Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: ভারতে বিজ্ঞান

সাত হাজার বছর আগেকার ভারতীয় উড়োজাহাজ, সুদর্শন চক্র যে আদতে দূরনিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র, সঞ্জয় কর্তৃক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সরাসরি সম্প্রচার, গণেশের মাথায় প্লাস্টিক সার্জারি, সুপ্রাচীন ভারতে টেস্টটিউব বেবি

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

সাত হাজার বছর আগেকার ভারতীয় উড়োজাহাজ, সুদর্শন চক্র যে আদতে দূরনিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র, সঞ্জয় কর্তৃক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সরাসরি সম্প্রচার, গণেশের মাথায় প্লাস্টিক সার্জারি, সুপ্রাচীন ভারতে টেস্টটিউব বেবি— এই সব এবং আরও অনেক হাস্যকর উদ্ভট অপবিজ্ঞানের ঢক্কানিনাদে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্যের গৌরবময় গাথা। এ বিষয়ে দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘সায়েন্স অ্যান্ড ফিলোসফি ইন অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ একটি আকর গ্রন্থ।

ইউরোপীয় ইতিহাসবিদদের মতে প্রাচীন গ্রিসের থালেস (খ্রি পূ ষষ্ঠ শতাব্দী) ছিলেন পৃথিবীতে বিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক, সেই মত যুক্তির সাহায্যে খণ্ডন করে দেবীপ্রসাদ দেখিয়েছেন সে গৌরব প্রাপ্য ভারতীয় চিন্তক উদ্দালক-আরুণির। ছান্দোগ্য উপনিষদের সাহায্য নিয়ে দেবীপ্রসাদ প্রমাণ করেন কণাদেরও আগে পরমাণুর প্রাথমিক ধারণাও উদ্দালক-আরুণিই দিয়েছিলেন। বীজকে বার বার বিভাজিত করে তার ক্ষুদ্রতম কণায় পৌঁছনো বা জলে নুন মেশানোর পর তার স্বাদ মিশ্রণের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার যে কথা উদ্দালক উল্লেখ করেছেন, তাকে আজকের যুগের এক্সপেরিমেন্ট যদি নাও বলা যায়, তারই পূর্বসূরির মর্যাদা তাকে দিতেই হবে। শুধুমাত্র তত্ত্ব না আউড়ে বা কোনও আপ্তবাক্যের সাহায্য না নিয়ে, উদ্দালক প্রতি পদে প্রচণ্ড গুরুত্ব দিয়েছেন পর্যবেক্ষণকে।

সৃষ্টির মূলে দেবতা, আত্মা ইত্যাদির ভূমিকা নস্যাৎ করে উদ্দালক ঘোষণা করেন মহাবিশ্বের সব কিছুই তাপ (তেজস), জল (অপ্) এবং অন্ন থেকে উদ্ভূত। তিনি এও বলেন, মানসের (মন) উৎস অন্ন। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের এক দার্শনিকের এই বস্তুবাদী বিশ্লেষণই তাঁকে বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। দেবীপ্রসাদের ভাষায়: ‘‘অল আদার কনসিডারেশনস অ্যাপার্ট ইট ইজ় দ্য মেথডলজি অব এক্সপেরিমেন্টাল ডেমনস্ট্রেশন দ্যাট এনটাইটলস হিম টু বি রেকগনাইজ়ড অ্যাজ় দ্য ফার্স্ট নেচার সায়েন্টিস্ট ইন গ্লোবাল হিস্ট্রি।’’ পরবর্তী যুগে ভাববাদী দর্শনের উত্থানে উদ্দালক-আরুণির অবদান হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে।

জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চাতেও প্রাচীন ভারতবর্ষ অগ্রণী ছিল। বেদাঙ্গ জ্যোতিষের উৎস প্রাগার্য সভ্যতা। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সংক্রান্ত গবেষণায় ১৯০৯ সালে তিলক

এবং হারম্যান জ্যাকোবি এই

সিদ্ধান্তে আসেন, যদি বৈদিক

সংস্কৃতি ১২০০-১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বেশি প্রাচীন না হয়, তা হলে কৃত্তিকা নক্ষত্র যে পূর্ব দিকেই ওঠে, এই তথ্য শতপথ ব্রাহ্মণ রচনার সময়কালের কোনও পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। এ তথ্য নিশ্চয়ই পূর্বতন কোনও সভ্যতার অবদান। ১৯২১-২২ সালে পুরাতাত্ত্বিক খননের ফলে হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদড়ো সভ্যতার কথা যখন জানতে পারা গেল, তা তিলক এবং জ্যাকোবির তত্ত্বকেই সত্য প্রতিপন্ন করল।

গণিতশাস্ত্রেও প্রাচীন ভারতীয়দের অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল। শূলসূত্র, যা শ্রৌতসূত্রের অংশ, তার মধ্যে ছিল আদি জ্যামিতি এবং পরিমিতির ধারণা।

বিজ্ঞানের উৎপত্তির মূলে আছে

হাত ও মস্তিষ্কের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা— এই অমোঘ বৈজ্ঞানিক সত্য বিধৃত আছে সূত্রগুলিতে।

চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রাচীন ভারতের অগ্রগতির পরিচায়ক দু’টি আকর গ্রন্থ— চরক সংহিতা এবং সুশ্রুত সংহিতা। এর মধ্যে আছে বিজ্ঞান অপবিজ্ঞানের সহাবস্থান। গবেষণার মাধ্যমে দেবীপ্রসাদ দেখিয়েছেন তৎকালীন চিকিৎসক এবং শল্যচিকিৎসকদের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে তুষ্ট রেখে মানবশরীর সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে হত। তাই

বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে কুসংস্কারের মিশেল দিতে হত। কিন্তু এই

আপস সত্ত্বেও (আপস তো গ্যালিলিয়োকেও করতে হয়েছিল) সে যুগের প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষে চিকিৎসাশাস্ত্র সংক্রান্ত গবেষণা এক অত্যুচ্চ শিখর স্পর্শ করেছিল।

‘লোকায়ত’ দেবীপ্রসাদ পথ দেখিয়েছেন। ভারতবর্ষের বৈজ্ঞানিক অতীত নিয়ে আজগুবি গল্প বানিয়ে পৃথিবীর কাছে আমাদের দেশকে হাস্যস্পদ না করে, আমাদের কর্তব্য দেবীপ্রসাদের প্রদর্শিত পথে গবেষণার মাধ্যমে সেই গৌরবময় অতীতের পুনরুদ্ধার। এ বিষয়ে পরশুরামের বক্তব্য স্মর্তব্য: ‘‘যিনি বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সেবক তিনি ধীর ভাবে ভ্রম প্রমাদ যথাসাধ্য পরিহার করে সত্যের সন্ধান করেন, প্রবাদকে প্রমাণ মনে করেন না, প্রচুর প্রমাণ না পেলে কোন নূতন সিদ্ধান্ত মানেন না’’ (বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি)।

শিবাজী ভাদুড়ী

সাঁতরাগাঁছি, হাওড়া

উলুগ বেগ

পিয়াস মজিদের ‘তাসখন্দের মিনারে গালিবের শের’ (১৯-১) শীর্ষক নিবন্ধে সমরখন্দ প্রসঙ্গে তৈমুরী শাসক উলুগ বেগের (জন্ম ১৩৯৪- মৃত্যু ১৪৪৯) উল্লেখ করেছেন, উলুগ বেগ ছিলেন ইতিহাসের এক অন্য রকম চরিত্র।

উলুগ বেগের বাবা মির্জা শাহরুখ (জন্ম ১৩৭৭-মৃত্যু ১৪৪৭), মা গহরশাদ আগা (জন্ম ১৩৭৮-মৃত্যু ১৪৫৭)। মির্জা শাহরুখ ছিলেন বিখ্যাত তৈমুরলঙ্গের (জন্ম ১৩৩৬-মৃত্যু ১৪০৫) চতুর্থ এবং কনিষ্ঠ সন্তান, মা গহরশাদ বেগম মুসলিম নারীদের জ্ঞানচর্চার জন্য সেই যুগেই স্থাপন করেছিলেন মহিলা মাদ্রাসা। তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্র উলুগ বেগ তাঁর সময়ের এক জন শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং অঙ্কশাস্ত্রবিদ। তিনি সম্ভবত মধ্যযুগীয় ইতিহাসের একমাত্র শাসক যিনি নিয়মিত অঙ্ক এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়াতেন সমরখন্দে তাঁর নিজের স্থাপিত জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রে। ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত সেই মাদ্রাসা আজও বিখ্যাত উলুগ বেগের মাদ্রাসা নামে। সমরখন্দের রেগিস্থান স্কোয়ারে বিরাট অঞ্চল জুড়ে সেই মাদ্রাসার উঁচু মিনারগুলো, খিলানগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে অসাধারণ স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে, যার মূল তোরণের গায়ে লেখা ‘জ্ঞানের সন্ধানই প্রত্যেক মুসলমানের পবিত্র কর্তব্য’।

শুধু অঙ্ক বা জ্যোতির্বিজ্ঞান নয়, তাঁর মাদ্রাসায় চর্চা হত সঙ্গীত, সাহিত্য এবং ইতিহাসেরও। মাদ্রাসার সঙ্গেই ছিল উলুগ বেগের বিখ্যাত মানমন্দির। সেখান থেকে ১৪৩৭ সালে উলুগ বেগ প্রকাশ করেছিলেন ৯৯২টি তারার বিশদ তথ্যপঞ্জি-সহ প্রায় ৩০০ পাতার আকাশের এক মানচিত্র, নাম ‘জিজ্-এ-সুলতানি’। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে টলেমি আর ষোড়শ শতকে টেইকো ব্রাহের (১৫৫৬-১৬০১) মাঝে একমাত্র উলুগ বেগের প্রকাশিত তারাদের তথ্যপঞ্জিকে প্রামাণ্য হিসেবে গণ্য করেন বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদরা। এ ছাড়াও উলুগ বেগ ত্রিকোণমিতির বিভিন্ন সূত্রাবলি নিজের মতো করে আবিষ্কার করেছিলেন। মহিলাদের জন্যও তিনি মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন, সমস্ত পড়াশোনা চলত সম্রাটের খরচে।

ক্ষমতা দখলের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নির্দেশে ১৪৪৯ সালে মাথা কেটে ফেলা হয় এই অন্য রকম শাসকের। উলুগ বেগের বয়স তখন ৫৫। আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী সংস্থা চাঁদের প্রায় তিনশো নামাঙ্কিত গহ্বরের একটার নাম রেখেছে ‘উলুগ বেগ ক্রেটার’।

দেবরাজ রায় চৌধুরী

রাজমহল রোড, মালদহ

ঠিক নয়

‘বিস্মৃত কবি’ (কলকাতার কড়চা, ৭-১) পড়ে অবাক হলাম। শেষ বাক্যটি: ‘‘দেশবিদেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর ছাত্রছাত্রীরা নীরব কেন?’’ আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে অধ্যাপক হরপ্রসাদ মিত্রর ছাত্র ছিলাম। তাঁর জন্মশতবর্ষ স্মরণে আমি ‘এবং মুশায়েরা’ পত্রিকার বৈশাখ-আষাঢ় ১৪২৪ সংখ্যায় ‘ক্রোড়পত্র: হরপ্রসাদ মিত্র’ প্রকাশ করি। সেখানে তাঁর প্রবন্ধ, গল্প ও কিছু কবিতা পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। অধ্যাপক অরুণ বসু, বিশ্বনাথ দাস, অলোক রায়, কবি রঞ্জিত সিংহ, স্বস্তি মণ্ডল, তরুণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ অনেকে তাঁর নানা দিক নিয়ে লিখেছেন। এঁরা সকলেই হরপ্রসাদের ছাত্রছাত্রী। কাজেই তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তাঁর জন্মশতবর্ষে নীরব ছিল, এটা ঠিক নয়। বরং শতবর্ষপূর্ণ হওয়ার দু’বছর পরে হঠাৎ প্রতিবেদকের কেন এমন মনে হল, বোঝা গেল না।

সুবল সামন্ত

কলকাতা-৯০

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Science Academics India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE