Advertisement
১৯ মে ২০২৪

মাননীয়া ভারতী ঘোষ, হ্যাঁ আপনাকেই বলছি...

এক হাজার ছেলে ঢুকিয়ে দেবেন? কিসের জোরে? ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অভ্যাস? নাকি জনগণকে ভয় দেখানোর পুরনো পুলিশি দাপট? লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামএক হাজার ছেলে ঢুকিয়ে দেবেন? কিসের জোরে? ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অভ্যাস? নাকি জনগণকে ভয় দেখানোর পুরনো পুলিশি দাপট? লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলাম

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৯ ২৩:৩৫
Share: Save:

কী ভাবছেন? ক্ষমা চাইবেন? নাকি ভাবছেন, ‘যা করেছি, বেশ করেছি!’ তামাম দেশ চমকে উঠেছে আপনার শব্দচয়ন ও হুঁশিয়ারিতে। ঠিক যে ভাবে চমকে উঠেছিল নদিয়ার চৌমুহা। মনে পড়ছে আপনার? সমাজ-মাধ্যমে আপনার ওই হুঁশিয়ারি-ভিডিয়ো এখন ভাইরাল। নেটিজেনদের অনেকেই বলছেন, ‘দাদার পরে এ বার দিদির কীর্তি!’

গ্রামের কত মেয়ে আজও স্বপ্ন দেখে— ‘এক দিন পুলিশ হয়ে গ্রামের অত্যাচার বন্ধ করব।’ আপনার এই ভিডিয়োটি দেখার পরে তারা কি ভাবছে বলুন তো? গুগুলে ভারতী ঘোষ লিখে ‘সার্চ’ করলে চমকে উঠতে হয়। ঝকঝকে কেরিয়ার আপনার। সাফল্যের শাণে প্রখর দীপ্তি। আন্তর্জাতিক স্তরে আপনার কাজ, পুরস্কার, পরিচিতির অন্ত নেই। ঘরের মাটিতেও আপনি যশস্বী। তাই বলে এক হাজার ছেলে ঢুকিয়ে দেবেন এলাকায়? কিসের জোরে? ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেওয়ার আমলাতান্ত্রিক অভ্যাস? জনগণকে ভয় দেখানোর পুরনো পুলিশি দাপট? নাকি মেয়েদের আত্মমর্যাদা নিয়ে আপনি একেবারেই ভাবিত নন!

সমাজে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখে পুলিশ। অপরাধ রোধ করার কাজটাও তাদের। মানুষের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করার শপথ ছিল আপনার। জনগণের টাকায় কর্মজীবনে আপনাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হত। আমলার পদ ছাড়া আপনার দু’বছরও পেরোয়নি। তাই বলে আপনি ‘টেনে টেনে বাড়ি থেকে বার করে কুকুরের মতো’ মারবেন?

অনেকের বিশ্বাস ‘প্রেমে ও রণে’ সব জায়েজ। রাজনীতি এখন যুদ্ধক্ষেত্র। তাই রাজনৈতিক অশিষ্টাচারের খাতা আপনি খুলতেই পারেন। কিন্তু জনগণকে ভিন্‌রাজ্য থেকে ছেলে এনে ভয় দেখানোর কথা কি বলতে পারেন? নদিয়ার চৌমুহার বটতলায় জনপ্রিয় এক সাংসদ-অভিনেতা রাজনীতির সারমর্ম মুখস্থ করে এসেও ছেলে ঢুকিয়ে দেবে বলে সতর্ক করেছিলেন। আপনি কি জানেন, সেই বটতলাকে এখনও অনেকে ‘তাপসতলা’ বলে। কেশপুরে আপনি কিন্তু নিজেই ‘ভারতীতলা’ নির্মাণের কারিগর হয়ে থাকলেন।

ধমকানি আর আইনের অনুশাসনের ফারাক ধরিয়ে দেওয়ার কাজ ছিল আপনার। কিন্তু আপনি তো অনুকরণের রাজনীতিতে নিজেকেই নিজে অতিক্রম করতে বদ্ধপরিকর। যাদবপুর থেকে এমবিএ, বর্ধমান থেকে এলএলবি, তার পরে বিদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও তকমা আছে। আপনার লেখাপড়া ও কেরিয়ারের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। রাজনীতির আঙিনাকে জঞ্জালমুক্ত করার কথা ছিল আপনার। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়ভার ছিল আপনার উপরে। দেশের মেয়েরা তো আপনাদের মতো কয়েক জনের দিকে তাকিয়ে বন্যায় কলার ভেলা ভাসায়।

সেই আপনি বেমক্কা বলে বসলেন, ‘উত্তরপ্রদেশ থেকে এক হাজার ছেলে ঢোকাবো। কিছু করতে পারবি না। খুঁজে পাওয়া যাবে না তোদেরকে। যা বাড়ি যা। ঘরে ঢুকে তালা মার।’ ধরে নেওয়া যাক, উত্তরপ্রদেশের ছেলেরা অস্ত্রে ও শক্তিতে বলীয়ান। তারা এসে দলে দলে অত্যাচার চালাবে। মেয়েরাও রেহাই পাবে না। এক জন মহিলা ও প্রথম শ্রেণির প্রাক্তন আমলা এমনটা ভাবেন কী করে? তা হলে কি জনগণের প্রতি আপনার আস্থা নেই? গণতন্ত্রে বিশ্বাস নেই? নাকি মেয়েদের সম্মান রক্ষার আলাদা কোনও দায়ভার আপনার নেই! মাওবাদী আন্দোলনে উত্তপ্ত জঙ্গলমহলের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আপনার উপর বর্তেছিল। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রীকে আপনি ‘জঙ্গলমহলের মা’ বলে সম্বোধন করতেন। নিজের ক্ষমতা দিয়ে জনগণকে সুরক্ষিত করার বদলে ক্ষমতার ছায়াতেই আপনি নিরাপদ বোধ করেছিলেন। সার্ভিস রুলের বদলে সরকারের নির্দেশকেই আপনি মান্যতা দিয়েছিলেন। আর সেই কারণেই বোধহয় জনগণের প্রতি আপনার দায়বোধ জন্মায়নি। সরকারের প্রতি আসক্ত হওয়ার অভ্যাস থেকে নিজেকে মুক্ত করে নজির সৃষ্টি করতে চাননি।

২০১৪ সালে আপনার হাতে সরকার তুলে দিয়েছিল মেডেল। চকচকে চোখে ছিল দুর্দান্ত আগুন। সেদিনও কিন্তু আপনি ক্ষমতার চোখেই চোখ রেখেছিলেন। এই বৃত্তের বাইরে পড়ে থাকা বিরাট সংখ্যায় মেয়েদের বঞ্চনা ও পীড়নের কথা ভুলেও আসেনি আপনার মাথায়। এই মাটির নিঃসহায় মেয়েদের সঙ্গে মিশে যেতে না পারার ব্যর্থতাই কি আপনাকে এমন হুঁশিয়ারি দিতে বাধ্য করাল? ভয় দেখানোর ক্ষমতা আছে। জয় করার সাহস নেই। মেরে মাটিতে লুটিয়ে দেওয়ার অস্ত্র আছে, অধিকার প্রতিষ্ঠা করে জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াইটা নেই। আপনি বোধহয় জানেন না, জনতার সামনে কামান নিঃস্ব হয়েছে। ইতিহাস তার সাক্ষী। ইউরোপে ত্রাস জাগানো নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীও রাশিয়ার সাধারণ মানুষের ‘পোড়া মাটির’ নীতির কাছে হার মেনেছিল। কোনও যুগে কোনও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের প্রতি অবজ্ঞা, তাদের ভয় দেখানো ও তাদের দুর্বল করার চেষ্টা ইতিহাসে স্থায়ী হয়নি। সেখানে মেয়েদের তো আপনি কয়েকশো বছর পিছিয়ে দিলেন! তাদের অধিকারের লড়াইয়ে কালি লাগিয়ে দিলেন। দিশাহীন, অভিভাবকহীন, চাকরিহীন হাজার হাজার মেয়ে আপনার মতো পুলিশ অফিসারকে দেখে শিহরিত হয়। মনে মনে ভাবে, ‘এ জন্মে না হলেও পরের জন্মে যেন এমন পুলিশ অফিসার হতে পারি।’ তাদের কথা এক বারও ভাবলেন না আপনি!

রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আপনি দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন। একাধিক মেডেল আপনার দক্ষতার স্মারক। আপনি আইন পড়েছেন। বিজনেস ম্যানেজমেন্টেও বিদেশের ডিগ্রি আপনার ঝুলিতে। এমন ব্যক্তিত্ব দেশকে পথ দেখাবে, এটাই তো কাম্য। কিন্তু আপনি যা করলেন, যা বললেন তা কি আপনাকে মানায়? আপনার অন্তর থেকেও এক দৈত্যাকার পৌরুষ বেরিয়ে এল। এর নাম ক্ষমতা। যা একনায়কতন্ত্রের অস্ত্র। এই দোর্দণ্ড স্বৈরাচারকে একরকম ভোঁতা করে দিয়ে জনগণ এসেছিল ক্ষমতার হাত ধরে। আর এই ফণা যখনই উদ্যত হবে, মানুষ তাকে রুখে দেবে।

ক্ষমা চাওয়ার অধিকার নিয়ে কোনও বই লেখা নেই। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও এ নিয়ে পড়ানো হয় না। কিন্তু মানুষ নিজেই উপলব্ধি করে, তার ভুল হয়েছে। তখন মানুষ গানে, গল্পে, কবিতায়, কথনে বা আরও নানা ভাবে ক্ষমা চাইতে থাকে। নালিশের বা তলবের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে না। নির্বাচনের ফলাফল কী হবে কেউ জানে না। কিন্তু এই হুঁশিয়ারির জন্য আপনার অনুতাপ প্রকাশের অপেক্ষায় রইল অনেকেই।

সেই মেয়ে যে আপনার হাত থেকে কন্যাশ্রী পুরস্কার নিয়েছিল তার আজ অবাক হওয়ার দিন। মঞ্চ থেকে নেমে এসে সে আপনার মতো হয়ে ওঠার জন্য সবুজ সাথীর সাইকেলটা অভাবের ঠেলায় বিক্রি করে শহরে পাড়ি দিয়েছে কি না কে জানে! ‘আপনি সবসময় বাতাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, কিন্তু পাল তুলে আপনার ভেসে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন’— এই সহজ কথাটা বোঝার সময় এখনও কিন্তু পেরিয়ে যায়নি। কথাটা এক বার ভেবে দেখতে পারেন মাননীয়া ভারতী ঘোষ।

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 Bharati Ghosh BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE