এই পশ্চিমবঙ্গেরই কোনও এক ইস্কুলে সম্প্রতি এক দিনান্তবেলায় স্কুলগেটের ঠিক বাইরে সহপাঠীর মুখে ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করে গাল ফুটো করে দিল ক্লাস টেন-এর কিশোর। কেন এই ভয়াবহ হিংস্রতা? প্রাথমিক সন্ধানে জানা গিয়েছে, সহপাঠী ছাত্রটি তাকে তার ‘মা’কে জড়িয়ে ‘খারাপ কথা’ বলেছিল। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় কী করুণ আর অসহায় ছিল কিশোর দু’টি— এই ভাবনার রেশ ধরেই মনে হল, কী অসহায় সেই সময়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের অবস্থানও। ওই কিশোররা অসহায়, কারণ ওরা এ কথা জেনে বড় হচ্ছে যে, ‘মা’ শব্দটির সঙ্গে লগ্ন হয়ে আছে নারীশরীরের এক অলঙ্ঘনীয় শুচিতার (বা সতীত্বের) ধারণা; আর তার সঙ্গে সঙ্গে এই বিশ্বাস যে, সেই শুচিতাকে আঘাত করলে যথাযথ এবং সম্ভবত সমর্থনযোগ্য প্রত্যাঘাত হবে হিংস্র শরীরী আক্রমণ। অন্য দিকে, প্রকৃত আক্রমণ যে পিতৃতন্ত্রের দিক থেকে, আবহমান কাল লালিত যৌনতার সামাজিক নির্মাণের দিক থেকে, বিদ্যালয়ের অঙ্গনে সেই কথাটি জোর গলায় উচ্চারণের কোনও সুযোগ নেই বলে, অসহায় শিক্ষকও।
আমাদের সংস্কৃতিতে পবিত্রতা ও শুচিতার অবিকল্প প্রতীক যে একটি নারীশরীর (কখনও বা মাতৃশরীর), পুরুষতন্ত্রের এই অভ্যেসটির প্রতিফলন তো ওই ছাত্রটি বাল্যবয়স থেকেই জেনে এসেছে ‘দেশমাতৃকা’ বা জাতীয়তাবাদের নির্মাণে, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ‘ভারতমাতা’ সাজে সাজানো সহপাঠিনীকে দেখে (তেরঙ্গা শাড়িতে, হাতে ত্রিশূল, কপালে সিঁদুর ও মাথায় মুকুটে এক অমোঘ নব্য হিন্দুত্বের চিহ্ন)। তার কাছে ‘মা’ আর কোনও মানুষী নয়, দেশ, জাতি বা ‘সতী’র সঙ্গে যখনতখন অদলবদল করে নেওয়ার মতো একটি ‘ধারণা’। ভারতীয় শিক্ষাবিদ মধু খুশওয়াধা সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখিয়েছেন যে অল্পবয়সি স্কুল-পড়ুয়াদের মধ্যে নারীর রক্ষাকর্তা বা ত্রাতা হিসেবে পুরুষের মূর্তি দৃঢ় ভাবে গেঁথে বসেছে। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বীরত্বের ও দেশপ্রেমের অনুষঙ্গ (দেশও নারী, তাই তার ‘সম্মান’ রক্ষণীয়)। এই ছেলেমেয়েরা পরিবার ও প্রতিষ্ঠান থেকে, হয়তো অজ্ঞাতসারেই, নিতে থাকে ক্ষমতা ও যৌনতার পিতৃতান্ত্রিক পাঠ। সে পাঠের শুরু সেই যবে ছেলেটিকে খেলনা বন্দুক আর মেয়েটিকে রান্নাবাটি ধরিয়ে দেওয়া হয় সে দিন থেকেই। ছেলেটিকে অবধারিত ভাবেই হয়ে উঠতে হবে হননশীল, হয়ে উঠতে হবে ত্রাসের অসহায় মুখ, আর মেয়েটিকে হয়ে উঠতে হবে সর্বংসহা, গৌরব মাখানো অথচ নিদারুণ এক মাতৃপ্রতিমা।
প্রশ্ন আসে, এমনতর ব্যবস্থাটির মাঝখানে কী ভূমিকা বিদ্যালয়ের? ‘শিক্ষাসমস্যা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, আমাদের ইস্কুলগুলি কী ভাবে হয়ে পড়েছে (পুঁজিবাদী) উৎপাদন ব্যবস্থার সমান্তরাল অঙ্গ। স্কুল হয়েছে কারখানার সমার্থক, সমাজ-অনুসারী চাহিদা-জোগান ও পণ্য উৎপাদনের কেন্দ্র। সমাজ চাইছে আধিপত্যকে প্রশ্ন না-করা, একই ছাঁচে ঢালা অনুগত মানুষ, অনুগত শিক্ষক, অনুগত ছাত্র, যে ‘ছাত্র’ উৎপন্ন (নির্মিত) হয় একটা প্রাতিষ্ঠানিক চিহ্ন শরীরে ধারণ করে, তার ‘মার্কশিট’ নির্ধারণ করে দেয় বাজারে তার ‘উপযোগিতা’, যে কোনও পণ্যের মতোই। সিলেবাস, পাঠ-প্রক্রিয়া, প্রশ্নপত্র, পরীক্ষায় নজরদারি (শেষোক্তটি প্রকৃত প্রস্তাবে সারস্বত জগতে সবচেয়ে অপমানকর শব্দ), মূল্যায়ন— সব কিছুকেই নির্ধারণ করে এই উপযোগিতার ধারণাটি।
মনে পড়ে, চার দশক আগে শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরে ‘ব্যাঙ্কিং’-এর উপমা ব্যবহার করে দেখিয়েছিলেন, শিক্ষার্থীকে কী ভাবে আমরা ‘ফাঁকা পাত্র’ হিসেবে ভেবে নিতে অভ্যস্ত হয়েছি, কী ভাবে কেবল ন্যারেটিভ আর তথ্য দিয়ে তাকে ভরিয়ে তুলতে চাই এক ধরনের ‘বিনিয়োগ’-এর আশায়। ভুলে যাই, শিক্ষার্থী ‘ফাঁকা পাত্র’টি হয়ে শ্রেণিকক্ষে আসে না। প্রতি মুহূর্তেই সে শিখছে, শিখছে তার পরিবার থেকে, পড়শির থেকে, সঙ্গী বা সঙ্গিনীর থেকে, সংবাদপত্র থেকে, টিভি থেকে, আর এখন খুব বেশি করে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। বিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানটির পাশাপাশি সমাজ নামক আর একটি ক্ষমতা-কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান থেকে চলছে তার লার্নিং-এর সমান্তরাল নির্মাণ। বিশেষত শিক্ষকের সঙ্গে তার সম্পর্কের নির্ধারক কেবল শিক্ষাঙ্গনের সংযোগটুকু নয়, তার বাইরের পৃথিবীও। ‘ছাত্রের হাতে শিক্ষক নিগ্রহ’ থেকে ‘শিক্ষকের হাতে ছাত্রের শ্লীলতাহানি’ গোছের শিরোনামগুলি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইলে শিক্ষকের জীবনছবি, সব মিলিয়ে ক্লাসরুমের বাইরে পড়ুয়ার মনে ‘শিক্ষক’-এর একটা ‘নির্মাণ’ চলতে থাকে। এই ছবিটি মনে নিয়েই ক্লাসরুমে শিক্ষকের সঙ্গে তার আদানপ্রদান বা বোঝাপড়া চলে। শিক্ষকের হাতে পাঠ্যবই, আরও একটু বিশেষ ভাবে বললে সিলেবাস। ব্যবস্থার দাবিতে শিক্ষককে সিলেবাসের প্রতি অনুগত থাকতে হয়, ‘সিলেবাস’ নামক একটি ‘ক্ষমতাশালী’ গঠনের আধিপত্যকে মান্য করতে অভ্যস্ত থাকতে হয়, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে। রাষ্ট্রের কেন্দ্রিকতার বা শীর্ষতার প্রতি মান্যতা রেখে চলা এ সমাজ, সংস্কৃতির বহুস্বরকে অস্বীকার করা এই শিক্ষাব্যবস্থা কিছুতেই বিভিন্ন বর্গের ছাত্রছাত্রীর জন্য নমনীয়, পরিবর্তনীয় সমান্তরাল কোনও সিলেবাসকে কিছুতেই গ্রহণ করবে না। বিষণ্ণ লাগে এই ভেবে যে, পরীক্ষার প্রশ্নের ধরন যেখানে পঠনকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে পাঠ্যবইয়ে, অনুশীলনে, শ্রেণিকক্ষে কোথাও নেই সন্ধানের কোনও সুযোগ, পাঠ হয়ে ওঠে না প্রশ্ন-জাগানিয়া।
তবুও প্রত্যাশা থেকে যেতে পারে, শিক্ষক কোনও এক অলৌকিক পাঠদানে এই সিলেবাসকে লক্ষ্যের তীরে পৌঁছে দেবেন। সেই অলৌকিকতার অবকাশ কোথায়? আমাদের স্কুল সার্ভিস কমিশনের ১০ নম্বরের ব্যক্তিত্বের পরীক্ষায় হবু শিক্ষকের মনের গড়নটি জেনে নেওয়ার কতটুকু উপায়ই বা আছে! সেখানে কি সন্ধান করা সম্ভব, হিন্দু শিক্ষক মুসলিম ছাত্রীর হাতে তৈরি ইদের সেমই উপহারটি জিহ্বাগ্রে ঠেকাবেন কি না? সমকামিতাকে পাপ মনে করেন কি না? কোনও ছাত্র কোনও কারণে কাঁদলে তাকে ‘মেয়ে’ বলে বিদ্রূপ করবেন কি না, অ-শহুরে বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠানের উৎসবে ব্যসনে সহপাঠক্রমিক ব্যবস্থায় কেবল ছাত্রীদেরই বাসন মাজতে উৎসাহিত করবেন কি না? কিংবা, তাঁর জাতীয়তাবাদের ধারণা আলিঙ্গন করে আছে কি না ‘হিন্দুত্ব’-এর কোনও জনপ্রিয় নির্মাণ? ছাত্রীর পিরিয়ড হলে তাঁর বয়ানে ‘শরীর খারাপ’ শব্দটিই উচ্চারণীয় কি না, শাস্তিদানে তিনি প়়ড়ুয়ার বিধাতাপুরুষ হয়ে উঠবেন কি না? সংশয় নেই, এঁরা প্রায় প্রত্যেকেই সহৃদয় মানুষ। শুধু দুঃখ এই, তাঁদের অজ্ঞাতসার, নিঃশর্ত সমর্পণ শুধু পিতৃতন্ত্রের আধিপত্যে। তাঁরা অনেকেই যে বড় হয়েছেন আরও দৃঢ় একটা ঔপনিবেশিক ও লিঙ্গ-নির্ধারক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে।
ক্ষমতার নিয়মেই একটা প্রতিরোধ তৈরি হয়। যেখানে গোটা ব্যবস্থাটাই ক্ষমতার অনুসারী সেখানে ফল অনিবার্য ভাবেই ধ্বংসাত্মক। মানুষের শক্তির, সময়ের, অর্থের গভীর ক্ষয় ও ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে শিক্ষকদের। না হলে প্রতি দিনের দেখা মুখগুলি ‘মূঢ়, ম্লান এবং মূক’ রয়ে যাবে। আমাদের খুঁজে নিতে হবে কোণঠাসা আর দিশাহারা পড়ুয়াটির নিজস্ব স্বর। সেই সঙ্গে নিজের স্বরটি খুঁজে নিতে ভুললে চলবে না। তবেই এই আঙিনায় শোনা যাবে বহু স্বর। আমরা সার্থক হব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy