Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

স্পষ্ট দিশা দেখাতেই হবে মোদীকে

এটাও বাস্তব, মন্ত্রিসভার কোনও সদস্যের ক্ষমতা যেমন নেই, তেমন কোনও দায়ও নেই। সরকারের যাবতীয় দায় মূলত নরেন্দ্র মোদীরই। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালরাশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর চের্নোমিরদিন (Viktor Chernomyrdin) খুব রসিক মানুষ ছিলেন। নব্বুইয়ের দশকে তিনি এক সংবেদনশীল সময়ে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কমিউনিজম তখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, আর পুটিন ধীরে ধীরে নিজের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর কায়েম করতে শুরু করেছেন।

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

রাশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর চের্নোমিরদিন (Viktor Chernomyrdin) খুব রসিক মানুষ ছিলেন। নব্বুইয়ের দশকে তিনি এক সংবেদনশীল সময়ে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কমিউনিজম তখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, আর পুটিন ধীরে ধীরে নিজের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর কায়েম করতে শুরু করেছেন। তখন প্রচন্ড হতাশার মধ্যেও চের্নোমিরদিন রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘আমরা আরও ভাল করার অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু যা-ই করেছি তাই চিরাচরিত একঘেয়ে ঘটনায় পরিণত হয়েছে, যা এত দিন হয়ে এসেছে তারই পুনরাবৃত্তি হয়েছে।

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘আমরা প্রশাসনিক সাফল্য অর্জনের জন্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন নতুন সংস্থা তৈরি করেছিলাম। কিন্তু তার সবই শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি অফ সোভিয়েত ইউনিয়নে পরিণত হয়েছে।’’

আজ গোটা পৃথিবীতে তাই যে প্রশ্নটি সব চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে, সেটি হল দলীয় ইশতেহার থেকে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অথবা বিবৃতি যা-ই হোক, আসল হল, নীতি কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে? পাঁচ বছর পর যে-কে-সেই? বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট জিম্ ইয়ং কিম একটি নতুন শব্দ চালু করেছেন। সায়েন্স অফ ডেলিভারি। নতুন কথা কিছু নয়। কথামৃতে ঠাকুরের কথা, পাঁজি যতই নিংড়োও, জল কাগজ থেকে তো বেরোবে না। অতএব পাঁজি পড়ে কী হবে? গঙ্গাস্নান করতে গেলে কিন্তু গঙ্গায় যেতেই হবে।

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

দিল্লির মসনদে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের এক বছর হতে চলল। মনমোহন সিংহের দশ বছরের বিরুদ্ধে মানুষের হতাশা-বিরোধিতা নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি-কে বিপুল সংখ্যায় ক্ষমতায় আসীন করেছে। আমজনতার প্রত্যাশা গগনচুম্বী। নরেন্দ্র মোদী যেন এক সুপারম্যান বা অরণ্যদেব। এ বার ‘অচ্ছে দিন’ সত্যি সত্যিই আসবে।

কিন্তু, এক বছর অতিবাহিত হওয়ার মুখে গোটা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অভিমতে কিন্তু হতাশাই প্রকাশ পাচ্ছে। সমীক্ষা রিপোর্ট অন্তত তাই বলছে। তবে কি এক বছর যেতে না যেতেই উল্টোরথের প্রক্রিয়া শুরু?

বিজেপি-র সমর্থক নই। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে নরেন্দ্র মোদীকে চিনি প্রায় তিন দশক। অশোক রোডে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পিছনের ব্যারাকে তিনি যখন একটি ছোট্ট ঘরে থাকতেন, তখন থেকেই দেখছি তাঁকে। মানুষটার মধ্যে একটা একবগ্গা জেদ আছে। চিন্তার স্বচ্ছতা আছে। বিবিধ লক্ষ্যের মধ্যে সংশয়াচ্ছন্ন হওয়ার লোক তিনি নন, তাই ক্ষমতায় আসার পর তিনি নিজেও চাইবেন সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে। করতে পারলে তো তাঁরই লাভ। এ সরকারের ব্যর্থতার দায়ও কিন্তু তাই নরেন্দ্র মোদীরই।

চোখের সামনে দেখছি, নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে যেমন অতিকেন্দ্রিকতার অভিযোগ উঠেছে, ঠিক তেমন ভাবেই এটাও বাস্তব, মন্ত্রিসভার কোনও সদস্যের ক্ষমতাও যেমন নেই, তেমন কোনও দায়ও নেই। সরকারের যাবতীয় দায় মূলত নরেন্দ্র মোদীরই।

আসলে, এক বছর পরও শেয়ার বাজার সে ভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। উল্টে রিয়েল এস্টেট দৌরাত্ম্য দমনে রেগুলেটরি সংস্থা নির্মাণের চেষ্টায় সরকারের সমালোচনায় মুখর এই ব্যবসায়ীরা। এ সরকার সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে যে এ সরকার ধনীদের সরকার, গরিবের নয়। এ সরকার হল crony পুঁজিবাদের পক্ষে। বিশেষত, জমি বিল নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে প্রতিপক্ষ এই প্রচার চালাচ্ছে, কৃষক ও গরিব মানুষেরা না কি অনেকে সে কথা বিশ্বাসও করছে।

আর একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে মোদী ক্ষমতায় আসার পর যত না আর্থিক সংস্কার করছেন, তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত দেশের ভিতর উগ্র হিন্দুত্বকে মূলধন করে মেরুকরণের রাজনীতিতে। মোদী নিজে এ ব্যাপারে না বললেও অমিত শাহ এই কাজটি করছেন। আর অভিযোগ, অমিত শাহ আর নরেন্দ্র মোদী কি আলাদা? লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশে এই মেরুকরণের রাজনীতি রাজনৈতিক ফায়দা দিয়েছে বলে জেতার পর সেই কৌশল দিল্লি ভোটের সময়েও বিজেপি নিয়েছিল। কিন্তু দিল্লির নির্বাচনী বিপর্যয় আপাত ভাবে যতই কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে দেখানো হোক না কেন, আসলে এই বিপর্যয় কিন্তু এটাও শীর্ষ নেতৃত্বকে নীরবে জানিয়ে দিয়েছে যে, মোদী ঝড়ও দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ঘটনা হতে পারে না। নভেম্বর মাসে বিহার ভোট বা ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ ভোটের সময় পর্যন্ত এই মোদী ঝড় অটুট রাখা সম্ভব হবে কি না, সে-ও এক বড় প্রশ্ন।

মানুষ যখন ভোটার তখন তাদের অধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতাও থাকে অনেক বেশি। এই যে ধারণা যে, মোদী এসেছেন, অতএব মন্ত্রবলে এ দেশের ‘অচ্ছে দিন’ এসে যাবে এও এক মস্ত বড় সমস্যা।

সম্প্রতি বারাণসী গিয়েছিলাম। সেখানেও দেখলাম রিকশাচালক অথবা দোকানদার, সকলেরই প্রশ্ন, কোথায় অচ্ছে দিন? রাস্তাঘাট আবর্জনা-জঞ্জালে ভরা। পরিচ্ছন্নতা কোথায়? যদি বলি নরেন্দ্র মোদী কী করবেন? মানুষকেও তো পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে? সিঙ্গাপুরে কোনও মানুষ রাস্তায় থুতু ফেলেন? এ সব বলে লাভ নেই, আজকাল মনে হয় রাজনীতিতে সত্যের চেয়েও পার্সেপশন বা ধারণা হল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশাসনিকতার সাফল্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই যে ধারণা তৈরি হয়েছে এ সরকার অতি-কেন্দ্রিকরণের দোষে আক্রান্ত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলে একা তাঁর পক্ষে কি সব কিছুই দেখা সম্ভব? তবু একটা রাজ্য চালানোর ক্ষেত্রে যদি বা এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক অতি-কেন্দ্রিকতা কাজ করে, দেশ চালানোর ক্ষেত্রে কি তা সম্ভব? আর তাই রাজ্যপাল পদগুলি খালি। পশুপালন দফতরের যুগ্মসচিব কে হবেন, তার ফাইলও প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে হবে? এটা আসলে দায়িত্ব নিচুতলায় অর্পণ করার বিরুদ্ধে নয়? প্রধানমন্ত্রী ঘন ঘন বিদেশ যাচ্ছেন বলেও প্রতিপক্ষ বলতে শুরু করেছেন যে, তিনি এ যুগের নয়া ইবন বতুতা। কিন্তু বিদেশ নীতিতেই বা কী বিরাট সাফল্য এনেছেন নরেন্দ্র মোদী? পাকিস্তান নিয়েও বিদেশনীতির অভিমুখ নানা টানাপড়েনের শিকার।

মনে হয়, নরেন্দ্র মোদী সাম্প্রদায়িকতার তকমা থেকে নিজেকে মুক্ত করে যদি বহুত্ববাদী ভারতের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারেন, তবেই হয়তো রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তিনি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারেন।

২০০১ থেকে ২০০৫— এই সময়ে লন্ডনে টনি ব্লেয়ার যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তার বিশেষ উপদেষ্টা ছিলেন স্যর মিশেল বারবার (Michael Barber)। তিনি টনি ব্লেয়ারের উপদেষ্টা হিসেবে Ministers Deliver Unit (PMDU) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থা তৈরি করে তিনি Deliverology নামক একটি পরিভাষা তৈরি করেন। তিনি বলেন, শুধু ঘোষণা নয়, শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তবে এই কর্মসূচিগুলিকে বাস্তবায়িত করতে হবে। Michael Barber সম্প্রতি নিজে একটি বই লিখেছেন, যার নাম How to run a government। এই বইতেও তিনি দেখিয়েছেন, টনি ব্লেয়ারের দ্বিতীয় পর্বেও (২০০১-২০০৫) রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা রক্ষার জন্য বহু কঠিন সিদ্ধান্ত তাঁদের নিতে হয়েছে।

এই বইতে বলা হয়েছে, মার্কিন সমাজের নাগরিকদের সাধারণ ভাবেই একটা সরকার-বিরোধী মানসিকতা রয়েছে, যেন সরকার মানেই এক সমস্যা। বাজার যেন সব সময়েই সরকার-বিরোধী। এটা পরিণত পুঁজিবাদের একটা বৈশিষ্ট্য।

নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তার কথাটা অবশ্য চাঞ্চল্যকর কোনও নতুন ঘটনা নয়। এটাই রাজনীতিতে প্রকৃতির আইন। ’৮৪ সালের ‘মিস্টার ক্লিন’ রাজীব গাঁধী ’৮৯ সালে হয়ে ওঠেন বফর্স গাঁধী। ’৭১ সালের ইন্দিরা আর ’৭৫ সালের জরুরি অবস্থার ইন্দিরা একই ব্যক্তিত্ব নন। কলকাতাতেই তিন বছর আগের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ ২০১৫ সালে ঠিক এক রকম হতে পারেন না। এ এক ল অফ ডিমিনেশিং রেশিও। আবার এমনও নয়, নরেন্দ্র মোদী কিছুই করছেন না বা করতে চাইছেন না। তিনি নীতি পঙ্গুতা থেকে সরকারকে একটা জোর ঝাঁকুনি দিতে চাইছেন। কিন্তু আর্থিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কী লক্ষ্য, কী অভিমুখ নিয়ে এগোবেন, সে ব্যাপারে তাঁকে একটা স্পষ্ট দিশা দিতে হবে।

তিনি দক্ষিণপন্থী মার্কিনি রিপাবলিকান পার্টির নমুনা অনুসরণ করবেন না কি তিনি বামপন্থী সমাজতন্ত্রী হয়ে সনিয়া গাঁধীর ইউপিএ লাইন ধরেই এগোবেন- সেটা তো স্থির করতে হবে। ইহাও হয় উহাও হয় করলে মুশকিল। যদি মধ্যপন্থা অনুসরণ করে এগোতে চান তিনি, যদি রাজনৈতিক পপুলিজম কেই ভয় পান তিনি তবে তো সেই পুরনো কাসুন্দিই। নতুন সাহসিকতা কী হল?

রাজনৈতিক নেতা গোটা দুনিয়াতেই ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে রাজনৈতিক পপুলিজমকে পরিত্যাগ করতে পারে না। বিখ্যাত বিবিসি টিভি সিরিয়ালের এক দৃশ্যে ছিল ক্যাবিনেট সচিবকে দেশের অর্থসচিব বাজেটের আগে বলছেন, প্রধানমন্ত্রী অনেক বেশি ভর্তুকি দেওয়ার জনপ্রিয় লাইন নিতে চাইছেন। কিন্তু তাতে দেশের অর্থনীতির লাভ নেই। আপনি ক্যাবিনেট সচিব, রাজনৈতিক নেতাদের হাতে অথবা আমলারা চাইলেও বেশি লজেন্স, বেশি চকোলেট দিতে পারি না।

আমলারা মোদীকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, তাতেও আমার সন্দেহ। নরেন্দ্র মোদী সরকারকে নিজেকেই ঠিক করতে হবে, এই জনপ্রিয়তার লাইন কতটা নেবেন আর আর্থিক সংস্কার ও উন্নয়নের স্বার্থে কতটা তেতো ওষুধ গেলাবেন। বিজেপি একক ভাবে এ হেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম লাভ করেছে, তাই মোদীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা তাকে পিছন থেকে বার বার টেনে ধরছে।

এই টানাপড়েন থেকে মোদীকে বেরোতেই হবে!

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE