Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
উত্তর সম্পাদকীয়

কুকথার বানে প্রশ্ন জাগে, এ প্রচার কেমন

রাজনৈতিক প্রচারের ভাবভঙ্গি ও ভাষা চয়ন দেখে তাই ধন্দ জন্মে। ভাবনা হয়, সত্যিই কি তবে ‘বদমাশ লোকদের শেষ আশ্রয়স্থল রাজনীতির আঙিনা!’ লিখছেন অনল আবেদিন। রাজনৈতিক প্রচারের ভাবভঙ্গি ও ভাষা চয়ন দেখে তাই ধন্দ জন্মে। ভাবনা হয়, সত্যিই কি তবে ‘বদমাশ লোকদের শেষ আশ্রয়স্থল রাজনীতির আঙিনা!’ লিখছেন অনল আবেদিন।

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৯ ১৩:১৫
Share: Save:

সাম্প্রতিক কালের ভোট প্রচারে নেতা-নেত্রীদের অনেকের মুখের ভাষা আর দেহের ভাষা দেখে প্রয়াত দুই বিখ্যাত মানুষের কথা বার বার মনে পড়ছে। এক জন বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্নাড শ। অন্য জন এসইউসিআই(সি) দলের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক

শিবদাস ঘোষ। শিবদাস গত শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি সময়ে বলেছিলেন, ‘‘রাজনীতি হচ্ছে উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি।’’ সেই সময় সারা রাজ্যের দেওয়াল রাঙা হয়েছিল ওই বাণীতে। শিবদাস ঘোষের ওই উপলব্ধির এক্কেবারে বিপরীত মেরুর কথা বলেছেন জর্জ বার্নাড শ। প্রায় শতবর্ষ আগে তিনি বলেছেন, ‘‘politics is the last resort for the scoundrels.”

প্রায় এক দশক জুড়ে দেশের সাংস্কৃতিক রাজ্যের রাজনৈতিক প্রচারের ভাবভঙ্গি ও ভাষা চয়ন দেখে তাই ধন্দ জন্মে। ভাবনা হয়, সত্যিই কি তবে ‘বদমাশ লোকদের শেষ আশ্রয়স্থল রাজনীতির আঙিনা!’

বছর আটেক আগে, ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটে ও তারও বছর দু’য়েক আগে ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের প্রচারের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কেউ বলেন ‘উটমুখী’, কোনও ‘মার্কসবাদী’ আবার ‘ছোটবাবু’ ও ‘বড়বাবু’র তুলনা টেনে প্রতিপক্ষ নেত্রীকে যৌনকর্মীর সমতুল হিসাবে প্রকাশ্য জনসভায় কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি সহকারে তুলোধোনা করেন।

কারও আবার পাল্টা জবাব ছিল, ‘‘আমি গুন্ডা কন্ট্রোল করি!’’ কেউ প্রতিপক্ষের নেত্রে ‘পশ্চাৎদেশ’ দেখাতে দলীয় কর্মাদের নির্দেশ দেন। সেই খেউড় ভাষায় অতি সম্প্রতি ‘চন্দননগরের মাল’-এর সংযোজন, ‘ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেব...!’ তড়িৎ গতিতে সেই ‘সুবচন’ জনসমাজে ও সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। গত পঞ্চায়েত ভোটের বীরভূমের ‘গুড়-বাতাসা’ এ বার ‘নকুলদানা’য় রূপান্তরিত হয়েছে। পাল্টা আমদানি হয়েছে ‘মিহিদানা’ আর ‘বুক লক্ষ্য করে গুলি করার’ নিদান।

জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে ভোট প্রচারের এমন কদর্য পরিণতি দেখে অসুস্থতা বোধ করছেন ৯২ বছর বয়সের ইতিহাস গবেষক বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫২ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম নির্বাচন থেকে ভোট দিয়ে আসছেন। ভোটের প্রচারে মুর্শিদাবাদ জেলায় আসা জাতীয় নেতাদের অনেকের বক্তৃতা তিনি শুনেছেন। তিনি বলছেন, “রাজনৈতিক ভাষণের নামে আশালীন ও অশ্রাব্য কথা আমি কৈশোরে, যৌবনে কখনও শুনিনি। রাজনৈতিক ভাষণের নামে বছর দশেক থেকে যা শুনছি, তা তো খিস্তি খেউড় ছাড়া আর কিছুই নয়!” অথচ তিনিই অন্য ঘরানার রাজনৈতিক ভাষণ শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন। এখন কোথায় সেই মতাদর্শের লড়াই, কোথায় সেই শিল্পময় শ্লেষ ও ঠেস!

দেশ তখন সদ্য স্বাধীন। বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায় নবগ্রামের গুড়াপাশলা হাইস্কুলের শিক্ষক। নবগ্রাম বিধানসভার প্রার্থী ছিলেন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির বীরেন রায়। লালগোলার রাজপরিবারের সন্তান বীরেন রায় প্রয়াত স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কুটুম্ব। কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙনের পরেও সিপিএমের প্রার্থী হিসেবে বীরেন রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কয়েক বার বিধায়ক হয়েছিলেন। সে বার তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের প্রধান স্থপতি দুর্গাপদ সিংহ।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বিজয় বন্দ্যোপাধ্যােয়র এখনও মনে আছে, ‘‘নবগ্রামে ভোট প্রচারের জনসভায় দুর্গাপদবাবু তাঁর প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে বলেন, ‘এ দেশের কমিউনিস্টরা বড় মুখ করে রাশিয়ার কথা বলেন। কনকনে ঠান্ডার দেশ। অথচ শীত নিবারণের জন্য সে দেশের বেশিরভাগ মানুষের গায়ে পোশাকই জোটে না।’ তিনি প্রতিপক্ষ প্রার্থীর নামটি পর্যন্ত মুখে নেননি।”

তার কয়েক দিন পরে নবগ্রামের ওই মাঠেই বীরেন রায়ের পক্ষে প্রচার করতে গিয়েছেলেন অবিভক্ত কমিউনিস্ট দলের নেতা জ্যোতি বসু। বিজয়বাবু হাসছেন, ‘‘দুর্গাপদ সিংহের বক্তব্যের পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে জ্যোতি বসু বলেন, ‘দুর্গাপদবাবু বহু দিনের রাজনীতিবিদ হলেও তিনি কিন্তু রাশিয়ায় যাননি কোনও দিন। তা উনি রাশিয়ার কী বুঝবেন? আমি রাশিয়ায় গিয়েছি। তিনি ঠিকই বলেছেন। সত্যিই রাশিয়ায় খুব ঠান্ডা। কিন্তু কারও শরীরে পোশাক নেই, এমন তো দেখিনি। অথচ আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনারা যাঁরা এখানে আছেন, তাঁদের পায়েই তো জুতো নেই।’ শ্রোতারা নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে ঘাড় নাড়েন।”

সেই ১৯৫২ সাল থেকে বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মৃত্যু পর্যন্ত সাংসদ ছিলেন আরএসপি-র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ত্রিদিব চৌধুরী। পর্তুগিজদের কাছ থেকে গোয়া স্বাধীন করার আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। ওই আন্দোলনের কারণে তিনি ১৯ মাস গোয়ার জেলে বন্দিও ছিলেন। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্র থেক নির্বাচিত সাংসদ। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৭ সালের মৃত্যদিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ।

আরএসপির মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া তথ্য অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে ত্রিদিব চৌধুরীর বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে প্রার্থী দিতে দেননি। ঢাকায় জন্ম বলে তাঁর ডাক নাম ঢাকু। ১৯৭১ সালের লোকসভা ভোটে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন প্রদেশ কংগ্রেসের সেই সময়ের সভাপতি তথা সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি সমন্বয়ের অন্যতম পথিকৃৎ রেজাউল করিম।

জিয়াগঞ্জ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক তথা মুর্শিদাবাদ জেলার রাজনৈতিক ইতিহাসের গবেষক বিষাণ গুপ্ত বলছেন, “নিজের নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিতে উঠে ত্রিদিব চৌধুরীর ডাক নাম ধরে সম্বোধন করে রেজাউল করিম বলেন, ‘ঢাকু বড় ভাল ছেলে। দেশের জন্য লোকসভায় তারও যাওয়ার প্রয়োজন আছে। আপনারা মনে করলে তাকেও ভোট দিতে পারেন। আমাকেও ভোট দিতে পারেন। ঢাকু জিতলেও আমি খুশি হব।’ এ রকম প্রচার আজ আর কল্পনাও করা যায় না।”

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE