Advertisement
E-Paper

কেনার জন্য

ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় আয় বেড়েছে অনেকখানিই, কিন্তু সে দিন যাঁদের হাতে টাকা ছিল না, দেশের আয়বৃদ্ধির ফলে তাঁদের বেশির ভাগের হাতে সেই অনুপাতে টাকা এসেছে, এমন কথা বলা যাবে না।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ০৮:২৩
Share
Save

আজ থেকে দেড়-দু’দশক আগে, ভারতে যখন শপিং মল পর্বের উত্থান ঘটছে, তখন বৃহৎ খুচরো বিপণনের এক পুরোধাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এমন অনেক লোকই তো আছেন, যাঁরা মলে যান শুধুমাত্র সময় কাটাতে, কিছু কেনাকাটা করেন না। তাঁরা কি আপনার বিরক্তি উৎপাদন করেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, একেবারেই না, বরং তাঁরা এই রিটেল ব্যবসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আজ তাঁদের কাছে খরচ করার মতো টাকা নেই, কিন্তু কাল থাকবে— তখন তাঁরা ফিরে আসবেন এই মলেই। আজ যা কিনতে পারেননি, কাল তা কিনবেন; সঙ্গে আরও অনেক কিছু কিনবেন। এই কথাটির মধ্যে নিহিত আছে একটি বিশ্বাস— আজ যাঁর হাতে যথেষ্ট টাকা নেই, কাল তাঁর হাতেও সেই টাকা থাকবে; অর্থাৎ, অর্থব্যবস্থা একটা ধারাবাহিক প্রগতির মধ্যে দিয়ে যাবে। আজ যখন ভারতে ‘মৃত শপিং মল’-এর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, ক্রেতার অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক দোকান, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন করতে হয়, দু’দশক আগের সেই বিশ্বাসটিতে কতখানি ভুল ছিল? আর, কতখানি পাল্টে গেল দুনিয়া, যাতে শপিং মল বস্তুটিই এত দ্রুত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে বসল?

গত দেড়-দুই দশকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় আয় বেড়েছে অনেকখানিই, কিন্তু সে দিন যাঁদের হাতে টাকা ছিল না, দেশের আয়বৃদ্ধির ফলে তাঁদের বেশির ভাগের হাতে সেই অনুপাতে টাকা এসেছে, এমন কথা বলা যাবে না। কারণ, ভারতে আয়বৃদ্ধি হয়েছে অসম— জনসংখ্যার একটি ছোট অংশের হাতে বিপুল পরিমাণ টাকা বেড়েছে; সিংহভাগের বেড়েছে ছিটেফোঁটা, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত আয় হ্রাসও পেয়েছে। শপিং মলে মানুষ যে টাকা খরচ করেন, সেটি বিশুদ্ধ কনজ়াম্পশন এক্সপেন্ডিচার বা ভোগব্যয়। সেই ব্যয়ের একটা নির্দিষ্ট চরিত্র আছে— আয়বৃদ্ধির সঙ্গে প্রথমে ভোগব্যয়ের পরিমাণ বাড়তে থাকে; তার পর, বেশির ভাগ পণ্যের ক্ষেত্রে ভোগব্যয়ের পরিমাণ আয়ের অনুপাতে হ্রাস পায়। সেই পণ্যগুলিকে বলা হয় স্বাভাবিক পণ্য— শপিং মলে সচরাচর যে সব পণ্য পাওয়া যায়। অতি উচ্চ আয়ের ক্ষেত্রে যেখানে ভোগব্যয় বাড়ে, তা হল লাক্সারি গুড বা বিলাস পণ্য। তার বিপণি বহুলাংশে আলাদা। যে-হেতু সিংহভাগ মানুষের প্রকৃত আয় বাড়েনি, তাঁদের ভোগব্যয়ের পরিমাণও যথেষ্ট বাড়তে পারেনি। সব মিলিয়ে, শপিং মলগুলি ক্রমে জনশূন্য হয়েছে। আর্থিক অসাম্যের এ এক অনিবার্য ফল— শেষ অবধি তা অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যহানি ঘটাতে থাকে। ২০১৫ সালের পর থেকে, ২০২১-এর ব্যতিক্রমী বছরটিকে বাদ রাখলে, প্রতি অর্থবর্ষেই ভোগব্যয়ের বৃদ্ধির হার তার আগের অর্থবর্ষের তুলনায় কম ছিল, এই তথ্যটির তাৎপর্য উপলব্ধি করা প্রয়োজন।

মধ্যবিত্তের আর্থিক স্বাস্থ্যভঙ্গ ভারতের মতো কিছু দেশের ক্ষেত্রে কঠোর বাস্তব। পাশাপাশি অন্য একটি বৈশ্বিক প্রবণতাও অনস্বীকার্য হয়েছে গত এক দশকে— ই-কমার্স বা অনলাইন বিপণি সর্বত্রব্যাপী হয়েছে। শপিং মল এখন আক্ষরিক অর্থেই ক্রেতার হাতের মুঠোয়— ফোনের অ্যাপ খুললেই কিনে ফেলা সম্ভব প্রয়োজনীয় এবং অবান্তর যাবতীয় সামগ্রী। সেই ব্যবসা চরিত্রগত ভাবেই ইট-কাঠের তৈরি দোকান বা শপিং মলের চেয়ে পৃথক— তার জোগান-শৃঙ্খল আলাদা, ব্যয়ের চরিত্রও আলাদা। ফলে, ই-কমার্সের পক্ষে এমন ছাড় দেওয়া সম্ভব, যা সাধারণ দোকান বা শপিং মলে অকল্পনীয়। গ্রাহকের কাছে স্বাভাবিক ভাবেই সেই বিকল্প গ্রহণযোগ্য হয়েছে— বাড়িতে বসে তুলনায় কম দামে কেনাকাটা করতে পারলে কে আর শপিং মলে যেতে চায়! গত কয়েক বছরে তৈরি হয়েছে কিউ-কমার্সও, যাতে মাত্র কয়েক মিনিটে বাড়িতে পৌঁছে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। সব মিলিয়ে, যাঁদের ক্রয়ক্ষমতা রয়েছে, তাঁদের একটা বড় অংশ শপিং মল ছেড়ে হাত বাড়িয়েছেন অনলাইন কেনাকাটার দুনিয়ায়। এখানে একটি বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন— অনলাইন কেনাকাটা কিন্তু পাড়ার মুদিখানার উপর তেমন সর্বগ্রাসী প্রভাব ফেলতে পারেনি এখনও। পাড়ার দোকানের সঙ্গে অধিকাংশ ক্রেতার সংযোগটি মানবিক, কেবলমাত্র লেনদেনের নয়। অনেকেই সেই সম্পর্ক ছাড়তে নারাজ। অন্য দিকে, সেই মানবিক সম্পর্কের জোরেই, পাড়ার মুদিখানায় বহু লেনদেন চলে বাকিতে— কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতা সংস্থা ছাড়া, ক্রেডিট কার্ড ছাড়া, বন্ধক ছাড়া। যাঁদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা ক্রমহ্রাসমান, অথচ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী না কিনেও উপায় নেই, তাঁদের জন্য এই ব্যবস্থার কোনও বিকল্প হয় কি?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Online Shopping E Commerce

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}