প্রত্যাশিত ভাবেই লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের পঁচাত্তর বর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠানটি সারবত্তাহীন ধামাকায় পর্যবসিত হইল, নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার দলবল শত চেষ্টাতেও সুভাষচন্দ্রকে আত্মসাৎ করিতে পারিলেন না। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় সুভাষচন্দ্র অমর রহে হইতে ভারতমাতা কি জয় ইত্যাদি করতালি-মুখরিত স্লোগান শোনা গেল, কিন্তু আজাদ হিন্দের রণধ্বনি ‘জয় হিন্দ’ নহে। শুরুতে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে কয়েক জন সৈন্য পরস্পরকে ‘জয় সিয়ারাম’ ধ্বনিতে অভ্যর্থনা জানাইতেন, কালক্রমে সুভাষের নেতৃত্বে সেটি ধর্মীয় অনুষঙ্গহীন ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়। মোদী সেই ইতিহাস বলেন নাই, তাঁহার পক্ষে সম্ভবও ছিল না। বরং ‘বিকাশ’ শব্দটি তাঁহার মুখ হইতে একাধিক বার নির্গত হইল, ‘বেটি বঁচাও বেটি পঢ়াও’ যে প্রকৃত প্রস্তাবে রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য, আজাদ হিন্দের প্রেরণাতেই যে সেনাবাহিনীতে ওয়ান র্যাঙ্ক, ওয়ান পেনশন ইত্যাদি হাস্যকর কথা জানা গেল। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই প্রধানমন্ত্রী সে দিন নিজের ঢাক নিজে পিটাইয়া গিয়াছেন, ইহার সহিত সুভাষচন্দ্র বা তাঁহার আজাদ হিন্দ ফৌজের সম্পর্ক ছিল না।
আত্মসাৎ করিবার প্রকল্পটি নূতন নহে। স্বচ্ছ ভারতে গাঁধীর চশমা হইতে গুজরাতের বাঁধে সর্দার পটেল বা দলিত ভোটের কারণে অম্বেডকর অনেককেই মোদী ও তাঁহার সঙ্গীরা আপন মনের মাধুরী মিশাইয়া আপন ঐতিহ্যে ঢুকাইবার চেষ্টা করিয়াছেন, সুভাষচন্দ্রই বা ব্যতিক্রম হইবেন কেন? আজাদ হিন্দের পঁচাত্তর বর্ষপূরণে সে দিন মোদীর মুখে তাই শুধু সুভাষচন্দ্রের নাম। রাসবিহারী বসু এক বারও উচ্চারিত হইলেন না; যুদ্ধবন্দিদের লইয়া যিনি ফৌজ তৈরি করিয়াছিলেন, সেই মোহন সিংহও হারাইয়া গেলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের যেটি প্রধান কৃতিত্ব, কাশ্মীরি-তামিল, হিন্দু-মুসলিম, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ ভেদ চলিবে না, সকলকে ফৌজি ক্যান্টিনে পাশাপাশি খাইতে হইবে, সে বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী নীরব রহিয়া গেলেন। আজাদ হিন্দ সরকার যে পৃথক ব্যাঙ্ক, ডাকটিকিট, গুপ্তচরচক্র তৈরি করিয়াছিল, কেবল তাহারই উল্লেখ। ইতমদ (বিশ্বাস), ইত্তেফাক (ঐক্য) ও কুরবানি (আত্মত্যাগ) যে সেই সরকারের মূলমন্ত্র ছিল, মোদী বলেন নাই। আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যে গাঁধী ব্রিগেড, নেহরু ব্রিগেড ছিল, আজাদ হিন্দ রেডিয়োতেই যে সুভাষ গাঁধীকে ‘জাতির পিতা’ আখ্যা দিয়াছিলেন, তাহাও অনুচ্চারিত রহিল।
সব চেয়ে আশ্চর্য অন্যত্র। লালকেল্লায় অনুষ্ঠান, অথচ এক বারও উচ্চারিত হইল না আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার। যখন ফৌজকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ-মুক্ত করিতে লালকেল্লায় ব্যারিস্টারের বেশে অবতীর্ণ হইলেন জওহরলাল নেহরু, তেজবাহাদুর সপ্রু, ভুলাভাই দেশাইয়ের ন্যায় আইনজীবী। সেই বিচারে নেহরুরা বলিয়াছিলেন, আজাদ হিন্দের সেনানীরা রাষ্ট্রদ্রোহী নহেন। আমেরিকায় জর্জ ওয়াশিংটন, ইতালিতে গ্যারিবল্ডি এমন অনেকের মতো তাঁহারা দেশপ্রেমিক বলিয়াই রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছেন। নরেন্দ্র মোদী প্রত্যাশিত ভাবেই তাহা এড়াইয়া গিয়াছেন। তাঁহার ও সুভাষচন্দ্রের ‘ভারতীয়তা’ যে পৃথক, শিশুরাও জানে। হিন্দুত্ববাদী সাভারকর, গোলওয়ালকরেরা কোনও দিন সুভাষকে আত্মসাৎ করিতে পারেন নাই। নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রেও সেই ঐতিহ্যই বহাল রহিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy