Advertisement
০৫ মে ২০২৪

জ়াকারবার্গের কাজটা কঠিন

প্রতিটি সম্ভাব্য ক্রেতার জন্য একেবারে মাপমতো বিজ্ঞাপন বানাতে চান যাঁরা, রাজনৈতিক বার্তাকে যাঁরা সম্ভাব্য সমর্থকের মনের সঙ্গে নিখুঁত ভাবে মিলিয়ে পৌঁছে দিতে চান তাঁদের কাছে, তাঁদের জন্য ফেসবুকে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য অতি মূল্যবান।

ভাস্কর চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৪৪
Share: Save:

ক্ষমা চেয়ে কূল পাচ্ছেন না মার্ক জ়াকারবার্গ। কিছু দিন আগেই জানা গেল, পাঁচ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য গ্লোবাল সায়েন্স রিসার্চ নামে একটি গোলমেলে গবেষক সংস্থার হাত ঘুরে পৌঁছেছিল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার হাতে। জ়াকারবার্গ জানিয়েছেন, ফেসবুক তার ভুলত্রুটি শুধরে নেবে।

কথাটা বলা যত সহজ, কাজটা ঠিক ততই কঠিন। প্রতি মাসে ২০০ কোটি মানুষ ফেসবুকে লগ ইন করেন। এঁরা তো সবাই এক রকম নন। দেশ, সমাজ অনুসারে আলাদা। কতখানি, বোঝার জন্য ফেসবুকের দুটো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজারের কথা বলি। প্রথমটা ভারত, যে দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দুনিয়ায় সর্বাধিক। দ্বিতীয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফেসবুকের ‘ঘরের বাজার’। আরও দুই বড় বাজার ব্রাজিল আর ইন্দোনেশিয়া। ভেবে দেখুন, এই বহুবিস্তৃত বাজারে, যেখানে দেশের গণ্ডি টপকালেই বদলে যায় সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত আর বাস্তব, যেখানে ডিজিটাল বিশ্বাসের মাত্রা এক দেশের থেকে অন্য দেশে খুব আলাদা, সেই বাজারে ফেসবুকের ভুল শুধরে নেওয়ার কাজটা কতখানি কঠিন। আমি তো বলি, জ়াকারবার্গের ফের হার্ভার্ডে ফিরে যাওয়া ভাল, সেখানে ‘ডিজিটাল নৃতত্ত্বের’ কোর্স না করলে এই খেলায় কলকে পাওয়া মুশকিল।

প্রতিটি সম্ভাব্য ক্রেতার জন্য একেবারে মাপমতো বিজ্ঞাপন বানাতে চান যাঁরা, রাজনৈতিক বার্তাকে যাঁরা সম্ভাব্য সমর্থকের মনের সঙ্গে নিখুঁত ভাবে মিলিয়ে পৌঁছে দিতে চান তাঁদের কাছে, তাঁদের জন্য ফেসবুকে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য অতি মূল্যবান। গত বছর এই তথ্যই ফেসবুককে চার হাজার কোটি ডলার রাজস্ব এনে দিয়েছিল। কাজেই, তাকে ব্যবহার করার লোভ সামলানোও তো কঠিন। কিন্তু, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাণ্ড, অথবা ‘ফেক নিউজ’-এর দৌরাত্ম্য থেকে একটা অন্য কথাও বোঝা যায়— ব্যবসার এই টানে বিপথে চলে যাওয়াও বড় সহজ। ফেসবুককে ঠিক কোথায় টানতে হবে লক্ষ্মণরেখা? তথ্যের ক্ষেত্রে কতখানি গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে, তা স্থির হবে কোন বাজারের নিয়ম অনুসারে? ব্যবসার দিকটাকে বজায় রেখেও কী ভাবে ক্রেতাদের তথ্যের অপব্যবহার রোখা যায়? এই প্রশ্নগুলো সোজা নয়। সব বাজারে একই নিয়ম মেনে চললে ব্যবসা থমকে যেতে পারে। এবং, তথ্যের গোপনীয়তা সম্বন্ধে মানুষের প্রত্যাশা, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা খবরে মানুষের বিশ্বাস, অনলাইন দুনিয়ায় বিপাকে পড়ার সম্ভাবনাও এক এক দেশে এক এক রকম। সেগুলো মাথায় রেখেই নীতি স্থির করতে হবে।

পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষা অনুযায়ী, মাত্র ১১% মার্কিন নাগরিক বিশ্বাস করেন যে সোশ্যাল মিডিয়া বা ডিজিটাল ভিডিয়ো সাইটগুলো তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করতে সক্ষম। ফ্লেচার স্কুলের ডিজিটাল প্ল্যানেট রিসার্চ-এর গবেষণায় আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ডিজিটাল ট্রাস্টে ঘাটতি থাকা দেশের দলে রেখেছি। অনলাইন দুনিয়াকে সত্যিই যতখানি বিশ্বাস করা চলে, এই দেশগুলোর নাগরিকরা তার চেয়ে কম বিশ্বাস করেন। আবার, ফেসবুকের প্রথম দশটি বাজারের মধ্যে থাকা এশিয়ার দেশগুলোতে— ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড এবং তুরস্কে— ডিজিটাল ট্রাস্ট উদ্বৃত্ত। অর্থাৎ, সত্যিই যতটা বিশ্বাস করা যায়, মানুষ অনলাইন দুনিয়াকে বিশ্বাস করেন তার বেশি। তাঁরা তথ্য ফাঁসের ঘটনায় অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষমাশীল হবেন।

ফেসবুকে প্রতিনিয়ত যত ‘খবর’ আসে, তার সত্যতার দায়িত্ব কি ফেসবুককে নিতে বলা যায়? গেলে, কত দূর? সব দেশের জন্য সমান নিয়ম করলে ফেসবুকের পক্ষে তা মেনে নেওয়া মুশকিল, কারণ এক এক দেশের মানুষ খবরের জন্য এক এক গোত্রের সূত্রের ওপর নির্ভর করেন। আর্থসামাজিক অবস্থানের ওপরও নির্ভর করে। যেমন, ২০১৭ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে ২০ শতাংশেরও কম মানুষ খবরের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভর করেন। আবার ব্রাজিল, তুরস্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভিয়েতনামের মতো দেশে অনুপাতটি ৪০% বা তার চেয়েও বেশি। অর্থাৎ, দ্বিতীয় গোত্রের দেশগুলিতে ফেক নিউজের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

যে দেশগুলো এত দিন ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপারে পিছিয়ে ছিল, কিন্তু এখন দ্রুত এগিয়ে আসছে, আমাদের গবেষণা বলছে, সেখানে মানুষ তুলনায় অনলাইন দুনিয়াকে বেশি বিশ্বাস করেন। ভারত-সহ এ রকম বেশ কয়েকটি দেশে ফেসবুকের বাজার বৃদ্ধির সম্ভাবনা বিপুল। এই দেশগুলিতে মানুষ মূলত মোবাইল ফোনের সাহায্যেই ডিজিটাল দুনিয়ায় বিচরণ করেন, এবং এখানে জনসংখ্যা বিপুল— ফেসবুকের মতো সংস্থা, যার ব্যবসা বিজ্ঞাপন নির্ভর, তার জন্য এই দেশগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ। ফেসবুকের ফ্রি বেসিকস ইন্টারনেটের জন্য ভারত দরজা খোলেনি। কিন্তু, ৬৩টি উন্নয়নশীল দেশ ও পুরসভায় ফ্রি বেসিকস চলছে, এবং প্রতিটিতেই নাগরিকরা ডিজিটাল দুনিয়ায় নবাগত। তাঁদের ঠকিয়ে নেওয়াও সহজ। এই বাজারগুলো থেকে যথাসম্ভব রাজস্ব তুলে নেওয়ার জন্য এখানে তথ্যের নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিয়ম যতখানি শিথিল রাখা যায়, ফেসবুকের পক্ষে ততটা চাওয়াই স্বাভাবিক।

জ়াকারবার্গ মোক্ষম শাঁখের করাতে পড়েছেন। কড়াকড়ির মাত্রা কম রাখলে আরও অনেক কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা। আবার, কড়াকড়ি বাড়ালে ফেসবুকের ব্যবসাই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে, কারণ কী ভাবে তথ্য ব্যবহার করা যাবে, তার কড়াকড়ি মানেই রাজস্বের পরিমাণ কমে যাওয়া। কাজেই, কোন বাজারের জন্য কতখানি কড়া নিয়ম প্রয়োজন, জ়াকারবার্গকে তা বাজারের ডিজিটাল বিশ্বাসের পরিমাণ ও ডিজিটাল দুনিয়ায় সাবলীলতার পরিমাণ হিসাব কষে বার করতে হবে। কাজটা অসম্ভব কঠিন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টাফ্‌ট্‌স ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুলে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যান্ড ফিনান্স-এর অ্যাসোসিয়েট ডিন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mark Zuckerberg Facebook Cambridge Analytica
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE