Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ভোট মিটে যায়, পড়ে থাকে অন্তহীন নির্বাসন

মুগ্ধ প্রজাপতি সরে গেলে কাঁটাতারের ও পারের নির্বাসিত চরাচরে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। ঘুটঘুটে অন্ধকার এসে গিলে খায় এই হতভাগ্য নির্বাসিতদের ইহকাল, পরকাল। লিখছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৯ ০৩:০৯
Share: Save:

স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সমাজ, মানুষের অধিকার এবং ৭২ বছরের প্রবীণ স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষ। তবুও মুছে ফেলা গেল না দেশভাগের আধেক-লীন স্মৃতিকাতরতায় আচ্ছন্ন বেদনার চোরা রক্তস্রোত। অবিভক্ত বাংলার সীমানা বিভাজনের সঙ্গে আজও মিশে রয়েছে লক্ষ মানুষের বুকফাটা হাহাকার, লক্ষ ধারার কান্নার স্রোত, লক্ষ হৃদয় জুড়ে ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্তক্ষরণের দগদগে দাগ। একদা পশ্চিমবঙ্গ আজকের ‘বাংলা’ হওয়ার প্রচেষ্টাও বোধহয় মুছে দিতে পারল না আমাদের এই দ্বিখণ্ডিত ইতিহাসের সীমানা বেয়ে চলকে পড়া অনর্গল রক্তস্রোতের প্রবাহ! আর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের যন্ত্রণার ফল্গুধারা তিস্তা, পদ্মা, মাথাভাঙার স্রোতে ভাসতে ভাসতে মেঘনার স্রোতে মিশে সাগরের লোনা স্বাদে এখনও মুক্তি খুঁজে চলেছে।

বাংলাদেশের লালমনিরহাটের সিরাজুল মিঞা কিংবা ভারতের মেখলিগঞ্জের নকুল বর্মণের ব্যাকুল হৃদয় থেকে করুণ আক্ষেপ ছিটকে পড়ে বাংলার বক্ষছেদি সীমান্তের বেড়াজালে—‘দেশভাগ আমাদের আলাদা করতে পারেনি, আন্তর্জাতিক সীমানা আমাদের আলাদা করতে পারেনি; কিন্তু এই কাঁটাতারের বেড়া আমাদের একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দিল।’ কাঁটাতার বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বেশ কিছু গ্রামবাংলার মেঠো জনপদ। চর মেঘনা, বিষ্ণুগঞ্জ— আরও কত নাম। হলুদ খেতের প্রান্তে অনাদরে বেড়ে ওঠা বকুল গাছের পাতারাও অস্ফূটে ডুকরে ওঠে। ঘোড়ানিম গাছ বেয়ে নেমে আসে হাহাকারের নিঃসঙ্গ বাতাস।

ভারত-বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত নির্ধারণের রূপকার এতটুকুও বুঝতে চাননি, এই বক্ষছেদি সীমান্তরেখা কত গ্রাম, কত গৃহস্থালি, কত খেত, কত মানুষ, কত হৃদয়ের আকুতিকে বিভাজিত করেছে। ৭২ বছরের পুরনো সেই ক্ষত থেকে আজও ঝরে পড়ে বেদনা ও আক্ষেপের রক্তের ফোঁটা। আবারও কিন্তু বিভাজিত হয়েছেন আমাদের কতিপয় সহনাগরিক, ভারত-বাংলাদেশের প্রকৃত আন্তর্জাতিক সীমান্ত ঘেঁষে ভারতের অভ্যন্তরে যাঁদের বাস। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ভারত-বাংলাদেশের প্রকৃত আন্তর্জাতিক সীমারেখা (জিরো লাইন) বরাবর ভারত কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে পারেনি। প্রকৃত আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে ন্যূনতম ১৫০ মিটার ভারত ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে সীমান্ত লাগোয়া বেশ কিছু অঞ্চলে ভারত সরকার কাঁটাতারের প্রাচীর নির্মাণ করেছে। বিভাজনের এই ধাতব প্রাচীরের উদ্যত অস্তিত্বে সীমান্তরেখার কাছাকাছি অনেক জনপদ আবারও বিভাজিত হয়ে গিয়েছে মূল ভারত ভূখণ্ড থেকে।

২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে মোট ৪,০৯৭ কিলোমিটার বিস্তৃত আন্তর্জাতিক সীমান্তে প্রথম পর্যায়ে মোট ৮৫৪ কিলোমিটার সীমান্ত বরাবর কাঁটাতারের বেড়া ইতিমধ্যেই নির্মাণ করা হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে, মোট ২৫০২ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ১,৯৩০ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। যেহেতু ভারত প্রকৃত আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে ন্যূনতম ১৫০ মিটার নিজ ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে, সেহেতু এই কাঁটাতারের বেড়া এবং প্রকৃত আন্তর্জাতিক সীমানার (জিরো লাইন) মধ্যবর্তী অঞ্চলে দুর্ভাগ্যবশত যাঁদের বাসগৃহ পড়ে গিয়েছে, তাঁরাই কিন্তু ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আবার বিভাজিত হয়ে পড়েছেন। কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে মধ্যে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের ব্যবধানে লোহার দরজা করা আছে যা প্রয়োজনের তাগিদে নয়, শুধুমাত্র নিয়মের নির্দেশে খোলা বন্ধ হয়। সূর্যালোক থাকাকালীন কয়েক দফায় এই লৌহকপাট খুলে দেওয়া হয়। প্রহরারত বিএসএফ জওয়ানদের কাছে ভোটার কার্ড জমা রেখে এবং বিএসএফ-এর লগ বুকে সই করে বা টিপসই দিয়ে তবেই কাঁটাতারের ও পারের ভারতীয়দের মূল ভারত ভূখণ্ডে প্রবেশাধিকার মেলে। নিয়তির অদ্ভুত পরিহাসে খাঁটি দেশি সহ নাগরিকদের নিজভূমে পদার্পণ করার জন্যেও প্রতিনিয়ত তথ্যপ্রমাণ দাখিল করাটা যেন পাসপোর্ট-ভিসারই বিকল্প অনুকৃতি!

ভারত সরকারের দেওয়া ভোটার কার্ড, আধার কার্ড এবং রেশন কার্ড ওঁদের সকলের কাছেই আছে। এই কার্ডগুলোই যে ওঁদের কাঁটাতারের নিরাপত্তায় ঘেরা ভারতের মাটি ছোঁয়ার ‘এন্ট্রি পাস’! ওঁরাও ভারতবর্ষের নির্বাচকমণ্ডলীর একটি অংশ। তবু ওঁদের কাছে ভারত বলতে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত। তার পরেই ভূভারতের লৌহকপাট পরদিনের সূর্যোদয় পর্যন্ত বন্ধ থাকে মূল ভারতভূমির নিরাপত্তার খাতিরে। ওই লৌহকপাট বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবীর সব আলো ওঁদের জীবন থেকে নিভে যায়। ওঁদের স্বাদ-আহ্লাদ, অসুখ-বিসুখ, হাহাকার-আর্তনাদ, সবই আটকে থাকে ওই লৌহ ফাটকের ওপারে। ওঁদের রাগ-অভিমান, দুঃখ-যন্ত্রণা পাক খেতে থাকে বাপ-ঠাকুর্দার চরণধূলিতে লালিত ওপারের বাস্তুভিটের গোবর নিকানো উঠোনময়। রাতগভীরে প্রসূতির তীব্র গর্ভযন্ত্রণা অথবা কারও হৃৎযন্ত্র বিকলের অসহ্য বেদনার তাগিদে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসার প্রয়োজনেও লৌহকপাট খোলা যাবে কি না তা নির্ভর করে প্রহরারত বিএসএফ জওয়ানদের দাক্ষিণ্যের উপরে। আর সেই অসহায় আর্তনাদের আকুতিতে শিউরে ওঠে ঘরের চালে পাতা অসহায় লাউ পাতারাও।

সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশ সুরক্ষার নামে খরচ করতে কার্পণ্য না করলেও, কার্পণ্যের পাহাড় যেন মাথা উঁচু করে আটকে রাখে এই হতভাগ্য সহনাগরিকদের ভারতের মূল ভূখণ্ডে পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত। যাঁরা অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা স্বাবলম্বী, তাঁরা নিতান্ত বাধ্য হয়েই কাঁটাতারের ওপারের ভিটেমাটি বসতবাড়ি পরিত্যাগ করে মূল ভারত ভূখণ্ডে জমি কিনে নিশ্চিন্ত রাত্রিবাসের ঠাঁই বানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু যাঁদের সেই সামর্থ্যও নেই তাঁরা এখনও প্রতিটি রাত্রি যাপন করেন অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠার ধিকিধিকি আগুন বুকে জ্বেলে। প্রতি বারের মতো এ বারেও ওঁরা ভোট দিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচিত সরকার কাদের জন্যে? এই মানুষগুলো যাঁদের নির্বাচিত করার উদ্দেশে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের কানে কি আদৌ পৌঁছবে ওঁদের এই নিদারুণ অসহায়তার করুণ উপাখ্যান! নির্বাসিত এই মানুষগুলোকে পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার অধিকার পাইয়ে দেওয়া কি নির্বাচিত সরকারের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না? শুধুই প্রতীক্ষাকে সম্বল করে অহর্নিশ বসে থাকেন ওঁরা। কোনও এক ঝলমলে সকালে সকল অবহেলার গ্লানির অন্ধকার মুছে ফেলে কৃষ্ণচূড়ার আগুন ফুঁড়ে উঁকি মারবে নতুন দিনের গোলাপি সূর্য। কোন এক অদৃশ্যশক্তি এসে বিভাজনের সকল সীমানা উৎপাটিত করে মিলিয়ে দেবে পূর্ণ ভারতবর্ষকে। যে স্বভূমি স্পর্শ করতে তাঁদের আর কোনও তথ্য-প্রমাণ নিত্যদিন হাজির করতে হবে না। যে নিজভূমের সকল দুয়ার তাঁদের জন্য সকল সময় উন্মুক্ত হয়ে থাকবে। ভাগ্যের করুণ পরিহাসে দেশের সীমান্তরক্ষার প্রাচীরের বাইরে নির্বাসিত এই মানুষগুলোর কথা ভেবে কবে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেবে কোনও সংবেদনশীল নির্বাচিত সরকার! শীর্ণকায়া মাথাভাঙা নদীর তিরতিরে স্রোত দুলতে থাকে অভিমানী হাওয়ার ইশারায়। জীর্ণ টালির চাল বেয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে বোবা কুমড়ো ফুল। মুগ্ধ প্রজাপতি সরে গেলে কাঁটাতারের ওপারের নির্বাসিত চরাচরে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। ঘুটঘুটে অন্ধকার এসে গিলে খায় এই হতভাগ্য নির্বাসিতদের ইহকাল, পরকাল।

শিক্ষক, বেলডাঙা এসআর ফতেপুরিয়া কলেজ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE