শেকড়-ছেঁড়া? সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ ছবির একটি দৃশ্য
নি উ ইয়র্কের মিউজিয়ম অব মডার্ন আর্ট ৪ মে পালন করল ‘পথের পাঁচালী’র ষাট বছর...। সেখানেই ৩ মে ১৯৫৫ সর্বপ্রথম দেখানো হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’। কলকাতায় মুক্তি পেয়েছিল তারও সাড়ে তিন মাস পর, ২৬ অগস্ট। নিউ ইয়র্কেরই ফিল্ম ফোরাম-এ এ বার আট সপ্তাহ চলল অপু-ট্রিলজি, টিকিট কেটে সর্বসাধারণের জন্য।
জ্যানাস ফিল্মস আর ক্রাইটেরিয়ান কালেকশন-এর পক্ষে পিটার বেকার এবং লি ক্লাইন অপু-ট্রিলজি ‘রেস্টোরেশন’ করেছেন। এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে দুজনে আশির দশকে অপু-ট্রিলজি দেখতে শুরু করার কথা জানিয়েছেন। পিটার সত্যজিতের ট্রিলজিতে ‘ফার্স্ট ফ্লাওয়ারিং অব পোস্ট-ওয়ার গ্লোবালাইজেশন’ খুঁজে পেয়েছেন। যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বায়নের প্রথম বিকাশ সত্যজিতের ছবিতে— শুনতে বেশ অদ্ভুতই লাগে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ছেঁড়াখোঁড়া অবস্থা ইউরোপ-সহ গোটা দুনিয়ার, দেশ খুঁজে বেড়াচ্ছে আক্রান্ত মানুষ, শিকড় উপড়ে ছিন্নমূলেরা ছুটে চলেছে পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই পাওয়ার আশায়, নতুন দুনিয়ার দিকে সেই পা বাড়ানোর চিহ্নই সম্ভবত খুঁজে পেয়েছেন পিটার, সত্যজিতের অপু-ট্রিলজি’তে।
‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘অপুর সংসার’ অবধি যে সময়কাল বিধৃত সত্যজিতের ছবিতে, সেটা মোটামুটি কুড়ির দশক, পরাধীন ভারতের গল্প, আপাত ভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু শিকড় ছেঁড়ার একটা যোগসূত্র হয়তো খুঁজে পাচ্ছেন পশ্চিমি মানুষজন, ১৯৫৫ থেকে ২০১৫ অবধি।
অপুর আদৌ কি কোনও বাড়ি ছিল? সে তো প্রথম থেকেই শেকড়-ছেঁড়া, যত বয়স বেড়েছে অপুর, ততই সে ঠাঁইনাড়া হয়ে গিয়েছে। ট্রিলজি-র অন্তিম পর্ব ‘অপুর সংসার’, একটু এগোনোর পরই জানা যায়, কলকাতায় মেস ছেড়ে হতশ্রী যে বাড়িটার ছাদের একচিলতে ঘরে অপু বাস করে, তার তিন মাসের ভাড়া বাকি, বই বেচতে হয় তাকে টাকার জন্য। ফুলশয্যার রাতে অপর্ণার সঙ্গে প্রথম আলাপের পর সে বলে ‘আমার বাড়ি নেই। কিচ্ছু নেই। চাল নেই, চুলো নেই... তোমায় নিয়ে গিয়ে কোথায় ফেলব আমি?’ কলকাতায় পড়তে আসার আগে সে মনসাপোতায় ছিল, তারও আগে কাশীতে। আর প্রথম পর্ব ‘পথের পাঁচালী’তে তার জন্ম, নিশ্চিন্দিপুরে, সেখানেই কেটেছে ছেলেবেলা।
ছেলেবেলা থেকে অনেকটা যেন উদ্বাস্তুর মতো বড় হতে থাকে সে, নিজেদের বসতবাড়িতেই। জীবিকার খোঁজে, পরিবারের মুখে ভাত জোটাতে তার পুরোহিত পিতা হরিহর কোথায়-কোথায় ছুটে বেড়ায়, জানতেও পারে না কখন তার কন্যা দুর্গা মারা গিয়েছে। বুড়ি পিসি ইন্দির ঠাকরুণও যতই ভিটে আঁকড়ে বাঁচতে চায়, ততই সে ভিটেছাড়া হয়ে যায়। জীবনের শেষ ক’টা দিনও নিজের ভিটেতে ঠাঁই হয় না তাঁর, বাঁশবনে প্রাচীন এক গাছের তলায় প্রাগৈতিহাসিক নারীর মতো মরে পড়ে থাকে। আর হরিহর দেশদেশান্তর ঘুরেও সংসার চালাতে পারে না, ‘মাঝে মাঝে ভিটের মায়াও ছাড়তে হয়’ বলে সর্বজয়া আর অপুকে নিয়ে পথে নেমে পড়ে।
নিজের দেশ দু’টুকরো হয়ে যাওয়ার পর অপু-চিত্রত্রয়ী তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ। জানতেন, ‘নিরাশ্রয়’ শব্দটা কতটা নির্মম হয়ে উঠতে পারে। ১৯৫৫-১৯৫৯ পর্যন্ত বাঙালি যখন প্রথম তাঁর এই তিনটি ছবি দেখল, তখন আমাদের নাবালক স্বাধীনতা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রশ্রয়ে নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে। অথচ সত্যজিৎ টের পাচ্ছেন, ফেলে-আসা পরাধীনতার দাপট কী ভাবে পঙ্গু করে ফেলছে আমাদের সদ্যোলব্ধ স্বাধীনতাকে। উন্নয়নের সঙ্গে লগ্ন হয়ে আছে অনুন্নয়ন, উৎপাদনের সঙ্গে অপচয়, আয়বৃদ্ধির সঙ্গে বৈষম্য, উচ্ছেদ, কর্মহীনতা।
তাঁর ছবিতে হরিহর-সর্বজয়া বা অপুও প্রথম নিরাশ্রয়ের পর বুঝে উঠতে পারেনি— তাদের নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে যাত্রা শেষ পর্যন্ত নিরাশ্রয়ের সমে এসেই থিতু হবে। বুঝে ওঠার আগেই কাশীতে মৃত্যু হয় হরিহরের। আর মনসাপোতায় মানসিক ভাবে নিরাশ্রয় সর্বজয়া নিঃসঙ্গ মৃত্যুর দিকে এগোতে-এগোতে টের পায়, অকালমৃত্যু অন্তত দুর্গাকে তার মতো এই অসহনীয় বেঁচে-থাকা থেকে রেহাই দিয়েছিল।
অপু কিন্তু নিজের নিরাশ্রয় মেনে নিয়েছিল। ‘অপরাজিত’তে মনসোপোতার স্কুলের হেডমাস্টারমশাই অপুকে বুঝিয়েছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের একটা রিমোট কর্নার-এ পড়ে আছি বলে যে মনটাকেও কোণঠাসা করে দিতে হবে, এমন তো কোনও কথা নেই!’ সম্ভবত সে জন্যেই শেকড়-ছেঁড়াকে এগোনোর পক্ষে স্বাভাবিক বলে ভাবতে শুরু করে অপু, নিরাশ্রয়কে অবশ্যম্ভাবী বলে মানতে শুরু করে। কারণ, তত দিনে সে জ্ঞানের আলোর অধিকারী, পরাধীন বাঙালি, তবে ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত। ‘অপুর সংসার’-এ নিজের সম্পর্কে বন্ধুকে বলে: ‘ছেলেটি শহরে এল, সে পুরুতগিরি করবে না— পড়বে... শিক্ষার ভেতর দিয়ে, স্ট্রাগল-এর ভেতর দিয়ে— তার কুসংস্কার, গোঁড়ামি সমস্ত কেটে যাচ্ছে। বুদ্ধি দিয়ে ছাড়া সে কোনও কিছু মানতে চাইছে না।’
‘এনলাইটেনমেন্ট’ বা আলোকপর্বের যাত্রী হয়ে উঠতে চায় অপু, বিশ্বায়িত হতে চায়, হতে চায় আধুনিকতার অগ্রাধিকারী, তার সেই ‘প্রগতি’র বাঁকে-বাঁকে নিশ্ছিদ্র আঁধারও তো ওত পেতে থাকে। মনসাপোতায় আসার পর অপুকে সর্বজয়া বলে, ‘সন্ধের দিকে জ্বর জ্বর, মাথা ঘোরা— তাছাড়া খিদে হয় না মোটে— কদ্দিন ভেবেছি তোকে বলব— বলা হয় না— তুই তো আর পড়াশোনা ছেড়ে আমার কাছে আসবি না— আসবি?’ অপু নিরুত্তর। সর্বজয়া বুঝতে পারে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। হাতের কাজ মুহূর্তের জন্য থামিয়ে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
আমরাও দীর্ঘশ্বাস ফেলি, অপুর আলোকপর্ব-অভিযান ক্রমাগত টাল খেতে দেখে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ, পনেরো টাকা রোজগার, গ্লোব-হাতে যে ট্রেনে চেপে কলকাতায় আসা সেই ট্রেনের কাছেই আত্মহত্যা করতে যাওয়া, উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি ফেলে দেওয়া— গোটা ‘অপুর সংসার’ জুড়ে কেবল তার ক্রমভঙ্গুর উন্মূল পরিক্রমা। এই অসংগতি, আত্মবৈপরীত্য, নিত্য শেকড় ছেঁড়া, এ বোধহয় ‘এনলাইটেনমেন্ট’-এর অনিবার্য শর্ত।
আলোকপর্বের যুক্তিকাঠামোকে অস্ত্র বানিয়ে সারা দুনিয়ায় কলোনি কায়েম করেছিল ইউরোপ, চালু করেছিল ক্রীতদাস-ব্যবসা, জন্ম দিয়েছিল ফ্যাসিজম-এর। তাই আজও আত্মদ্বন্দ্বে দীর্ণ ইউরোপ আর আমেরিকাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ছিন্নমূল এক আধুনিকতার ভার। সম্ভবত সে জন্যেই সেখানকার মানুষজন এখনও একাত্মতা অনুভব করেন অপুর সঙ্গে, চোখের জল ফেলেন অপু-ট্রিলজি দেখে। শেষ দৃশ্যে ছেলেকে কাঁধে নিয়ে অপুকে ফিরতে দেখে তাঁদেরও হয়তো শিকড়ের কাছে ফিরতে ইচ্ছে করে। স্টেফানি জাকারেক, নিউ ইয়র্কের একটি পত্রিকার বিশিষ্ট সমালোচক, প্রথম অপু-ট্রিলজি দেখেছিলেন বস্টনে, ১৯৯৫-এ। কুড়ি বছর বাদে এ বারে দেখার পর দীর্ঘ এক রচনায় লিখেছেন ‘Apu Trilogy is inseparable from life… you can go home again. Just not back to your own.’
ঋণ: সন্দীপ রায়। সত্যজিতের বিভূতিভূষণ, রুশতী সেন (প্যাপিরাস)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy