Advertisement
E-Paper

রয়াল হিন্দুস্তানি গরু

অথচ সে কী না পারে! তার এক ফোঁটা মূত্রে ধ্বংস হয়ে যায় জীবাণু। শ্বাস ছাড়লে ভকভক করে বেরিয়ে আসে বিশুদ্ধ অক্সিজেন। চাইলেই শিঙে টেনে নামাতে পারে মহাজাগতিক শক্তি।

রাহুল রায় ও সোমেশ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৭ ১৩:১৫
শিল্পী: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

শিল্পী: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ব্যাপারটা ঠিকই ঠাউরেছিলেন সুকুমার রায়। ‘গরু কাঁদিতেছে’। জনমদুখিনি গরুর কাঁদা ছাড়া গতি কী? গোবেচারা কৃষ্ণের জীব সে। বাঁশি হাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়াবেন বলে গোপাষ্টমীতে কেষ্টঠাকুর তাকে মর্তে নামিয়েছিলেন। কিন্তু চোখ বোজার আগে জাতীয় পশুর চাকরিটি দিয়ে যাননি।

অথচ সে কী না পারে! তার এক ফোঁটা মূত্রে ধ্বংস হয়ে যায় জীবাণু। শ্বাস ছাড়লে ভকভক করে বেরিয়ে আসে বিশুদ্ধ অক্সিজেন। চাইলেই শিঙে টেনে নামাতে পারে মহাজাগতিক শক্তি।

তার চেয়েও বড় কথা, এত যে মহিমা, তবু সে গোবেচারাই। টানা চোখে টলটলে দৃষ্টি, আশরীর কল্পতরু স্নেহ। ঠিক যেন সর্বগুণসম্পন্না ও সুলক্ষণা ভারতীয় নারীটি, উদয়াস্ত খেটেও যে লাজুক, বাধ্য, সহবতে আনত। নেহাত ‘পশু’ বলতে বাধো-বাধো ঠেকে, নইলে কবেই তাকে জাতীয়, আন্তর্জাতিক, মহাজাগতিক পশু বলে মেডেল দেওয়া যেত।

তার সঙ্গে কার তুলনা? বাঘের? আরে রামো!

সে তো জাতেই উঠতে পারেনি। জাতীয় ফুল পদ্ম পাঁক থেকে উঠে এসেছে পতাকায়, চোখের জলে অযৌন জনন অভ্যেস করে ব্রহ্মচারী হয়ে উঠেছে জাতীয় পাখি ময়ূর। বেকায়দায় পড়ে গিয়েছে শুধু বাঘ।

রয়াল বেঙ্গল টাইগার!

যার হুংকারে দশ ক্রোশ দূরে ম্যানগ্রোভের শিকড় কেঁপে ওঠে, দোর দেয় ঝড়খালি-সজনেখালি, বনবিবির দোরে উপুড় হয় জঙ্গলে মরদ পাঠানো বিবি, ঈশান কোণে হেসে ওঠে দক্ষিণরায়— সে এমন কী ব্যাপার? আমিষ খায়, গায়ে বোটকা গন্ধ। সে কেন হবে জাতীয় পশু?

সত্যি বলতে, বাঘের তো সেই মর্যাদা ছিলও না অনেক দিন। প্রথমে জাতীয় পশুর মুকুটটা উঠেছিল সিংহের মাথায়।

সেটা ১৯৬১ সাল। গুজরাতের সিংহকে জাতীয় পশু করার প্রস্তাব প্রথম আসে গুজরাতি বল্লভভাই পটেলের কাছ থেকে। নেতাদের মধ্যে আঞ্চলিকতা আঁকড়ে আকচাআকচি তখনও ছিল। কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশে জাতীয় পশু বাছাইয়ের চেয়ে অনেক গুরুতর কাজ তো ছিলই। তা ছাড়া, নেহরু মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় মাথা বল্লভভাইয়ের পছন্দ নিয়ে কেউ বোধ হয় জলঘোলাও করতে চাননি।

সিংহের পক্ষে কিছু জোরালো যুক্তিও ছিল।

যে সব নিক্তিতে মেপে দেশে-দেশে জাতীয় পশু বেছে নেওয়া হয়, তার একটা যদি হয় রূপের জেল্লা, তো আর একটা হল দেশজ বিশ্বাস, আখ্যান, সংস্কৃতির পরতে তার জড়িয়ে থাকা। সে যদি বিপন্ন হয়, তবে তাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে রক্ষা করার দায় আরও বাড়ে।

অশোক স্তম্ভ থেকে দেবী দুর্গার বাহন— সিংহের ওজন তো নেহাত কম নয়। গির-এর প্রায় সাড়ে চোদ্দোশো কিলোমিটার বনভূমিতে তার সংখ্যাটাও কমে আসছিল ক্রমশ। পশুরাজকে বাঁচানো জরুরি হয়ে পড়ছিল। সিংহকে সিলমোহর দিতে তাই খুব কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।

কিন্তু চিন্তাটা পালটাতে শুরু করে ১৯৭১ সালে গাই-বাছুর প্রতীকে জিতে ইন্দিরা গাঁধী সাউথ ব্লকে ফেরার পরেই। জাতীয় পশু নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে আরও দুটো জিনিস নজর করা জরুরি, তত দিনে নয়াদিল্লির কাছে তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে একাধিক ভাবে। এক, দেশ জুড়ে কতটা ঠাঁই পাতা সে পশুর। দুই, কতটা সে দেশের একান্ত আপনার ধন— যেমন অস্ট্রেলিয়ার রেড ক্যাঙারু বা নিউজিল্যান্ডের কিউয়ি।

সে বছর শরতে সোভিয়েত রাশিয়ায় গিয়ে ইন্দিরা দেখে এলেন, সোভিয়েতের জাতীয় পশু অতিকায় ব্রাউন বেয়ার তুন্দ্রা থেকে তাইগা জুড়ে ছড়িয়ে— গভীর গণ্ডগ্রামেও দেখা মেলে তার। আর, আমাদের সিংহের ঠাঁই কিনা গোটা দেশে খালি গুজরাতে! দেশ জুড়ে কোথায় তার থাবার দাগ? সংখ্যালঘু বললেও ভুল হয়!

কার তবে হওয়া উচিত ভারতের জাতীয় পশু?

সফদরজঙ্গ রোডের লনে পায়চারি করতে-করতে আনমনেই প্রশ্নটা গুনগুন করছিলেন প্রিয়দর্শিনী, ‘হোয়াই নট টাইগার?’ কফির কাপ টেবিলে নামিয়ে ইন্দিরা-ঘনিষ্ঠ কর্ণ সিংহ বলে উঠলেন, ‘সার্টেনলি!’

সত্যিই তো! হাতের তালুর মতো অগুনতি রেখাদীর্ণ নদী-নালা খাঁড়ির সুন্দরবন থেকে উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি বনানী, পূর্বঘাট পাহাড়ের ঢাল থেকে দক্ষিণ ভারতের একের পর এক রাজ্য কিংবা দেশের পশ্চিম সীমান্ত বরাবর সহ্যাদ্রি পাহাড়ের ঘন জঙ্গল আর দেশের কোলে, মধ্য ভারতের নিবিড় অরণ্য— বাঘ নেই কোথায়?

সেটা ১৯৭২ সাল। কর্ণ তখন পর্যটনমন্ত্রী। আর, যথেচ্ছ শিকার ও সংরক্ষণের অভাবে রয়াল বেঙ্গল টাইগার অপস্রিয়মাণ একটা হলদে ডোরা। সংখ্যা হু-হু করে নামছে, গোটা দেশে সাকুল্যে হাজার দেড়েক শার্দূল। শোনা যায়, কর্ণেরই পরামর্শে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকে তৈরি করা হয় বন্যপ্রাণ আইন। ১৯৭৩ সালে জাতীয় পশুর মুকুট ওঠে বাঘের মাথায়।

উত্তর-পূর্ব থেকে মৃদু প্রশ্ন উঠেছিল, হাতি কেন নয়? দেশের বহু আনাচেকানাচে হস্তীযূথও তো বিরল নয়। কিন্তু সেই আবদার হালে পানি পায়নি। রাজকীয়তায়, সৌন্দর্য আর শক্তির মিশেলে, অপার রহস্যে বাঘ অনন্য তো বটেই। তার উপরে এই উপমহাদেশেই তার আসল ডেরাডান্ডা। দুনিয়া জুড়ে যারা বন্য বাঘের হিসেব রাখে, সেই ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’-এর হিসেবে, বর্তমানে মোট ৩৮৯০টি বুনো বাঘের মধ্যে ২৩৮০টি অর্থাৎ ৬১ শতাংশেরও বেশি রয়েছে শুধু এই দেশেই।

ভূভারতে বাঘ জড়িয়ে রয়েছে বিশ্বাসে, ধর্মে, লৌকিক আখ্যানে। শিবের পরনে ব্যাঘ্রচর্ম, আসন বাঘছাল। মহাভারতে শিবের বরেই ঋষি ব্যাঘ্রপদ। গুজরাতে বাঘ নেই, কিন্তু ভিলদের দুই আদি দেবী হুরা আর পুরা (অন্যত্র তাঁরাই অম্বা ও শেরাওয়ালি) বাঘের পিঠে ঘোরেন। যেমন ঘোরেন মধ্যপ্রদেশে বাঘো-দেবী, সুন্দরবনে বনবিবি। উত্তর মহারাষ্ট্র ও গুজরাতের সীমান্তে ওরলি সম্প্রদায়ের ভাগদেব নিজেই বাঘ। তরাইয়ের জঙ্গলেও বাঘ দেবী সোনারানি, সোঁদরবনে তিনি দক্ষিণরায়। বিদর্ভে ওয়াঘি দেবীও আদতে বাঘিনির আদিরূপ। রাজস্থানের বাঘেল বা বজরাওয়াত রাজপুতেরা আবার মনে করেন, বাঘ তাঁদের পূর্বসূরী। ছেলে-ভোলানো গল্পে বাঘের ঘরে ঘোগ, বাঘের উপর টাগ বা মামা-ভাগ্নে গোছের আমোদ তো রয়েইছে।

কিন্তু এখন নাকি এক জমানা এসেছে, রাজার ভয়ে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়! তাতে বাঘের মর্যাদাহানি হয়, না কি গরুর সম্ভ্রম বাড়ে, তা অবশ্য বলা শক্ত। কিন্তু বাঘ নিয়ে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে নাচার যে কিছু নেই, তা বেশ বুঝিয়ে দেওয়া যায়।

বাঁকা চোখ প্রশ্ন করে, বাঘ সুন্দর, আর গরু সুন্দর নয়? বাঘ যদি শক্তিধর হয়, গোমাতার তো অলৌকিক শক্তি! বাঘ নিয়ে গল্পগাছা, আর গরু নিয়ে নেই? দেশ জোড়া উপস্থিতি? সারা ভারতে গরুর সংখ্যা বাঘের কত হাজার গুণ? কোন আইনে বলেছে যে জাতীয় পশু হতে গেলে ‘বিশেষ’ হতে হবে, হতেই হবে বিরল বা বিপন্ন?

বাঁকা গলা বলে, বুঝলাম, বাঘ বিপন্ন। কিন্তু গরুও কি বিপন্ন নয়? মোটে ১৪ শতাংশ মুসলিম, আড়াই শতাংশ খ্রিস্টান আর কিছু বিধর্মী ও বেজাত হিন্দুর উদরপূর্তির জন্য কেটে সাবাড় করা হচ্ছে না কৃষ্ণের জীবদের? বাঘকে জাতীয় পশু করার বুদ্ধি যাঁর, রাহুল গাঁধীর সেই ঠাকুমাই তো ’৬৬ সালে শক্ত হাতে দমন করেছিলেন গোহত্যা বন্ধের দাবিতে গোরক্ষক-সাধুসন্তদের সংসদ অভিযান! দেশ স্বাধীন হওয়া ইস্তক গরুর নাম যে কখনও জাতীয় পশুর দৌড়েই এল না, সে-ও কি এক মোক্ষম ষড়যন্ত্র নয়?

এর পরে আর কথা চলে না।

ঘোমটা ঢাকা গোঁড়ামি যখন যুক্তির ভেক ধরে সামনে আসতে চায়, গলার জোরে বাঁকিয়ে দিতে চায় ইতিহাস, চুপ করে যেতে হয়। বরং অপেক্ষা করতে হয় সেই দিনটার জন্য, যখন কোনও ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি ঊরু চাপড়ানো কম্পিটিশনে পড়শিকে হারিয়ে দিলে আমরা কেউ আর বলব না, ‘শাবাশ! বাঘের বাচ্চা!’

বরং আমরা, আসমুদ্রহিমাচল সমস্বরে বলব: ‘আহা, গরুর যোগ্য কাজ!’

Cow Royal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy