Advertisement
E-Paper

রামের সুমতি হোক, সব রামের

রাম, গোমাতা, বারাণসী, গঙ্গা, প্রাণায়াম... এই শব্দগুলো কিছু দিন যাবৎ বড্ড বেশি ব্যবহার হচ্ছে। যত বেশি ব্যবহার হচ্ছে, তত বেশি বেঁকেচুরে যাচ্ছে।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০

রাম, গোমাতা, বারাণসী, গঙ্গা, প্রাণায়াম... এই শব্দগুলো কিছু দিন যাবৎ বড্ড বেশি ব্যবহার হচ্ছে। যত বেশি ব্যবহার হচ্ছে, তত বেশি বেঁকেচুরে যাচ্ছে। যে কোনও শব্দই, আমরা জানি, শুধু বিমূর্ত বর্ণসমাহার নয়। এক একটা শব্দ মানে এক একটা প্রতীক। বলা উচিত প্রতীকের সমাহার। গঙ্গা মানে গঙ্গাই নিশ্চয়। কিন্তু কারও কাছে গঙ্গা মানে হাওড়া ব্রিজ, কারও কাছে বাগবাজার ঘাট। গেরুয়া মানে কারও কাছে ত্যাগ, কারও মনে বাসনার রং... রং দে তু মোহে গেরুয়া... শব্দ এখানে যতটা সর্বজনিক, ততটাই ব্যক্তিগত।

কিন্তু সেই শব্দই যখন রাজনীতির ঘুঁটি হয়ে যায়, তখন শব্দের শরীর থেকে এই নিজস্বতার, ব্যক্তিগততার আভরণ খসে পড়ে, খসিয়ে দেওয়া হয়। রাজনীতির রাজসূয়তে শব্দেরা তখন রোরুদ্যমানা জানকী। সমস্ত অলঙ্কার যাঁকে ফেলে ছড়িয়ে দিতে হয়েছে পথে।

এমনই কিছু অলঙ্কার সযত্নে কুড়িয়ে নিয়েছেন শুভাশিস ভুটিয়ানি। অন্তত তাঁর কাজ দেখে এমনটাই মনে করতে ইচ্ছে করল। পঁচিশ বছরের এই যুবক ‘মুক্তি ভবন’ নামে একটি ছবি বানিয়েছেন। (ছবিতে একটি দৃশ্য) সেখানে এক অতি নিষ্ঠাবান বৃদ্ধ হঠাৎ অনুভব করেন, মহাকালের ডাক এসে গিয়েছে। তিনি সব রকম রীতি রেওয়াজ মেনে ব্রাহ্মণকে গোদান করেন। গোমাতার অনিচ্ছুক খুরে প্রণাম নিবেদন করে কাশী চলে যান। এখন থেকে তাঁর ঠিকানা হবে হোটেল মুক্তি ভবনের একটি খুপরি। এ হোটেল মৃত্যুপথযাত্রীদের জন্য। দিনভর রামের ভজন, স্বপাক আহার আর গঙ্গার দিকে চেয়ে চেয়ে মুক্তির অপেক্ষা করা। কাশীর ঘাটে পুড়লে মোক্ষ নিশ্চিত। হোটেলের ম্যানেজার নিজেও টিকিধারী ব্রাহ্মণ, কপালে সিঁদুর তিলক, যিনি বৃদ্ধের ছেলেকে বুঝিয়ে বলেন, মৃত্যু একটি প্রক্রিয়া। এখানে সবাই সেই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে আসে, নিজেদের প্রস্তুত করতে আসে। কার ক’দিন লাগবে, সেটা তিনি দেখে বুঝতে পারেন। কিন্তু বলেন না। বললে এই অনুধাবনী শক্তি তাঁকে ছেড়ে চলে যাবে।

হিন্দুয়ানির যে সব আকর নিয়ে এত আস্ফালন চার পাশে, এ ছবিতে তার সব কিছুই উপস্থিত। খুব বেশি করে উপস্থিত। কিন্তু তার কোনওটিই হিন্দুত্ববাদের তল্পিবাহক নয়। বরং একটা স্মিত হাসি মাখা ঠাট্টা লেগে আছে গায়ে। ছবিটা কাশী-মাহাত্ম্যের লিফলেট নয়, অলডাস হাক্সলিসুলভ ব্যঙ্গের কশাঘাতও নয়। এখানে স্মিত হাসিমাখা যে ঠাট্টাটুকু আছে, তা স্নেহ, কারুণ্য আর মায়ায় মোড়া। তার নিশানা কোনও ব্যক্তি নয়, কোনও বিশ্বাস নয়। জীবন নিজেই সেখানে এক মহৎ ঠাট্টা। দেখতে দেখতে মনে হয়, এই মায়াময় ঠাট্টাটুকু যাপনে ধরে রাখা কি খুব কঠিন?

অনিবার্য প্রশ্ন ধেয়ে আসবে, এটা কি ঠাট্টাতামাশার সময়? নয় তো। নয় বলেই কি আরও বেশি দরকার নেই একটু হিরণ্ময় নীরবতার? একটু মায়াময়তার? চতুর্দিকে এত শব্দের বিস্ফোরণ, এত রাগত উচ্চারণ, এত অধৈর্য প্রতিক্রিয়া, এত হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা, এত ফেসবুক পোস্ট— কী অমৃত ফলাবে? সকলেই তো কিছু খঞ্জ, ন্যুব্জ শব্দের কারাগারে বন্দি। জমির মতো শব্দও অধিগ্রহণ হয়ে যাচ্ছে অবিরত। রাম, গঙ্গা, বারাণসী, গরু... এ সবই নিজেদের সম্পত্তি ভাবতে শুরু করেছেন অনেকে। আবার তাঁদের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যাঁরা এ সব কিছুকেই অচ্ছুত বলে মনে করছেন, তাঁরা আসলে সেই পাতা ফাঁদেই পা দিচ্ছেন। তার চেয়েও বেশি অবাক লাগে দেখে যে, উগ্রতার রাজনীতি যাঁদের ঘোষিত অবস্থান, তাঁদের প্রতিস্পর্ধী যাঁরা, তাঁদের উগ্রতাও একই রকম গগনচুম্বী। এঁরা যদি রামনাম আর গরুবাছুরের ঠিকাদারি নিয়ে থাকেন, অপর পক্ষ মনে করছেন এ বিশ্বের যাবতীয় সঠিকতা তাঁদের পকেটস্থ। আফিমখোর জনতাকে অবজ্ঞা ছাড়া তাঁদের আর কিছুই দেওয়ার নেই।

অথচ প্রতিবাদী স্বরেরই তো দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি সংযত, ধীরস্থির হওয়ার। এক উগ্রতাকে আটকাতে গিয়ে আর এক উগ্রতার জন্ম না দেওয়ার। সুস্থ ভাবে প্রতিবাদ করতে শেখা এবং প্রতিপক্ষের উগ্রস্বরের সামনে সুষ্ঠু ভাবে দাঁড়াতে শেখাও একটি প্রক্রিয়া। আমরা বোধ হয় তার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারিনি। আমাদের বৈঠকখানা থেকে চণ্ডীমণ্ডপ, জনসভা থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, সবই তাই শেষ পর্যন্ত কলতলায় পরিণত হয়।

যে কোনও মুক্তি ভবনেই আসন সীমিত। তবু রামের সুমতি হোক। রাম মানে কোনও দল নয়, কোনও সম্প্রদায় নয়। যাদের সুমতি দরকার, তারা সকলেই রাম।

Hinduism property
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy