ি এবং বিদেশ ভ্রমণ নয়, মানসিক প্রশান্তিটুকুই জীবনের সব।

রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি

প্রত্যাশার খাঁচা

ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রের পরিকাঠামোগত সমস্যার কথা ব্যক্ত করেছেন শুভঙ্কর ঘোষ। আমার মতে, তার সঙ্গে একটি মানসিক এবং সামাজিক সমস্যাও রয়েছে, এবং এই তিনটি সমস্যা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। বর্তমান বেশির ভাগ পরিবারই মধ্যবিত্ত, অণু পরিবার। পিতা, মাতা এবং তাঁদের একটিমাত্র আদরের সন্তান। পরিবারের কর্তা এবং কর্ত্রী উন্নয়নশীল অর্থনীতির অসম প্রতিযোগিতা সামলে পরিবারের দু’বেলার অন্ন সংস্থান করেন। তাঁরা ভাবতে থাকেন, ভাল পড়াশোনা করে ভাল চাকরি পেলে তাঁদের সন্তানের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত থাকবে। তাঁরা আয়ের সিংহভাগ বিনিয়োগ করেন তাঁদের সন্তানের শিক্ষায়। নামী স্কুলে অ্যাডমিশন, প্রতিটি বিষয়ে আরও দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রাইভেট টিউটর রাখা হয়। শিশুটি বিকেলবেলা আর পার্কে খেলতে গেল না, পড়া শেষে তার হাতে গল্পের বই, কমিকসের বই তুলে দেওয়া হল না, আত্মীয়-প্রতিবেশীদের সঙ্গে মেলামেশা কমে এল। পরীক্ষায় সে ভাল ফলও করতে লাগল, তাকে নিয়ে তার অভিভাবকদের স্বপ্ন আরও বাড়তে থাকল। অভিভাবকরা ভাবতে শুরু করলেন, এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্রাত্যতাই হয়তো তাকে সফল হতে বাড়তি সাহায্য করছে।

প্রথম সংঘাত বাধে বয়ঃসন্ধিতে। তখন শিশুর শারীরিক-মানসিক পরিবর্তন হয়। সে হয়তো ভালবাসে হিউম্যানিটিজ়, গান গাইতে, ছবি আঁকতে, খেলাধুলা করতে। কিন্তু তার পরিবার তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বোঝা চাপিয়ে দিলেন ওই কিশোর বা কিশোরীর উপর। তাঁরা বোঝালেন বিজ্ঞান নিয়ে না পড়লে কোনও ভবিষ্যৎ নেই, এঞ্জিনিয়ারিং না পড়লে চাকরির সুযোগ নেই। তাঁরা তাঁদের সন্তানকে তাঁদের দেখা স্বপ্ন দেখতে বললেন, কিন্তু সন্তানের স্বপ্নের কথা জানতে চাইলেন না। তাঁরা ভুলে গেলেন, তাঁর সন্তানের ‘ক্লাসে ফার্স্ট’ সত্তার বাইরেও একটা সত্তা রয়েছে, যা হয়তো পাখির মতো স্বাধীন ভাবে আকাশ ছুঁতে চায়, তাকে বন্ধ করে রাখা হল ‘সমাজ কী বলবে’ নামক খাঁচার ভিতরে। সে হয়তো তার নিজের ইচ্ছাকে অনুসরণ করলে এক দিন শ্রেষ্ঠত্ব পেতেই পারত, মিথ্যা সামাজিক বেড়াজাল এবং চূড়ান্ত অজ্ঞতা তার ওড়ার স্বপ্নকে শেষ করে দিল। যে সেই খাঁচার পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারল সে পোষমানা পাখি হয়ে বেঁচে রইল, যে পারল না সে বেছে নিল আত্মহননের পথ। এই বছর কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জন্মশতবার্ষিকী। যে ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’ তাকে আমরা ‘রোদ্দুর’ হতে দিলাম কই?

এই পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কি? এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে পরিকাঠামোর সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু সেই পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ। কিন্তু আমাদের মানসিক এবং সামাজিক পরিবর্তনটুকু তো আমরা চাইলে করতেই পারি। বিষয় নির্বাচন নির্ভর করুক স্রেফ পড়ুয়ার ইচ্ছার উপর। সমাজ কখনও ঠিক করে দিতে পারে না যে, সে কোনটা করতে পারে আর কোনটা পারে না। বাবা-মায়েদের বুঝতে হবে তাঁদের সন্তান, কেবল তার নিজের জীবনের সৈনিক। আত্মীয়-প্রতিবেশী-বন্ধুবান্ধবের থেকে সামাজিক ব্রাত্যতা কখনওই সাফল্যের সহায়ক নয়, বরং এর ফলে সে আরও অসামাজিক হয়ে পড়ে। নিজের মনের অনুভূতি ভাগ করতে না পারার ফলেই আসে মানসিক অবসাদ। তাই বাবা-মায়েদের হয়ে উঠতে হবে তাঁদের সন্তানের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।

সৌপ্তিক পাল, দাশনগর, হাওড়া

সমাধান সেবায়

‘ফার্স্ট বয়দের দেশ’ প্রবন্ধে তুলে-ধরা সমস্যাটা নতুন নয়। সন্তানের সাফল্যে পিতা-মাতা পরিবার গর্বিত হবেন এটাই স্বাভাবিক, সন্তানকে সর্বোচ্চ স্থানে দেখবেন এই আশাটাও অস্বাভাবিক নয়। কেবল স্বাভাবিক নয় তার উপরে জোর করে সাফল্যে পৌঁছনোর একটা নেশা ধরিয়ে দেওয়া। যে নেশাটার সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধ, চার পাশের মানুষের প্রতি ভালবাসা, দেশপ্রেম, অন্য কিছু নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদ, কোনও কিছুই অনুভব করার উপায় নেই। শুধুই রয়েছে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছনোর এক চূড়ান্ত লড়াই। ফলে সন্তান একটা নীরস লড়াইয়ে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পায় না। পাশের বাড়ির বিপদে সে দৌড়তে চাইলে তাকে বাধা দিয়ে বাবা-মা বলেন, “তুমি পড়ো, কেরিয়ার তৈরি করো। ও সব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।” মানুষের ভাল করার মধ্যে যে অপার তৃপ্তি রয়েছে, তা থেকে তারা বঞ্চিত।

ছেলেমেয়েকে টাকা রোজগারের মেশিন তৈরি না করে যদি তাদের সাবলীল প্রতিভা বিকশিত হতে দেওয়া যায়, দেশ অনেক প্রতিভাধর শিল্প ও সাহিত্যিক পাবে। তাকে বোঝানো দরকার যে, সাফল্যের কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকতে পারে না। তা হলে সে এ দেশ, তথা বিশ্বের মানুষকে কিছু দেওয়ার তাগিদ খুঁজে পাবে। কোথায় হারিয়ে যাবে আত্মহননের ইচ্ছা। মানুষের সেবায় নিয়োজিত যে সমস্ত মানুষজন আজ ইতিহাস রচনা করছেন, তাঁদের মধ্যে কত জন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শীর্ষস্থানে ছিলেন? শিশুর মধ্যে তার চার পাশের মানুষ ও দেশের প্রতি দায়বোধ জাগানো প্রয়োজন।

মিলন কুমার দে, হরিপাল, হুগলি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE