গ্রেফতার নয়, লম্বা মামলাও নয়, সোজা মেরে দাও। পরিচালক রোহিত শেট্টির নতুন ফিল্ম ‘সিম্বা’-র এই হল বার্তা (ছবিতে একটি দৃশ্য)। থানার মধ্যে ‘এনকাউন্টার’-এ দুই ধর্ষককে হত্যা করল নায়ক সিম্বা। আদালতের নির্দেশে তদন্ত হল। ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার সিংহম রিপোর্ট দিলেন, আত্মরক্ষার জন্যই সিম্বা গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। সিম্বা ধন্যবাদ জানালে সিংহম বলেন, ধর্ষকের শাস্তির জন্য আদালতের সময় নষ্ট করার দরকার নেই।
নায়িকাও সেই বক্তব্যকে সমর্থন করলেন। যে থানায় সিম্বা এ ঘটনা ঘটায়, আগে তার দায়িত্বে ছিলেন নায়িকার বাবা। তিনি ছিলেন ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট।’ পঞ্চাশটি ভুয়ো এনকাউন্টার করেছেন। কন্যার বক্তব্য, বাবা থাকলে তিনিও মেরে দিতেন ধর্ষককে। অনাথ সিম্বার পাতানো পরিবারের সব সদস্য, ছবির প্রায় সমস্ত নারী চরিত্র, এক বাক্যে সেই কথাই বলে। সিম্বা লক-আপ থেকে বার করে, হাতে পিস্তল ধরিয়ে সাজানো সংঘর্ষে গুলিতে হত্যা করে পাতানো বোনের দুই ধর্ষককে।
কাহিনির প্রয়োজনে যা দেখানো দরকার, পরিচালক নিশ্চয়ই দেখাবেন। কিন্তু শিল্পীর স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে এ ভাবে সংবিধান, আইন, মানবাধিকার নস্যাৎ করার ডাক দেওয়া যায়! তার প্রস্তুতি চলেছে ধাপে ধাপে। এক ডাক্তারি ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুন, এবং তাকে কেন্দ্র করে প্রবল আবেগ তৈরি হল। নির্ভয়া মামলার প্রসঙ্গ তুলে সারা দেশে ধর্ষণের পরিসংখ্যান জানানো হল। আইনের বিচার সে সংখ্যা কমাতে পারছে না, সেই আক্ষেপও এল। এত অবধি বহু ছবিতেই দেখা যায়। আইনের প্যাঁচে অসহায় পুলিশ অপরাধীকে শাস্তি দিতে না পারার যন্ত্রণায় ছটফট করছে, এমন দৃশ্য বার বার এসেছে। এসেছিল রোহিত শেট্টির ২০১১ সালের সুপারহিট ছবি ‘সিংহম’-এও। কিন্তু সেখানে এনকাউন্টার-এর অভিনয় করে পুলিশবাহিনী শেষ পর্যন্ত দুর্বৃত্ত নেতাকে গ্রেফতার করেছিল। ‘সিম্বা’ ছবিতে বাজিরাও সিংহম (অভিনেতাও এক, অজয় দেবগণ) ভুয়ো সংঘর্ষকে সমর্থন করছেন। হত্যাকারী পুলিশকে বাঁচাতে ভুয়ো রিপোর্ট দিচ্ছেন।
২০১১ থেকে ২০১৮। কী বদলে গেল এর মধ্যে? ২০১৭-এ উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতাসীন হয়েছেন। ইতিমধ্যে তাঁর সরকার ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার জন্য সংবাদে এসেছে বার বার। অভিযোগ, রাজ্যে পুলিশ প্রায় এগারোশো ‘এনকাউন্টার’ করেছে, অন্তত ৬৮ জন নিহত, আহত ছ’হাজারের বেশি। আলিগড়ে সাংবাদিকদের ডেকে ক্যামেরার সামনে এনকাউন্টার করে দু’জনকে খুন করা হলে হইচই হয়। মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী, পদস্থ পুলিশকর্তারা ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার পক্ষে সওয়াল করেন। তাঁদের মতে, উত্তরপ্রদেশের দুষ্কৃতী দমনে এটাই রাস্তা। হতাহতদের মধ্যে বহু দুষ্কৃতী হয়তো আছে। কিন্তু দেখা গিয়েছে, তাঁরা অধিকাংশই মুসলমান, এবং তাঁদের আনুগত্য সমাজবাদী দলের প্রতি। অভিযোগ উঠেছে, রাজ্য সরকার অনুগত দুষ্কৃতীদের জায়গা করে দিতে পুলিশ দিয়ে খুন করাচ্ছে অন্য দলের দুষ্কৃতীদের।
সুপ্রিম কোর্ট, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ভুয়ো সংঘর্ষের ঘটনায় উত্তরপ্রদেশ সরকারের জবাব দাবি করেছে। সরকার জানিয়েছে, প্রতিটি হত্যাই পুলিশ করেছে আত্মরক্ষার জন্য। ঠিক তা-ই হয়েছে ‘সিম্বা’ ছবিতে। পঞ্জাব, অসম, কাশ্মীর, সর্বত্রই সেনা বা পুলিশের ঢাল হিসাবে কাজ করেছে ভারতীয় দণ্ডবিধির একশো নম্বর ধারা। তাতে বলা হয়েছে, আত্মরক্ষার্থে অন্যের জীবনের অধিকার কেড়ে নেওয়া যায়। সিম্বাও সেই ধারা কাজে লাগায়।
ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা নতুন কিছু নয়। মণিপুরে পুলিশ, সেনা ও আধাসেনার হাতে ভুয়ো সংঘর্ষে ৮১ জন নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ। ছত্তীসগঢ়, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, বিহারে মাওবাদীরা দীর্ঘ দিন ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার অভিযোগ জানিয়ে আসছে। পশ্চিমবঙ্গে সত্তরের দশকে, অন্ধ্রপ্রদেশে নব্বইয়ের দশকে ভুয়ো সংঘর্ষে বহু মানুষকে হত্যা করেছে পুলিশ, অভিযোগ মানবাধিকার সংগঠনগুলির। ভুয়ো সংঘর্ষে মাওবাদী নেতা আজাদ হত্যার অভিযোগের বিচার করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, ‘‘প্রজাতন্ত্র কখনওই নিজের সন্তানদের হত্যা অনুমোদন করে না।’’ ‘সিম্বা’ কিন্তু দাঁড়াল এর বিপরীতে। ধর্ষণকারীর কঠিন কঠোর সাজা নিশ্চয়ই দরকার। কিন্তু তা বিনা বিচারে নয়। চিন্তাশীল মহিলারা তা চান না, রোহিত শেট্টি যতই মহিলা চরিত্রদের দিয়ে সে কথা বলান না কেন।
ছবির শেষে দেখি, খলনায়ক রানাডে নিজের আইনজীবীর গালে সপাটে চড় মেরে বলছে, ‘‘রাখো তোমার প্রমাণ আর বিচার। যা করার আমিই করব, আমার মতো করে।’’ অন্য দৃশ্যে সিংহম বলছে, আজ সিম্বার মতো পুলিশ অফিসারই দরকার। ‘সিধা ঠোক দো’— এটাই এখন দেশের মানুষ চাইছে। অর্থাৎ, বিনা-বিচারে হত্যার জন্য পুলিশ বা সেনাকে লাইসেন্স দিচ্ছে রাষ্ট্র, আর রাষ্ট্রকে সেই লাইসেন্স দিচ্ছে নাগরিক। এর চেয়ে ভয়ানক সংলাপ হতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy