Advertisement
E-Paper

বঞ্চনার ভিতে দাঁড়িয়ে আকালের অনুসন্ধান

সত্তরের দশকে মৃণাল সেন নির্মাণ করেছিলেন ‘একদিন প্রতিদিন’। মানুষের নিজেদের আরোপিত জেন্ডার ভাবনায় তিনি চাবুক কষিয়েছিলেন সেলুলয়েডে, সংলাপে এবং দৃশ্যে। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামআত্মহত্যা করা মেয়েদের তালিকা সামনে এলে স্থান, ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া তরুণীর চেয়ে পুলিশের বলা ‘আর্লি প্রেগন্যান্সি’ শব্দটা চিনুর বাবাকে বেশি আক্রান্ত করে। মেয়ের মৃত্যুর চেয়ে বড় অপমান এটাই যে, সে মা হয়ে যাওয়ার মুখে। যে মাতৃত্ব  নারীর গৌরব তা নিয়ে মেয়েদের নিজের সিদ্ধান্তের কোনও জায়গা নেই।

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৪৭

পরিবারের প্রধান বাবা। সংসারে তিনিই শেষ কথা। কারণ, তিনি উপার্জন করেন। আসলে সামাজিক অসম পরম্পরার তিনি মূল বাহক। চিনুদিরা কখনও সংসার চালিয়ে পরিবারের প্রধান হয় না! ঋষিকেশ সেনগুপ্তের পরিবারের ঘাতক ছিলেন তিনি নিজেই। আর্থিক ক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এক বিরাট পরিবার তিনিই গড়েছিলেন। তাঁর কর্মাবকাশের দিনে সংসারের হাল ধরা মেয়ের প্রতি তিনিও কম সন্দিহান ছিলেন না। এই আপাত নিরীহ মানুষটির মধ্যেও আসলে এক পুরুষ বাস করে তা প্রমাণ দেওয়া থেকে তিনিও নিজেকে বিরত রাখতে পারেননি। রাতে ফিরতে দেরি করা চাকুরিরতা মেয়ে নিয়ে তিনিও সন্দেহ করেন আর পাঁচ জনের মতোই। বিড়বিড়িয়ে বলে ফেলেন— এত রাতে ...অফিসে। লোকলজ্জা তাঁর মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে অনায়াসেই। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন— এ বাড়ির এত লোক জেনে গেল আমাদের মেয়ে এত রাত হয়ে গেল ফিরল না। মেয়ে ঘিরে আশঙ্কা বা অজানা ভয় নয়, এক নিশ্চিত নেগেটিভ সিদ্ধান্তের অস্পষ্ট দাগ টেনে দিলেন এক পিতা।

আত্মহত্যা করা মেয়েদের তালিকা সামনে এলে স্থান, ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া তরুণীর চেয়ে পুলিশের বলা ‘আর্লি প্রেগন্যান্সি’ শব্দটা চিনুর বাবাকে বেশি আক্রান্ত করে। মেয়ের মৃত্যুর চেয়ে বড় অপমান এটাই যে, সে মা হয়ে যাওয়ার মুখে। যে মাতৃত্ব নারীর গৌরব তা নিয়ে মেয়েদের নিজের সিদ্ধান্তের কোনও জায়গা নেই। চিরাচরিত মেকি বিশ্বাস মানুষকে কী তীব্র ভাবে আঁকড়ে ধরে আছে সেটাই স্পষ্ট হচ্ছিল এক বাবার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা বক্তব্যে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও বিশ্বাসের থেকেও বড় মিথ্যা সমাজভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া। আর এই কাজ করে চলে এক পরিবার। আসলে যাদের কথা ছিল এক মেয়ের উপরে নেমে আসা এই অন্যায় বিপর্যয় রুখে দেওয়ার।

উনুনের ধোঁয়ার সামনে মায়েদের অনন্ত নিঃশেষ হওয়ার আপস মৃণাল সেন তাঁর জীবনব্যাপী নির্মিত চলচ্চিত্রে দেখিয়ে এসেছেন। চিনুর মা একসময় মিনুর প্রশ্নবাণে খেই হারিয়ে জর্জরিত হয়ে কেঁদে ওঠেন। চুপ করে বসে থাকা লোকটি, চিনুর পিতার দিকে আঙুল তুলে তাঁকেই দায়ী সাব্যস্ত করেন। আসলে বিয়ে মেয়েদের দেওয়া হয়, তারা বিয়ে করতে পারে না। সেই স্টিরিয়োটাইপ ভাবনা থেকে সেদিনও সমাজ মুক্ত ছিল না। আজও নয়। পাত্র ভাল নয় বলে মেয়ের বিয়ের সময় পিছিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু রোজগেরে মেয়ে বিয়ের পরে যে আর বাপ-মাকে টাকা দিতে পারবে না, তা নিয়ে কোনও সংশয় থাকে না। মেয়েদের আর্থিক স্বাধীনতা আসলে তার পরিবার নিরপেক্ষ একান্ত নিজস্ব নয়।

চিনুর মা চিনুর প্রেমিককে মেনে না নিতে পারার কারণ হিসেবে তুলে ধরেন— সোমনাথ চেয়েছিল চিনু রোজগার করুক। কিন্তু প্রেমিক বাতিল হয় যে অজুহাতে, সেই একই ভাবনা প্রতিফলিক হচ্ছে নিজের পরিবারেই। সেখানে কত মহিমা! মেয়েদের রোজগারে স্বামীর ঘর চালানোর ইচ্ছে যদি অন্যায় হয়, তবে তা একই ভাবে নিজের পরিবারেও প্রযোজ্য। এ কথার ইঙ্গিত দেয় ছোটবোন মিনু। মায়ের দফায় দফায় জ্ঞান হারানো ও চিনুর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নিয়ে কটাক্ষের জবাবে অভিমানে সে বলে ফেলে—মেয়েকে চাকরি করতে পাঠিয়েছ, সব সময় সব হয় না মা।

‘চালচিত্র’ চলচ্চিত্রে এক যুবকের ভাল চাকরির সন্ধানে একটা গল্পের খোঁজ দিয়ে শুরু। মহিলাকেন্দ্রিক এক চমক থাকতে হবে প্লটে। বাজার অর্থনীতির এক বড় অংশ হিসেবে মেয়েদের অবস্থান চলচ্চিত্রে স্পষ্ট করে তুলে আনেন মৃণাল সেন। গল্পের চরিত্র শ্রেণিভিত্তিক সমাজের নারীর অবস্থান নিয়ে। ‘বাইশে শ্রাবণ’ এর মালতির সংসারে চূড়ান্ত অভাব। অথচ সেই অভাবের দিনেও তাঁর জন্য খাবার না রেখে পুরোটাই খেয়ে নিতেন তাঁর স্বামী। সেই স্বার্থপরতাও সইতে হয়েছিল মালতিকে। ‘পদাতিক’ এর সুশিক্ষিত প্রতিবাদী নারী চরিত্র এবং ‘আকালের সন্ধানে’ গ্রামের মেয়েরা নিজেদের জীবনকে অন্য ভাবে উদ্‌যাপনের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু একটা সীমানা বরাবর দেওয়াল যেখানে, সেখানেই এক দিন সবার পিঠ ঠেকে যায়। এক গণ্ডীবদ্ধ জীবনের হাঁসফাঁস অবস্থান। ঘর চলে উনুনের আঁচে নয়, গ্যাসে। ফারাক শুধু অর্থনৈতিক অবস্থানে। কিন্তু গল্পের রসদ দুই শ্রেণিগত ভাবে ভিন্ন মেয়েদের উপর চাপানো অসহায়ত্ব বা মেনে নেওয়ার এক অনিবার্য দায়।

‘অন্তরীণ’ চলচ্চিত্রে একা মহিলার নিজের বন্দিত্বের কথা উঠে আসে টেলিফোনের কথোপকথনে। এক শৃঙ্খলিত অসহায়ত্বে বাক্সবন্দি জীবন। আর্থিক ও সামাজিক ভাবে যে সব মহিলা নিশ্চয়তার জীবন যাপন করে তারাও সীমাবদ্ধতার লক্ষ্মণরেখায় বন্দি। ‘আকাশকুসুম’ এর মনিকা উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত এক ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। নিজের বিত্ত, শিক্ষার বাইরে তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা গড়ে ওঠে না। আধুনিকতা ও আভিজাত্যের সঙ্গে মানানসই তার পছন্দের মানুষ যে আসলে এক প্রতারক তা প্রমাণিত হয়। গরিব অজয়কে নিয়ে মনিকার নিজের দেখা স্বপ্নটাও হারিয়ে যায়। ‘খন্ডহর’- এর যামিনী অসুস্থ ও শয্যাশায়ী মাকে নিশ্চিন্তে মরে যেতে দেয়। এক মা মৃত্যুবরণ করে নিজের মেয়ে পাত্রস্থ হয়েছে সেই বিশ্বাস নিয়ে। কিন্তু আখেরে যামিনী নিজের জীবন একাকীত্ব ও নির্জনতার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করে।

দেশ, কাল, পাত্রভেদে পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসনে মহিলাদের এক নিবিড় অবস্থান মৃণাল সেন সিনেমায় তুলে ধরেছিলেন। চার দশক পেরিয়েও বড় দাগের কিছু বদলায়নি। মেয়েদের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সামাজিক গ্লানি নিয়ে যে চিরাচরিত প্রশ্ন তার সঙ্গে আপস হয়েছে মাত্র, সুরাহা হয়নি। অভাব আসলে এক কৃত্রিম নির্মাণ। অবদমিত অভাব এক সময় দুর্ভিক্ষের রূপ নেয়। যেখানে হাজার ‘না’ এ অভ্যস্ত মানুষ আর নিজের অবস্থানকে ফিরে পায় না। এক দ্বৈত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বঞ্চনার ভিতে দাঁড়িয়ে এই আকালের অনুসন্ধান কত জরুরি তার দিক নির্দেশ করে দিয়ে গিয়েছেন মৃণাল সেন। আর সেই কারণেই চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত সমস্যার উত্তর খুঁজে বের করার দায় সকলের।

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

Movie Mrinal Sen Gender Stereotype
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy