Advertisement
E-Paper

বাবুপাড়ার সাহেবজান আর সেবক রোডের গরবরান

আপাত ভাবে অতি সাধারণ জীবনের মধ্যেও ধরা থাকে সময়, সামাজিকতা আর যুগ বদলের ইতিহাস। লিখছেন মন্দিরা ভট্টাচার্যপ্রথম যে দিন সাহেবজানের  নাম শুনেছিলাম, সেদিন রবীন্দ্রনাথের ‘রংরেজিনী’ কবিতাটা মনে পড়েছিল। সেখানে রংরেজের নাম ছিল জসিম। পাগড়ি ধুয়ে রং করতেন তিনি

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:৫১

প্রথম যে দিন সাহেবজানের নাম শুনেছিলাম, সেদিন রবীন্দ্রনাথের ‘রংরেজিনী’ কবিতাটা মনে পড়েছিল। সেখানে রংরেজের নাম ছিল জসিম। পাগড়ি ধুয়ে রং করতেন তিনি। এখনকার ‘ডায়ার্স অ্যান্ড ক্লিনার্স’দের মতো। উত্তর ভারতে মুসলিম ধর্মাবলম্বী ধোবিদের ‘রংরেজ’ বলে। আমরা বাঙালিরা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তাঁদের ‘ধোপা’ বলি।

বাবুপাড়ার গণ্যমান্য ব্যক্তি হাবুদার সুপারিশে সাহেবজান আমাদের বাড়িতে এলে আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম যে, তিনি কাপড় রং করেন কি না। উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, রং তিনি ইদানীং কমই করেন। আমাদের বাবুপাড়ায় পাড়ার প্রায় সব বাড়ির কাপড় কেচে, ইস্ত্রি করে আমাদের ফিটফাট করে রাখতেন সাহেবজান। বাবুপাড়ার মাঝামাঝি বেশ বড়সড় এলাকা জুড়ে সাহেবজান আর তাঁর আত্মীয়, পরিজন সবাই মিলে থাকতেন। মস্ত বড় ব্যারাক-বাড়ির মতো বাড়ি। উপরে টিনের চাল। মেঝে মাটির, একটু উঁচু। আমার মেয়ের ইস্কুলের জামা আনতে সেই বাড়ি গিয়েছিলাম। সাহেবজান বাড়িতে ছিলেন না। কিন্তু ওঁর এক ছেলে ছিল। সে যখন বুঝতে পারল আমি কোন বাড়ির, একগাদা জামাকাপড়ের স্তূপ থেকে আমার মেয়ের জামা বার করে সঙ্গে সঙ্গে ইস্ত্রি করে দিল। আমি তখন একটা কাঠের চেয়ারে বসে বেশ আয়েস করে চা আর ‘এস’-বিস্কুট খাচ্ছিলাম।

সাহেবজান একটা ধুতিকে লুঙ্গির মতো করে পরে, লম্বা শার্ট বা পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে আসতেন। তাঁর এই পোশাক থেকে বোঝা যেত যে, তিনি হিন্দু নন। কবে থেকে কে জানে ধুতি আর লুঙ্গির এই অকারণ ধর্মীয় প্রভেদ শুরু হয়েছে! মধ্যযুগে অসংখ্য পোড়া মাটির ফলকে নানা সামাজিক ছবি দেখা যায়। নবাব, বাদশাহের ছবিও আছে। টুপি-পরা সাহেবও। কিন্তু ধুতি আর লুঙ্গির এমন বিভাজন আগে কখনও দেখা যায়নি!

এখানে আমার পরিচিত বাংলাদেশি পণ্ডিত বদরুদ্দিন ওমরের আত্মজীবনীর কথা মনে পড়ে। ওঁরা বর্ধমানের মানুষ। ছোটরা খাটো পাজামা আর শার্ট পরত। একবার একজন হিন্দু সহপাঠী ওঁকে আর ওঁর ভাইকে ব্যঙ্গ করায় বেশ কয়েকদিন ওঁরা চোগা-চাপকান পরে ইস্কুলে গিয়েছিলেন। আসলে, পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ লুঙ্গিই পরতেন। আমাদের বাবা-কাকাদেরও বাড়ির পোশাক ছিল লুঙ্গি। মধ্যবিত্ত বহু পরিবারে এখনও এটাই চালু।

একবার নাকি সাহেবজান একটা হুমকির চিঠি পেয়েছিলেন। তাঁকে কে এক গায়েবুল্লা বলেছিল, জমি না ছাড়লে বিপদ হবে। পাড়ার লোক এককাট্টা হয়ে তাঁকে অভয় দিয়েছিলেন। তাই সাহেবজান তাঁর সন্তানসন্ততি নিয়ে রয়ে গেলেন।

সাহেবজান যখন বিয়েশাদি বা পরবে দেশে যেতেন, তখন বাড়ির কাউকে না কাউকে কাজে বহাল করে যেতেন। একবার বেশ কয়েকদিন বদলিতে কাপড় নিতে আসত শাহেদ। জিগ্যেস করে জানতে পারলাম, সাহেবজান আর ফিরবেন না। যথেষ্ট বয়স হয়েছে, বাড়িতে তাঁর বউও মহা হট্টগোল লাগিয়েছেন। অবশেষে পরিবার স্থির করেছে, এবার থেকে বাড়িতে থেকে খেতিবাড়ি দেখবেন সাহেবজান।

এবার থেকে আমরা শাহেদের তত্ত্বাবধানে থাকলাম। শাহেদের বয়স অল্প। শহরের হাওয়া গায়ে লেগেছে। প্রায়ই যে দিন কাপড় দেওয়ার কথা, সে দিন সে নেশা করে দিনভর ঘুমায়। দু’দিন পরে আসে। আমার কাছে প্রচুর বকা খায়। কিছুদিন ঠিক থাকে, পরে আবার যে-কে-সেই।

একবার দিন কুড়ি কোনও খবর নেই তার। অবশেষে ফিরলে জিগ্যেস করলাম— হ্যাঁ রে, অসুখ করেছিল না কি! মাটির দিকে চোখ নামিয়ে বলল, ‘‘আপনাকে বলব না! আপনি বকবেন!’’ আমিও ছাড়ার পাত্রী নই! অবশেষে জানাল, ও থানা-হাজতে ছিল। আমি তো অবাক! কেন? মারামারি করেছিলি না কি? বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘‘আমার বড়া ভাবির সঙ্গে ঝগড়া হল, আমায় খুব খারাপ গালি দিল! আমি সহ্য করতে পারলাম না! আমিও ভাবিকে মারলাম এক ঝাপড়!’’ আমি বললাম— হায় হায়! করেছিস কী! বড় বউদির গায়ে হাত! তখন বোকাটা বলল, ‘‘সেটাই তো ভুল হল! বড়া ভাই থানায় বলে দিল! অনেক দিন পরে ছাড়ল!’’ আমি ওকে ওর ভাবির পা ধরে মাপ চাইতে বলেছিলাম। শেষে অবশ্য সব মিটমাট হয়ে গিয়েছিল। আমি শিলিগুড়িতে থাকা ইস্তক শাহেদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। কে জানে, কেমন আছে ও!

গড়বরান বা গরবরান নামটা আমি শুনেছিলাম। তিনি নাকি আমাদের সাহেবজানের মতোই সেবক রোডের সবার বাড়িতে কাপড় ধুয়ে-কেচে-ইস্ত্রি করে দিয়ে যেতেন! গরবরানের নাম আমি যাঁর কাছে শুনেছিলাম, তিনি তাঁর স্মৃতি থেকে বলেছিলেন। গরবরান নামটা যে অন্য রকম, সেটা তাঁর মনেই আসেনি। আমি এ রকম নাম কখনও আগে শুনিনি। তাঁর পোশাকের বর্ণনা শুনে দিব্বি বুঝতে পারলাম যে, তিনি হিন্দু। তিনি নাকি বরাবর ফটফটে সাদা ধূতি আর পাটপাট ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পরে বাড়ি বাড়ি কাপড় দিয়ে-নিয়ে যেতেন। সেভক রোডের সম্ভ্রান্ত বাড়ির লোকেদের বাড়িতে নাকি কাপড় কাচার রেওয়াজ ছিল না। সেভক রোডের মাঝামাঝি বিরাট এলাকা জুড়ে ছিল গরবরানের ঘরগেরস্তি। পাশেই মহানন্দা। সেই ঘাটে কাপড় কেচে নিজের জমিতে গুণ চিহ্নের মতো করে লাঠিতে দড়ি টাঙিয়ে কাপড় শুকনো হত। কাপড় ইস্ত্রি করা হয়ে গেলে গরবরান বাড়ি বাড়ি তা নিয়ে যেতেন।

হিন্দিবলয়ে এই নামটি তফসিলি জনজাতি বা অনগ্রসর শ্রেণির। গরবরান প্রধানত কৃষক সম্প্রদায়ের ছিল। আমার মনে হয়, বাংলায় এসে স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে তাঁরা মিশে গিয়েছিলেন। গরবরানের এক ছেলের নাম ছিল প্রকাশ। এক মেয়ের নাম ছিল সূর্যমুখী। এক সময়ে নিজের বিরাট জমি বিক্রি করে গরবরান নাকি বিশাল বাড়িও বানিয়ে ছিল।

কেন জানি না, বাবুপাড়ার সাহেবজান আর সেবক রোডের গরবরান আজও আমায় ভাবায়!

(লেখক উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

History Siliguri Sevak Road
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy