Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

আহম্মদের মা

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এক বিখ্যাত কবিতার মুখ্য নারী চরিত্র কবিরণ বিবি। বিদায় নিলেন সম্প্রতি। আমরা জানতে পারলাম না।কবিরণ বিবি প্রয়াত হলেন। নিরানব্বই বছর বয়সে এই প্রায়-অখ্যাত এক নারীর চলে যাওয়া কি আদৌ কোনও খবর? নয় বলেই তাঁর মৃত্যুসংবাদও তেমন কেউ রাখেনি। জীবিত থাকতেই যাঁকে চিনত না, জানত না অধিকাংশ মানুষ, তাঁর মৃত্যুসংবাদ জেনেই বা কী হবে! অথচ, জানার কথা ছিল। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজের ব্যঞ্জনহেড়িয়া গ্রামের এই ‘সামান্য’ নারীর সঙ্গে গভীর যোগ ছিল কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের।

পায়ে পায়ে। কবিরণ বিবি ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

পায়ে পায়ে। কবিরণ বিবি ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৫ ০০:০২
Share: Save:

কবিরণ বিবি প্রয়াত হলেন। নিরানব্বই বছর বয়সে এই প্রায়-অখ্যাত এক নারীর চলে যাওয়া কি আদৌ কোনও খবর? নয় বলেই তাঁর মৃত্যুসংবাদও তেমন কেউ রাখেনি। জীবিত থাকতেই যাঁকে চিনত না, জানত না অধিকাংশ মানুষ, তাঁর মৃত্যুসংবাদ জেনেই বা কী হবে! অথচ, জানার কথা ছিল। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজের ব্যঞ্জনহেড়িয়া গ্রামের এই ‘সামান্য’ নারীর সঙ্গে গভীর যোগ ছিল কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এক বিখ্যাত কবিতা ‘পায়ে পায়ে’-র মুখ্য নারী চরিত্র তিনি। কবিতায় ‘আহম্মদের মা’ হিসেবে পরিচিত কবিরণ বিবির একমাত্র পুত্র বাস্তবে আহম্মদই। তাঁদের বাড়ি জুড়ে ছবি, বই, লেখা, গল্পে এখনও চতুর্দিকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নানা অনুষঙ্গ।

কবিরণ কি শুধু কবিতা-নারী সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের? অতীত জানে, আরও অনেক কথা। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের সূচনায় সদ্য-বিবাহিত বিদেশ-ফেরত স্ত্রী গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে সুভাষবাবু এসে উঠেছিলেন এই ব্যঞ্জনহেড়িয়া গ্রামে। কমিউনিস্ট কবি-দম্পতির ওপর ভার ছিল বজবজের শ্রমিক বেল্টে মজবুত সংগঠন গড়ে তোলা। ব্যঞ্জনহেড়িয়া তখন গণ্ডগ্রাম। মহেশতলা ডাকঘর থেকে চড়িয়ালের পথে অনেকটা এগিয়ে বাঁ হাতে পেট্রোল পাম্পের পাশ বেয়ে কার্যত গড়িয়ে নেমেছে এ গ্রামের প্রবেশ পথ। অন্ধকার, কষাইখানা আর নানা জংলি গাছে ভরা সেই পথ খানিক এগিয়ে দু’ভাগ হয়ে গেছে। বাঁ-দিকেরটা মিশেছে এক এঁদো পুকুরের গায়ে, ডান দিকে ইদগাহ। এঁদো পুকুরের পাশে মাটির দেয়াল, টালির চাল, ৭৩ নম্বর সাবেক ফকির মোহম্মদ খান রোডের পৌনে দু’খানা ঘরে এসে উঠলেন কবি-দম্পতি। বাড়িওয়ালি ফতেজান বিবি। শহুরে মানুষ, কে মিশবে তাঁদের সঙ্গে? ব্যতিক্রম সাজ্জাদ আলি আর তাঁর যুবতী স্ত্রী কবিরণ। কবিরণের আন্তরিকতায় যেন প্রাণ পেলেন কবি-দম্পতি।

তাঁদের তখন অনেক কাজ। মজদুরদের মধ্যে সংগঠন বাড়াতে হবে। সকাল হলেই সুভাষ বেরিয়ে যান গেট-মিটিঙে। দুপুরে ফিরে আলোচনা চলে গীতার সঙ্গে। প্রায় নিরন্ন, অশিক্ষিত এলাকার মানুষগুলোকে প্রকৃত মানুষ করে তুলতে হবে। গীতা প্রস্তাব দেন স্কুল চালু করার। শ্রমিক-বধূরা সেখানে পড়বে। কিন্তু কোথায় খোলা যায় স্কুল! এগিয়ে আসেন সাজ্জাদ-কবিরণ। খুলে দেন বাড়ির উঠোন-দাওয়া। সেখানেই শুরু হয় গীতা দেবীর স্কুল: প্রতিভা পাঠশালা। এ স্কুলের প্রথম ছাত্রী কবিরণ, প্রথম সাক্ষরও তিনি। কবিরণই একে একে জড়ো করেন গ্রাম্য বধূ, মেয়েদের। নিখরচায় স্লেট, পেন্সিল, খাতা, পেন, বই পেয়ে ব্যঞ্জনহেড়িয়ার মেয়েরা ছুঁতে থাকেন নতুন আলো।

বছর চারেক আগে এক বৃষ্টিভেজা দুপুরে মুখোমুখি হয়েছিলাম এই কবিতা-নারীর। কবিরণ শুনিয়েছিলেন অনেক অতীত কথা। সে কথার সিংহভাগ জুড়ে তাঁর দাদা-দিদি, সুভাষ আর গীতা। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা কমিউনিস্টদের চিরকুট পেয়ে সংকেত দেওয়া স্থানে খাবার পাঠানো, আলতা দিয়ে পোস্টার লেখা, দারিদ্রের কামড়ে আধপেটে দিনের পর দিনে কাটিয়ে যাওয়া আর ইদের দিন পরোটা, মাংস, সিমাই সবেতেই কবি-দম্পতির আন্তরিক উপস্থিতি। ইদের সকাল থেকে তাঁদের রান্নাঘর হয়ে উঠত বারোয়ারি কিচেন। আসতেন দাদার অনেক বন্ধু। সারাক্ষণ রান্নাঘরের দরজায় প্রহরী দাদা সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর তপেন চট্টোপাধ্যায়।

কথা বলতে বলতে অবশ্য তখনই কবিরণের জিভ জড়িয়ে যেত মাঝে মাঝে। স্তব্ধ হয়ে যেত স্বর। মুখের ভেতর জিভটা শুধু ঘুরত, কথা তৈরি করতে পারত না। সত্তরোর্ধ্ব ছেলে আহম্মদ এগিয়ে আসতেন সাহায্যের জন্য, ‘মার কথা মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যায়। বছর দুয়েক হল এটা হয়েছে। তিন-চার এমনকী সাত দিনও এমন কাটে। তার পর আবার একদিন স্বাভাবিক কথা বলেন।’ বলেছিলেন আহম্মদ, চার বছর আগে।

তবু স্মৃতি অটল ছিল কবিরণের: ‘দাদা-দিদির তো অভ্যাস নেই এমন কুঁড়েঘরে থাকার, তবু কোনও দিন খেদ দেখিনি। সারা দিন খোলা থাকত বাড়ির দরজা। ওদের সন্তান ছিল না, তাই ছোটদের খুব ভালবাসত। ওই যে সালেমন, (‘সালেমনের মা’ কবিতার ছোট্ট সালেমন) ও তো দিন-রাত পড়ে থাকত ও-বাড়িতে। দাদার খুব শখ ছিল বাজার করার। হয়তো সকাল দশটা বেজে গেছে, মিটিং থেকে ফিরে আমার রান্নাঘরের সামনে ছুড়ে দিতেন মাছের ব্যাগ। বলতেন, কেটেকুটে রাখ। গীতা রান্না করবে, সবাই খাব। কত দিন যে এ বাড়িতেই ব্যাগভর্তি বাজার জড়ো করেছেন, তার হিসেব নেই। বুঝতেন তো, আমাদের বাজার করার সাধ্যি নেই।’

এই কবিরণকেই অমর করে রাখতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লেখেন ‘পায়ে পায়ে’ কবিতাটি। ‘যত দূরেই যাই’ কাব্যগ্রন্থের এই কবিতায় কবিরণ হাজির আছেন ‘আহম্মদের মা’ হিসেবে। কবিতায় আছে:
‘‘চেয়ে দেখ, হে বিষাদ—
একটু সুখের মুখ দেখবে ব’লে
আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে
চুল সাদা করে আহম্মদের মা
,’’

বছর চারেক আগে যখন তাঁর মুখোমুখি, দেখি সত্যিই সাদা চুল আহম্মদের মা। অনেক অপেক্ষা শেষে তখন সুখের মুখ কি প্রত্যক্ষ করেছেন? ছেলে আহম্মদ প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠিত নাতি সাহরিয়ৎও। তবু তাঁর অতীত ছুঁয়ে তিনি বোধহয় তখনও বলতে চান, ‘যায় না, বিষাদ তবু যায় না।’

দশ বছর বয়সে কাছের বাঘমারি গ্রামের বাপের বাড়ি ছেড়ে কবিরণ এসে উঠেছিলেন স্বামীর সংসারে। সাজ্জাদ আলি তখন বজবজ জুটমিলে ১৪ টাকা হপ্তা বেতনে শ্রমিক। বাপের বাড়িতে দু’বেলা ভরপেট খাওয়া জোটেনি। স্বামীর ঘরেই বা স্বাচ্ছন্দ্য এল কোথায়! এরই মধ্যে জন্ম হয়েছে ছেলে আহম্মদ, মেয়ে গোলবানুর। তবু কবিরণ দশভুজার মতো সামলেছেন সংসার। চুল পাকিয়েছেন, অপেক্ষা একটু সুখের মুখ।

সে দিন যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলছি, তত দিনে আনন্দবাজার পত্রিকায় আমরা পড়ে ফেলেছি (২১ ডিসেম্বর, ২০১০, পৃ.৪) অশোক মিত্রের সেই উজ্জ্বল প্রবন্ধ: ‘রাজশাহি জেলে বন্দি ছিলেন এক বনলতা সেন’। জীবনানন্দ লেখককে জানিয়েছিলেন, ১৯৩২ সাল বা ‘তার পরের বছর, বনলতা সেন নাম্নী এক রাজবন্দি রাজশাহি জেলে আছেন, খবরটা তাঁর চোখে পড়েছিল’ আনন্দবাজার পত্রিকা মারফত। পরবর্তী কালে অঙ্কের শিক্ষক সেই নারীর সঙ্গে অশোকবাবুর পরিচয়ও ছিল।

কবিতার চরিত্ররা এ ভাবেই কখনও কখনও পেয়ে যায় জ্যান্ত বাস্তবের অনুষঙ্গ। শঙ্খ ঘোষের ‘কবিতার মুহূর্ত’ তার অনেক প্রমাণ দীপিত রেখেছে। কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা বলেই নাম-ধাম নিয়ে, বাস্তব মেখেই বেঁচে থাকেন আহম্মদের মা, তাঁর নিজস্ব নিয়ে।

কেমন লাগে কবিতার চরিত্র হয়ে ওঠার ব্যাপারটা, জানতে চেয়েছিলাম তাঁর কাছে। স্মিত হেসে উত্তর এড়িয়ে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘দাদা তো মজা করত খুব! ওই বই যে-বার পুরস্কার পেলে (অকাদেমি), গাড়ি কিনলে। বললে, তোর কথা লিখে পুরস্কার পেয়েছি। তোকে গাড়িতে চড়তেই হবে। জোর করে চাপালে, ঘোরালে অনেকদূর... সেই কলকাতা!’ কবিরণের সেই প্রথম কলকাতা দেখা।

সুভাষবাবু বজবজে ছিলেন বছর দুয়েক। কিন্তু আমৃত্যু অটুট ছিল তাঁদের সম্পর্ক। কবিরণের বাড়িতে চিরকাল পালিত হয়েছে সুভাষদাদার জন্মদিন। শেষ জন্মদিনটিতেও দাদার ছবিতে ফুল দিতে ভোলেননি কবিরণ। পয়লা মে সন্ধ্যায় শেষ হয়ে গেল সে-সব। চলে গেলেন এই কবিতা-নারী। আমরা জানলামও না।

কোচবিহারে এবিএন শীল কলেজে বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE