Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

মোদীর পাক নীতির দোলাচল গো়ড়া থেকেই

বোঝাই যায়, তাঁর পাকিস্তান-নীতি দিশাহীন। কিন্তু আসল প্রশ্ন সেটা নয়। আসল প্রশ্ন: ভারতের পক্ষে কি আদৌ কোনও যুক্তিপূর্ণ ও কার্যকর পাকিস্তান-নীতি গ্রহণ করা সম্ভব?কাশ্মীর সীমান্তে দুই দেশের সংঘর্ষ, প্রাণহানি চলছেই। সীমান্তে প্রহরারত দু’দেশের সেনার মধ্যে সৌজন্যের যে সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, এ বারের ইদে দেখা গেল তারও ব্যতিক্রম। ভারত-পাক সম্পর্কের জটিলতা নতুন ঘটনা না হলেও দুই দেশের এতখানি শৈত্য আমাদের কতগুলো কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

কণ্টকাকীর্ণ। সীমান্তে সৌজন্য প্রদর্শন, রামগড়, জম্মু, ২৩ জুলাই। ছবি: পিটিআই

কণ্টকাকীর্ণ। সীমান্তে সৌজন্য প্রদর্শন, রামগড়, জম্মু, ২৩ জুলাই। ছবি: পিটিআই

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

কাশ্মীর সীমান্তে দুই দেশের সংঘর্ষ, প্রাণহানি চলছেই। সীমান্তে প্রহরারত দু’দেশের সেনার মধ্যে সৌজন্যের যে সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, এ বারের ইদে দেখা গেল তারও ব্যতিক্রম। ভারত-পাক সম্পর্কের জটিলতা নতুন ঘটনা না হলেও দুই দেশের এতখানি শৈত্য আমাদের কতগুলো কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রশ্নগুলো সত্যিই কঠিন, কেননা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কিন্তু ইতিমধ্যে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যার তুলনায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে তিনি অনেক বেশি সক্রিয়। তাঁর বিদেশনীতি অনেক বেশি সচল। কিন্তু এই বিদেশনীতি নিয়েও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে সাফল্য আসছে না।
একটা কথা ঠিক। উপমহাদেশের বড় ছবিটাকে উপেক্ষা করে এই সম্পর্কে কোনও পরিবর্তন সম্ভব নয়। ভারতের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই উপমহাদেশীয় রাজনীতি, যার মধ্যে অন্যতম প্রধান পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সম্পর্ক। চিনের ভূমিকাও বিরাট। তবে চিন-ভারত দ্বৈরথের চরিত্রটা এমন যাতে উন্নত কূটনীতির মধ্য দিয়ে অনেক সমস্যার সমাধানই সম্ভব। ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের চরিত্র কিন্তু আলাদা। পাকিস্তানের প্রতি ভারতের মনোভাব কী হলে ভাল হয়, কোন পথে এগোলে লাভ, তার দিশা পাওয়াই কঠিন।
প্রধানমন্ত্রী মোদী এখনও কোনও সুসংহত পাকিস্তান-নীতি রচনা করতে পারেননি। অতীতে তিনি ইউপিএ সরকারের নীতিকে দুর্বল বলে কঠোর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু নিজে ক্ষমতায় আসার পর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে সাদর আমন্ত্রণ জানাতে ভোলেননি। প্রথম দিন থেকেই তাঁর দোলাচল। দুই দেশের শান্তি আলোচনা শুরুর কথা বলে অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর সরকার তা থেকে সরে আসে। কারণ— কিংবা অছিলা ছিল এই যে, ভারতে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত গোষ্ঠীর নেতাদের আমন্ত্রণ করেছিলেন। এ দিকে পাকিস্তানের সঙ্গে কথোপকথন পুরো বন্ধ হলে দেশের জাতীয় স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাই মার্চ ২০১৫ থেকে আবার সচিব-পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়। শাংহাই কর্পোরেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনের আগে মোদী ও শরিফকে আলাদা বৈঠক করতেও দেখা যায়। মোদী পাকিস্তান সফরের নিমন্ত্রণ স্বীকার করেন। তার পর আবার গোলমাল। দু’দেশের সীমানা বরাবর সামরিক সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় ভারত-পাক সম্পর্ক আবার ধাক্কা খায়। সন্দেহ শুরু হয় যে, পাকিস্তানে যেহেতু এখন নওয়াজ শরিফ সরকার ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য ক্রমশ সেনাবাহিনীর পক্ষে ঝুঁকছে, আলোচনায় লাভ হবে না।

ইউপিএ সরকার কাশ্মীরকে ভারত-পাক আলোচনার কেন্দ্র হিসেবে দেখেছিল, বিচ্ছিন্নতাকামী হুরিয়তকে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল। অনেকেই মনে করেন, এই নীতিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি অবহেলিত হয়। হুরিয়তের অন্তর্ভুক্তি দুই দেশের প্রেক্ষিতে বিচ্ছিন্নতাকামীদের ভূমিকা স্বীকার করে নেয়, ভারতের অখণ্ড জাতীয়তাবাদের আদর্শকেও প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়। কাশ্মীরি সাধারণের মনে হতে শুরু করে, তাদের সমস্যা সমাধানে বহিঃরাষ্ট্রের ভূমিকাটি সত্যিই গ্রহণযোগ্য।

মোদী সরকার প্রথম থেকেই এই নীতি থেকে সরে ‘টিট ফর ট্যাট’ নীতি নিয়ে চলতে চেয়েছে। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্যের মাধ্যমে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তাকে ব্যাহত করছে, আবার বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তিদের সরাসরি মদত দিয়ে ভারতের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। অতএব, এই সরকার চায়— এক, কাশ্মীর সমস্যাকে ত্রিপাক্ষিকের বদলে দ্বিপাক্ষিক রূপে দেখতে। দুই, যথেষ্ট অনুকূল পরিবেশ না থাকলে আলোচনার রাজনীতিতে না জড়াতে।

মোদীর পাকিস্তান নীতি আসলে একটি একান্ত ‘রাষ্ট্রীয়’ উপাখ্যান। এই ভাষ্য অনুযায়ী, শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ার শর্ত, তার অভ্যন্তরের সমস্ত সমস্যাকে সার্বভৌমত্বের নিরিখে বিচার করা। যে ভাষ্য এ ভাবে দেখে, তার চিন্তাক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি বিষয় সম্পূর্ণ অবান্তর। বিচ্ছিন্নতাবাদের ইতিহাস বা যুক্তি-আবেগ তার আলোচনার পরিধির বাইরে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রশ্ন অবান্তর। ঠিক এ ভাবেই চিন তার তিব্বত সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। মোদীর ভারতও এই ভাবেই কাশ্মীর সমস্যা নিরসন করতে চায়। ইতিহাস বা রাজনীতির গতিপথকে অগ্রাহ্য করে, কেবলমাত্র রাষ্ট্রের সামরিক নিরাপত্তার হিসেবে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে চায়। চিনকেই ‘মডেল’ করে মোদী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা ভেস্তে দেয়, কাশ্মীরে ভারতের সার্বভৌমত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে, ত্রিপাক্ষিকতা থেকে দ্বিপাক্ষিকতায় ফিরে আসে। স্পষ্ট করে বলে দেয়, আলাপ-আলোচনা সক্রিয় রাখতে হলে ‘পড়শি’কেই দায়িত্বশীল ব্যবহার করে তার অধিকার প্রমাণ করতে হবে।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোকে ‘ব্যবহার’ করার পদ্ধতিও এই মডেলে জরুরি। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও বিদেশমন্ত্রী মনোহর পরিক্কররা মনে করেন সিন্ধু ও বালুচিস্তান প্রদেশে পাক সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীদের মদত দেওয়াই কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাকামীদের পাক সমর্থনের পাল্টা জবাবি নীতি। এই মডেলের সমস্যা আছে। পাকিস্তানের বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীদের এ ভাবে বাইরে থেকে সাহায্য করলে তা ভারতের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাকেও শেষ পর্যন্ত দুর্বল করে। তা ছাড়া, এই নীতি রাষ্ট্রের সত্তার প্রশ্নটি সঙ্গেও ওতপ্রোত জড়িত। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে দীর্ঘকাল এই নীতি সক্রিয় রাখলে তার মাধ্যমে দেশের সমাজ তথা রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ও সামরিক শক্তির আদর্শ ভারসাম্যটি বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা। সব মিলিয়ে, ভারতের পক্ষে পাকিস্তানে এ ভাবে প্রচ্ছন্ন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন।

সবচেয়ে বড় কথা, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের কি উন্নতি ঘটাতে পারবে মোদী-নীতি? সন্দেহ আছে। প্রথমত, দিল্লির অনমনীয়তা কাশ্মীর সমস্যাকে আরও জটিল ও বিপজ্জনক করে তুলবে। কাশ্মীরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যত দুর্বল হবে, ভারতের প্রতি সেখানকার মানুষের বিশ্বাসও তত কমবে। কাশ্মীরে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৈরির সংকট বহু-আলোচিত বিষয়। রাষ্ট্র চাইলেই সেখানে রাতারাতি পছন্দের রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে পারে না। মানুষের ইতিহাস, সমাজবোধ ও দৈনন্দিন প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করে কোনও রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে না। অথচ মোদী সরকারের আপাত-বলিষ্ঠ কাশ্মীর-পাকিস্তান ভাষ্যে এই সমস্যার কোনও স্বীকৃতি নেই। দ্বিতীয়ত, ভারতের ভাষা ও মনোভাব যত আগ্রাসী বা রূঢ় হবে, পাকিস্তানে ভারত-বিরোধিতাও শক্তিশালী হবে। পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত শেষ পর্যন্ত খুব ক়ড়া পদক্ষেপ করতে পারবে বলে মনে হয় না। কেবল ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত-সংঘর্ষ আরও ব্যাপকতর, রক্তাক্ত হবে। এই পরিস্থিতি এড়াতে হলে আলাপ-আলোচনার পথ খোলা রাখা ছাড়া উপায় নেই। মোদীর অতি-বলিষ্ঠ পাকিস্তান-নীতি সে কাজ করতে পারবে বলে মনে হয় না।

পাকিস্তানের নিজের অবস্থাও উদ্বেগজনক। তালিবানের উত্থান, ধর্মীয় মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের আগ্রাসন, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ঝড়-ঝাপটায় সে বিপর্যস্ত। একই উপমহাদেশের অংশ হয়েও কেন ভারত ও পাকিস্তানে দু’ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। এক দিকে মায়া টিউডর মনে করেছেন যে, এই বৈপরীত্য দু’টি ভিন্নধর্মী জাতীয়তাবাদী প্রতিকল্পের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি। অন্য দিকে, আয়েশা জালাল বলছেন, ভারতের ভিত্তি ও বৈরিতাই পাকিস্তানের রাজনীতিকে বিকৃতির দিকে ঠেলেছে। কারণ যা-ই হোক, পাকিস্তান আজ অস্তিত্বের সংকটে ধ্বস্ত রাষ্ট্র। ভারত বিরোধিতা ছাড়া অন্য কোনও সদর্থক আত্মপরিচিতি-সন্ধানের সৎ সাহস বা কল্পনা সে দেশে নেই। আমেরিকা ও চিনের ওপর নির্ভর করেই তার আর্থ-সামাজিক দিনযাপন। সেই জন্যও ভারতের সঙ্গে শত্রুতায় সুবিধে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রসত্তার ঝাঁঝ আপনা থেকেই অনেকটা কমে যাবে। যে রাষ্ট্র জাতিসত্তা নির্মাণে অপারগ, সে কি এই ঝুঁকি নিতে পারে?

মোদ্দা কথা, ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত শুধু কাশ্মীর-সমস্যা বা পারমাণবিক অস্ত্র-প্রতিযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। দুই দেশের মধ্যে একটা গভীরতর দ্বন্দ্ব কাজ করে, যার সমাধান অজানা। সফল বিদেশনীতির প্রাথমিক শর্ত: অন্য দেশকে বোঝা। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট ও আত্মপরিচিতির ঘাত-প্রতিঘাত এতই তীব্র যে সে দেশের চাহিদা বাইরে থেকে অনুধাবন করা অসম্ভব। তার উপর রয়েছে তার নিজের নিরাপত্তা-নির্ভর অর্থাৎ ভারত-বিরোধিতা-নির্ভর রাষ্ট্রীয় ভাষ্য তৈরির বাধ্যবাধকতা। ভারতের পক্ষেও গণতান্ত্রিক আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে একবগ্গা সামরিক নীতি গ্রহণ সম্ভব নয়। মোদীর পাকিস্তান-নীতি গোড়া থেকেই দিশাহীন। কিন্তু আসল প্রশ্ন সেটা নয়। আসল প্রশ্ন: ভারতের পক্ষে কি আদৌ কোনও যুক্তিপূর্ণ ও কার্যকর পাকিস্তান-নীতি গ্রহণ করা সম্ভব?

ইতিহাস বলে, রাষ্ট্র প্রয়োজনে নিজের পরিচিতি পাল্টাতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার বিবদমান দুই পড়শি কি একের মধ্যে অন্যের বৈধতাকে স্থান দিয়ে নিজেদের আত্ম-পরিচিতি খানিক হলেও পাল্টাতে পারবে? যদি পারে, তবেই একমাত্র সমাধানের আশা।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE