Advertisement
E-Paper

‘এমন মাতা না হলে এমন সন্তান হয়!’

হিন্দুত্বের নামে, গোমাতার নামে যাঁরা মানুষ মারছেন তাঁরা রসিকতার পাত্র নন। ঘৃণার পাত্র, আইন তাঁদের কঠোরতম শাস্তি দিক। গরুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করেন না।

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৭ ১৩:১৫

শিষ্য চলেছেন গুরুর সঙ্গে। এসে পৌঁছলেন এক দেশে। সে দেশের বাজারে ঢুকে শিষ্যের কী আনন্দ! সন্দেশ মুড়িমুড়কি একই দামে মিলছে। আহা! শিষ্য থেকে গেলেন সেখানে। গুরু চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন যে দেশে মুড়ি আর মুড়কির দাম এক, সে দেশে বসবাস করার পরিণাম ভয়ংকর হতে পারে। গল্পে দেশ বদল করা খুব সোজা, কোনও সীমা থাকে না। গেলেই হল, এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তা সম্ভব নয়। কাজেই কোনও দেশে যদি গরু মানুষের থেকে দামি হয়ে ওঠে তখন ভয় করে, প্রতিবাদ জরুরি হয়ে ওঠে। যে দেশে মানুষের চেয়ে গরু মূল্যবান সে দেশ গল্পের সেই হবুচন্দ্র রাজার দেশের মতোই বোকার দেশ, অন্যায়ের দেশ।

হিন্দুধর্মে মানবেতর প্রাণীকে অবতার ভাবার গল্পটা পৌরাণিক যুগেই শুরু হয়েছিল। বিষ্ণুর অবতারের তালিকায় কূর্ম, বরাহ, মৎস্য তিন জনকেই খুঁজে পাওয়া যাবে। কচ্ছপের সংখ্যা কমে আসছে। জীববৈচিত্র রক্ষা করার জন্যই সে মাংস বর্জন করা উচিত। বরাহনন্দন গালাগাল হতে পারে, তবে খাদ্যের জন্য পালিত বরাহের মাংস সুস্বাদু। অনেক ধর্মপ্রাণ বাঙালি মাংস না খেলেও মাছ খান। মাছে-ভাতে বাঙালি! ভয় হয় কোন দিন না মানুষের থেকে মাছ দামি হয়ে ওঠে। মৎস্যাবতার রক্ষা সমিতি মাছ কাটার বঁটি হাতে মাছখেকো বাঙালিদের নিধনে উদ্যত হয়ে উঠল। পেছনে গান বাজতে লাগলজয় জগদীশ হরে

গরু মাছ নয়। জলচর মাছের সঙ্গে স্থলচর গরুর তুলনা হয় না। গরু ছাগল এমনিতে অবলা প্রাণী। অবলা ছাগলের মাংস খেতে অবশ্যহিন্দু পাঁঠার দোকান’-এ লম্বা লাইন পড়ে। ঈশ্বর গুপ্তের মতো রসিক বাঙালি কবি পাঁঠার বিশেষ গুণকীর্তন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বলিদান সংক্রান্ত আপত্তির সূত্রটি ভিন্ন। দেবতার নামে বলি দেওয়ার তিনি বিরুদ্ধে। দেবতাকে রক্তলোলুপ ভাবতে তিনি নারাজ। পোষ্য ছাগশিশুকে তুলে নিয়ে গিয়ে দেবতার নামে বলি দেওয়া হবে, এ কেমন কাজ!

গরু ছাগলের মতো অবলা হলেও তার উপযোগিতা ছাগলের চাইতে ঢের বেশি। চাষে কাজে লাগে, দুধ দেয়, গোবর থেকে ঘুঁটে হয়। ছেলেবেলায় লেখা গরু রচনাটি বড়বেলায় একটু ঝালিয়ে নিলেই হবে। তবে গোমূত্রের মহিমা যাঁরা কীর্তন করেন ও সর্বরোগহর বলে পান করতে বলেন তাঁদের বিবেকানন্দের গল্প শোনাতে ইচ্ছে করে। বিবেকানন্দের শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীস্বামী শিষ্য সংবাদবইতে সে কথা লিখেছিলেন। গরুবাঁচানেওয়ালারা এসেছেন বিবেকানন্দের কাছে। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস, বিলেতজয়ী এই হিন্দু সন্ন্যাসী তাঁদের গোমাতার সেবায় মনপ্রাণ ঢেলে দেবেন। বিবেকানন্দ গোরক্ষকদের জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁরা দরিদ্র অসহায় মানুষদের জন্য কী করছেন? তাঁরা জানালেন মানুষের নয়, গোমাতার প্রাণরক্ষাই তাঁদের লক্ষ্য। বিবেকানন্দের জবাবএমন মাতা না হলে এমন সন্তান হয়! যাঁরা গোমূত্রের মহিমা প্রচারক তাঁদের জন্য বিবেকানন্দের এই কথাই বরাদ্দ, ‘এমন মাতা না হলে এমন সন্তান হয়!’

হিন্দুত্বের নামে, গোমাতার নামে যাঁরা মানুষ মারছেন তাঁরা রসিকতার পাত্র নন। ঘৃণার পাত্র, আইন তাঁদের কঠোরতম শাস্তি দিক। গরুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করেন না। কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে গরু খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। হিন্দু মুসলমান চাষিরা গরুকে যত্ন করেন। ধর্মের জন্য নয়, অর্থনীতির জন্যই স্বাভাবিক ভাবে গরু তাঁদের কাছে আদরের। সেই আদরের সঙ্গে বাৎসল্য মিশে যায়। শরৎচন্দ্রেরমহেশগল্প অ-বাংলাভাষী গোরক্ষকদের পড়া না-ই থাকতে পারে, আমবাঙালির পড়া আছে। হিন্দু ব্রাহ্মণ জমিদাররা যে দরিদ্র মুসলমান চাষিদের তীব্র অত্যাচার করতেন, রবীন্দ্রনাথের গোরা তা নিজের চোখে দেখেছে। আর শরৎচন্দ্র তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন মুসলমান গফুর জোলা মহেশদের কতটা ভালবাসে। তর্করত্নের কাছে ধারে ডুবে থাকা গফুর তার পালিত অবলা জীব মহেশের জন্য কাহনখানেক খড় ধার চেয়েছিল। অর্থলোভী, সাম্প্রদায়িক তর্করত্ন গফুরের মহেশের জন্য মোটেই বিগলিতকরুণা হয়ে ওঠেননি।

গরুকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে যাঁরা খুনোখুনি করছেন তাঁরা সুযোগ খোঁজেন। আজ গরু কাল অন্য কিছু। চাষের জন্য দুধের জন্য যে গরু লাগে তাদের ধরে ধরে মেরে ফেলা হয় না। মাংসের জন্য তার বাইরের গরুরা বরাদ্দ। যে ভাবে কোনও কোনও হিন্দু-মন্দিরে ছাগ-রক্তের বন্যা বয়ে যেতে দেখেছি সে ভাবে মাংসের জন্য গোহত্যা করা হয় না। গোমাংস খেলে জাত যায়, এই মধ্যযুগীয় সংস্কার থেকেই বিশ্বাসী হিন্দুদের গোমাংস খাইয়ে দিয়েছিলেন বিরুদ্ধ ধর্মের মানুষেরা। রবীন্দ্রনাথের বংশেও তো এই পতনের গল্প আছে। সেই মধ্যযুগীয় সংস্কার কেটে যাওয়ার কথা। ধর্মের নামে নয়, যাঁদের ইচ্ছে হবে তাঁরা গো-মাংস খাবেন যাঁদের ইচ্ছে হবে না তাঁরা খাবেন না। গরুর প্রয়োজনীয়তার কথাও ভুললে চলবে না। এককালে গোঘ্নরা গরুর সংখ্যা কমে যাচ্ছিল বলে গোমাংস খাওয়া বন্ধ করেছিলেন। তখন এ দেশে মুসলমানদের টিকিটি দেখা যায়নি। গোমাংস নানা ভাবে রান্না করা যায়। কেরলে নারকেলের দুধ দিয়ে রান্না করা চমৎকার গোমাংস খেয়েছিলাম। খেয়ে উত্তেজনা হয়নি, যুদ্ধে যেতেও ইচ্ছে করেনি। মনে হয়েছিল আহা গাছতলায় একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

economic importance Cow Cow vigilantism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy