Advertisement
০১ মে ২০২৪
India

সম্পাদক সমীপেষু: নামের সেতু

‘ইন্ডিয়া’ নামের সঙ্গে জাতীয় আবেগ মিশে আছে। এই নাম প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের সেতু। এই নাম শুনলে সারা পৃথিবী‌র মানুষ বুঝতে পারে যে, এ সেই দেশ যার ‘ইন্ডাস ভ্যালি’ সভ্যতা অতি প্রাচীন।

An image of Indus Valley Civilization

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৫:৩৪
Share: Save:

এনসিইআরটি-র পাঠ্যপুস্তকে ‘ইন্ডিয়া’-র বদলে ‘ভারত’ শব্দ ব্যবহারের যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, সে প্রসঙ্গে কণাদ সিংহ “‘ইন্ডিয়া’-ও প্রাচীন নাম’ (৬-১) শীর্ষক প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, ‘ইন্ডিয়া’ নামটিকে যে বলা হচ্ছে ইংরেজদের করা আধুনিক নামকরণ, তা ঠিক নয়। ‘ইন্ডিয়া’ সিন্ধু/ সপ্তসিন্ধু এবং প্রাচীন পারসিক হপ্তহিন্দু/ হিন্দুজ থেকে আসা সুপ্রাচীন গ্রিক নাম।

‘ইন্ডিয়া’ নামের সঙ্গে জাতীয় আবেগ মিশে আছে। এই নাম প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের সেতু। এই নাম শুনলে সারা পৃথিবী‌র মানুষ বুঝতে পারে যে, এ সেই দেশ যার ‘ইন্ডাস ভ্যালি’ সভ্যতা অতি প্রাচীন। ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায় আর্থার ব্যাশাম-এর লেখা দি ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়জ় ইন্ডিয়া বইটির নামকরণ থেকে। সংবিধানে ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’ দু’টি নামকে গ্রহণ করলেও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ইন্ডিয়া-কে। বলা হয়েছে, ‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ় ভারত’, ‘ভারত দ্যাট ইজ় ইন্ডিয়া’ নয়। বিরোধী জোটের ‘ইন্ডিয়া’ নামকরণে ভয় পেয়ে কেন্দ্রের শাসক দল যদি দেশের প্রধান নাম ইন্ডিয়া-কেই বাতিল করে দেয়, তা হলে তা হবে জাতীয় ঐক্য এবং আন্তর্জাতিক পরিচয়ের ক্ষেত্রে বড় ক্ষতি। বিপুল সময় ও অর্থের অপচয়ও হবে। কারণ ইন্ডিয়া পোস্ট, আইআইটি, সিবিআই, আরবিআই, এসবিআই থেকে আরম্ভ করে ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া’ সব নাম পরিবর্তন করতে হবে।

‘ইন্ডিয়া’ নামটি যদি বিদেশি হয়, তা হলে তো ‘হিন্দু’ শব্দটিও বিদেশি। কারণ হিন্দু, সংস্কৃত সিন্ধু-র ফারসি রূপ। এমন বহু বিদেশি শব্দ (যেমন— হিন্দুস্থান) এ দেশের ভাষা‌, আবেগ, সংস্কৃতিতে লীন হয়েছে।‌ তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক পরিচয়ে সুবিধার জন্য বহু দেশ বিদেশি নামেই পরিচিত হতে দ্বিধা করেনি। ‘নিপ্পন’ নিয়েছে তার আন্তর্জাতিক নাম জাপান, ‘ডয়েশল্যান্ড’ পরিচিত জার্মানি নামে, ‘এসপানা’ গ্রহণ করেছে ইংরেজি নাম স্পেন। দুটো নামে অসুবিধা নেই, আন্তর্জাতিক নামটিকে অগ্রাধিকার দেওয়াই লাভজনক।

সুজিত দে, কলকাতা-১১০

মেলার ঐতিহ্য

‘মেলা ও ঝামেলা’ (১৫-১) শীর্ষক সম্পাদকীয়টি যথাযথ। ১৯৭৬ সালের ৩ মার্চ, মাত্র ৫৪টি স্টল নিয়ে কলকাতা বইমেলার সূচনা হয়েছিল বিড়লা তারামণ্ডলের পিছনের মাঠে। এখন জেলায় জেলায় বইমেলা হচ্ছে, তবুও দেশি ও বিদেশি স্টলের আকর্ষণে কলকাতা বইমেলায় ভিড় উত্তরোত্তর বাড়ছে। তবে এক শ্রেণির হুজুগে মানুষ বই থেকে দূরে থাকেন, অহেতুক মেলা চত্বরে ভিড় বাড়ান। যদি বইমেলায় প্রবেশের জন্য কমপক্ষে একশো টাকার টিকিট বা কুপনের ব্যবস্থা করা হয়, এবং তার সমমূল্যের বই কেনার সুযোগ দেওয়া হয়, তা হলে এই অহেতুক ভিড় কমানো যায়। প্লাস্টিক বর্জন করতে কাগজ ও পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা দরকার। গিল্ডের অডিটোরিয়ামে প্রতি দিন বিদগ্ধ মানুষদের আলোচনাসভায় উপস্থিত থাকা ভিড় এখনও বাঙালির সিরিয়াস বিদ্যাচর্চার বহমান ধারার সাক্ষ্য দেয়। প্রকৃত বইপ্রেমীদের বই দেখতে ও পছন্দের বইটি সংগ্রহের সুযোগ করে দিতে গিল্ড কর্তাদের সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগের প্রয়োজন। তা হলেই ‘ঝামেলা’র পরিবর্তে বইমেলা হয়ে উঠবে সর্বাঙ্গসুন্দর।

অনামিকা পাল, আমতা, হাওড়া

মিলনক্ষেত্র

বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন শেষ‍‌, শেখ হাসিনা ফের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। কলকাতার বইমেলাও শুরু হয়েছে। এই সময় স্মৃতিপটে ভেসে উঠল বিংশ শতকের শেষ বইমেলার কথা। ১৯৯৯-এর ময়দানে অনুষ্ঠিত বইমেলায় ‘বাংলাদেশ’ ছিল সর্বপ্রথম থিম। সেই প্রথম বাংলাদেশের কোনও রাষ্ট্রপ্রধান কলকাতায় এলেন বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তার পরে আজ পর্যন্ত কোনও দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বইমেলার উদ্বোধনে আসেননি। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মাতৃভাষা যেমন বাংলা, বাংলাদেশের মাতৃভাষা শুধু নয়, রাষ্ট্রভাষাও বাংলা। সেই অর্থে সে বার প্রথম দুই দেশের বাংলাভাষী বাঙালির মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল কলকাতার বইমেলা।

তবে অনেকেই জানেন না, বাস্তবে সে দিন কতটা কঠিন ছিল কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আগমন, দু’দেশের বাঙালিদের মিলনক্ষেত্র নির্মাণ করা। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ দূতাবাসের সম্মতিতে ঘোষিত হল যে, ১৯৯৯-এর ‘থিম’ বাংলাদেশ। কিন্তু সে বছরই ভয়ঙ্কর বন্যায় ভেসে গেল বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বাংলাদেশের কোষাগারের অবস্থা বেশ খারাপ, বন্যা-দুর্গতদের ত্রাণকার্যে প্রচুর ব্যয় হয়ে গেল। সে বছর কলকাতা বইমেলার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুবাদে আমি, এবং আয়োজনের দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য প্রকাশকরা প্রস্তাব দিলাম যে, আমরাই বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন বানিয়ে দেব। ১৯৯৮-এর নভেম্বরে বাংলাদেশ সরকার জানাল, পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে সরকার, সরকারই প্যাভিলিয়ন নির্মাণ-সহ সব ব্যবস্থা করবে। বাংলাদেশের প্রকাশকরা ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল আসবেন। আমরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণপত্র পাঠালাম। প্রাপ্তিস্বীকার পেলাম, কিন্তু সম্মতি জানিয়ে চিঠি আর আসে না।

আমরা স্থির করলাম, ১৯৯৯-এর ডিসেম্বরে ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলায় যোগদানের সুযোগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আমন্ত্রণ জানাব। যাওয়ার আগে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করলাম, তিনি যেন শেখ হাসিনাকে এক বার আসতে বলেন। আমাদের আবেগের মুখে দাঁড়িয়ে বাস্তববাদী জ্যোতিবাবু মনে করালেন, একটি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীকে আর এক দেশের মুখ্যমন্ত্রী সরকারি ভাবে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন না। তবে শেখ হাসিনাকে মৌখিক ভাবে জানানো যেতে পারে যে, জ্যোতি বসু তাঁকে আমন্ত্রণ করেছেন।

ঢাকা গিয়ে বোঝা গেল, প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাওয়া সহজ হবে না। সৌভাগ্যক্রমে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য দেখা করার অনুমতি পাওয়া গেল। তা-ও সাক্ষাৎকারের জন্য নির্ধারিত সময়ের মাত্র এক ঘণ্টা আগে। কোনও ক্রমে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছনো গেল। তার পর সেই ‘পাঁচ মিনিট’ কথাবার্তা হয়ে গেল এক ঘণ্টারও বেশি। প্রধানমন্ত্রী বড় দিদির মতোই সহজ, আন্তরিক ভাবে কথা বললেন। কলকাতা বইমেলা নিয়ে অনেক কথা জানতে চাইলেন। বুদ্ধদেব বসু, মৃণাল সেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতিবাবু-সহ অনেকে যে আদতে পূর্ববঙ্গের, সে-কথা উঠল। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে জানালেন যে, যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তাঁর পক্ষে অনুষ্ঠানে যোগদান করা কঠিন হবে।

ফিরে আসার পর আমাদের অনুরোধে জ্যোতিবাবু শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি কথা বললেন। অতঃপর সাংসদ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় কেন্দ্রের তৎকালীন বাজপেয়ী সরকারের বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিন্‌হাকে চিঠি লিখে অনুরোধ করতে, তিনি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ পাঠালেন। অবশেষে আমরা সম্মতিপত্র পেলাম। প্রোটোকল রাখতে যশোবন্ত সিন্‌হা স্বয়ং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানালেন। উদ্বোধনের দিন পুলিশের ব্যারিকেড তৈরি হল। নিরাপত্তার বিধি মানতে গিয়ে সাধারণমানুষের আবেগ ব্যাহত হল, তাঁরা বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢুকতেই পারলেন না।

একটি কথা না লিখলেই নয়। বাংলাদেশের নিয়ম অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং কোনও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলে আর কেউ উদ্বোধন করতে পারেন না। আমরা কিন্তু শেখ হাসিনাকে অনু্রোধ করেছিলাম, তিনি যেন বাংলাদেশের অগ্রগণ্য কবি শামসুর রাহমানকে সঙ্গে করে আনেন, আর কবিই যেন বইমেলা উদ্বোধন করেন। শেখ হাসিনা তাঁর দেশের নিয়ম ভেঙে, আমাদের অনুরোধ মেনে, সভার ‘প্রধান অতিথি’ হিসাবে যোগদান করলেন। উদ্বোধন করলেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য কবি শামসুর রাহমান।

অনিল আচার্য, কলকাতা-১০

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE