অম্বেডকর কংগ্রেস-বিরোধিতা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাই বলে আজকের কংগ্রেস কি অম্বেডকর-খেলায় পিছিয়ে থাকতে পারে? ইতিহাসের ইতিবৃত্ত একটু চেপে গেলেই হবে। সর্বভারতীয় কংগ্রেসের তফসিলি বিভাগের চেয়ারপার্সন কে রাজু-র চিঠি গেছে রাজ্য কমিটিগুলির কাছে: ১২৫তম জন্মদিনটাকে ছাড়া যাবে না, বছরভ’র অনুষ্ঠান লাগিয়ে রাখতে হবে, দোরে দোরে গিয়ে বলতে হবে, কংগ্রেসই তফসিলি ও দলিতদের সেরা বন্ধু। আর, ইতিহাস পুরো বাদ দেওয়ারও দরকার নেই— বলতে হবে যে, স্বাধীনতার আগে কিন্তু দলিত ভোট প্রধানত জমা পড়ত কংগ্রেসের ভোট-বাক্সেই। ১৯৩৭ থেকে নতুন আইনে প্রাদেশিক নির্বাচন শুরু হতে কংগ্রেসই অধিকাংশ দলিত ভোট টেনে নেয়।
তথ্য হিসেবে কথাটা ঠিক, তবে অন্য তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে না পড়লে বেশ বিভ্রান্তিকরও বটে। মজা হল, আজকাল দেখা যাচ্ছে রাজনীতিকরা খুবই ‘ইতিহাসমনস্ক’। ইতিহাসের একটা ‘ঘরে আধা বাইরে আধা’ চর্চায় তাঁরা অনেক সময় ব্যয় করেন। যাঁর যেটুকু তথ্য কাজে লাগে, সেটা বাছাই করে ফসল ঘরে তোলেন, বাকিটা ঝাড়াই করে ফেলে দেন! ভারী ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা। নমো-নমো করে অম্বেডকর-পুজোটা সেরে নিয়ে, ইতিহাসের কুমির দেখিয়ে দলিত পার্টির কবজা থেকে দলিত ভোটটা বার করে এনে নিজের ঘরে পোরাও চলল, আবার অম্বেডকর কেন কংগ্রেস-বিরোধিতাতেই জীবন কাটালেন, তার মধ্যেও ঢুকতে হল না। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৫, প্রথম গোলটেবিল বৈঠক থেকে দ্বিতীয় প্রাদেশিক নির্বাচন: পুরো সময়টা জু়ড়ে অম্বেডকরের বক্তব্য ছিল, জাত-রাজনীতির মূল সমস্যাটা গাঁধী ও তাঁর কংগ্রেসের পক্ষে কোনও দিন বোঝা সম্ভব নয়। তাঁরা সকলেই প্রথমে উচ্চবর্ণের অভ্যেস অনুযায়ী জাত-ব্যবস্থার ‘বাস্তব’টা মেনে নেন, আর তার পর কতগুলো টুকটাক ঠুংঠাং সংস্কারের কথা বলেন। অম্বেডকর মনে করতেন, চিন্তার ওই ফ্রেমটা বিসর্জন না দিলে যথার্থ জাত-রাজনীতি তৈরি হতে পারে না। এই আন্দোলনমুখী জাত-রাজনীতি ও তার মধ্যে কংগ্রেসি ‘জাতীয়’ একতার দৃঢ়প্রোথিত বিরুদ্ধতা— ঝাড়াই-বাছাই ইতিহাস-চর্চায় সে সব অস্বস্তিকর জিনিস দলিত ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া গেল। বেমালুম চেপে যাওয়া গেল যে, কংগ্রেসের উদার বদান্যতায় নয়, কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াই করেই সে দিন অনগ্রসর জাতের জন্য আসন সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছিল।
কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপির জাতীয়তাবাদ আরও বেশি এককাট্টা, একবগ্গা, তা আর বলতে হয় না। কিন্তু ইতিহাসের হাতসাফাইয়ে বিজেপির খাপেও কী সুন্দর ঢুকিয়ে ফেলা যাচ্ছে অম্বেডকরকে। বলা হচ্ছে তিনি কেমন ‘ইনক্লুসিভ’ দেশ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। যেন তাঁর আদর্শ বহন করার জন্যই নরেন্দ্র মোদী ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন। অম্বেডকর কিন্তু ‘ইনক্লুশন’ বা সর্বজনিকতার কথা বলেছিলেন সমাজতন্ত্রের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে। মোদীমশাইদের ‘ইনক্লুসিভ-নেস’ বিষয়ে অম্বেডকর কী ভাবতেন, সেটা কেলকররা না বললেও আমরা একটু বলতে পারি। বলেছিলেন, ‘হিন্দু সোসাইটি ইজ আ মিথ’। হিন্দু সমাজকে সত্যি অর্থে ‘সমাজ’ বলা চলে না, ওটা কেবল কতকগুলো জাতের সমাহার। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময়টুকু বাদ দিয়ে এর মধ্যে কোনও মিলমিশ নেই, সুতরাং কোনও সমাজও নেই!
নানা দলের নানা ‘হাতসাফাই’-এ জরুরি কথাগুলো স্বভাবতই কেউ বলে না। কারণ জরুরি কথাগুলোর জন্য কোনও ভোট নেই। অথচ সংবিধানের প্রধান প্রণেতা কেবল দলিত রাজনীতির নেতা ছিলেন না, ছিলেন বড় রকমের চিন্তাবিদ। আজীবন মতবিরোধ সত্ত্বেও তাঁর এই দার্শনিক সত্তাটিকে ভারী শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন গাঁধী, আর তাই নেহরু ও পটেলকে ১৯৪৬-এ এক রকম বাধ্য করেছিলেন অম্বেডকরকে সংবিধান-সভায় অন্তর্ভুক্ত করতে। একটা কথা না বললেই নয়। অনেক সমসাময়িক আইডিয়োলগ-এর সঙ্গে অম্বেডকরের একটা পার্থক্য ছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বাস্তবমুখী, মাটিতে তাঁর পা শক্ত করে গাঁথা। নবজাতক দেশের পক্ষে কোন পথটি বাঞ্ছিত, কোন পথে এগোলে দেশ সামাজিক পরিবর্তনের দিকে দ্রুত এগোবে, এ সব তো কেবল দার্শনিক চিন্তা নয়, প্রায়োগিক চিন্তাও। প্রতিটি ক্ষেত্রে এই চিন্তা করে গিয়েছেন তিনি। অথচ এই সব আলোচনা শুনব না আমরা। বাছাবাছির ইতিহাসে জায়গা পাবে শুধু তাঁর দলিত পরিচিতি আর দলিত রাজনীতির আকাঙ্ক্ষাটুকু। আর কিছু নয়। অম্বেডকর মানেই প্রান্তের ভোট টেনে এনে কেন্দ্রে ঢোকানোর ব্যবস্থা। কিন্তু কেন্দ্রের দিক থেকে প্রান্তের দিকে হেঁটে যাওয়ার পথও যে তিনি দেখিয়েছিলেন, কেউ তা মনে করাবে না।
সুতরাং আমরা জানব না যে, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়েও কেন তিনি মনে করতেন ব্যক্তির অধিকার সংকুচিত করে কোনও তন্ত্রই বাঞ্ছনীয় নয়, এবং সাম্যনীতিতে আস্থা রেখেও কেন মনে করতেন, সাম্য-নীতি মানেই তথাকথিত সাম্য-রাজনীতি নয়, মাথায় মুগুর মেরে প্রতিটি মানুষকে সমান করে দেওয়া না। বরং প্রকৃতিগত ভাবেই অসম মানুষের জন্য সমাজ-অর্থনীতির সুযোগসুবিধের ক্ষেত্রে, ন্যায় ও নীতির প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাম্য আনা দরকার। আমরা জানব না যে, দেশকে তিনি গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু গণতন্ত্র বলতে কেবল রাষ্ট্রগঠনের পদ্ধতিটুকুই বোঝেননি, একটা সমাজ-জীবনের শর্ত বুঝেছিলেন, যেখানে প্রাত্যহিক জীবনের সব কাজে নাগরিক সহযোগিতা বহাল রাখা যাবে।
এবং আমরা জানব না যে, দেশের চালু ধর্মসংস্কৃতির বিরুদ্ধে কত বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল তাঁর। যে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা গণতন্ত্রের শর্ত, সেটাই ধর্মেরও শর্ত বলে তিনি ভাবতেন। আজকের প্রবল প্রচণ্ড অম্বেডকর-চর্চার মধ্যে এই কথাটা একদম শোনা যাবে না যে, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, হিন্দু সমাজের মধ্যে একটা প্রকৃতিগত দমনমুখিতা আছে। উনিশশো ত্রিশের দশকে ‘জাতপাত-এর বিনাশ’ বা ‘অ্যানাইহিলেশন অব কাস্ট’ নামে তাঁর সুবিখ্যাত লেখা সম্প্রতি অরুন্ধতী রায় নতুন করে সম্পাদনা করেছেন, একটি বিস্ফোরক মুখবন্ধ-সহ। সেখানে পাওয়া যায় হিন্দু সমাজের অন্ধ শাস্ত্রমুখিতার বিরুদ্ধে অম্বেডকরের তীব্র সমালোচনা, ‘হিন্দু দর্শন’-এর সমূল প্রত্যাখ্যান। প্রত্যাখ্যান জাতপাত-ভাবনার সূত্রেই। অম্বেডকরের জাত-রাজনীতি ও তাঁর সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র ভাবনার মধ্যে একটা অঙ্গাঙ্গি সংযোগ আছে, যে কথাটা বেশি শুনি না আমরা।
অম্বেডকর শেষ পর্যন্ত সাম্য বা মুক্তি খুঁজে পান বৌদ্ধ ‘ধম্ম’-এর মধ্যে। নিজেই বলেন, তাঁর সমস্ত কাজে ‘ধম্ম’ছায়া। অবশ্য অর্থনীতিবিদ-সমাজতাত্ত্বিক জঁ দ্রেজ বলবেন, অম্বেডকরের অন্যথা তীক্ষ্ণ যুক্তিবাদিতার সঙ্গে এই প্রবল বৌদ্ধধর্ম-প্রীতি ঠিক খাপ খায় না। উল্টো দিকে আবার, এও মনে হতে পারে, পাণ্ডিত্য মানে তো কেবল তীক্ষ্ণ যুক্তি নয়। হয়তো যুক্তির ভর হিসেবে কতগুলি মঙ্গল-আদর্শেরও প্রয়োজন হয়, হয়তো সেখান থেকেই শুরু তাঁর ‘ধম্ম’-উৎসাহ।
কেলকর আক্ষেপ করেছেন, অম্বেডকরকে ঠিক করে কেউ জানে না! তাঁরা যেটা ‘ঠিক’ বলে মনে করেন, তার মধ্যে অবশ্যই এ সবের দূরতম ছায়াও নেই। তিনি ও তাঁরা অবশ্যই আশা করেন, তাঁদের মতো রাজনীতিকদের পছন্দমতো তথ্য নির্বাচনটুকুর মাধ্যমেই আমরা বাবাসাহেবকে জেনে নেব। তাঁরা ইতিহাস ছেঁকে নিয়ে রেঁধেবেড়ে পরিবেশন করবেন, আমরা বিনা প্রশ্নে তুলে নেব। আজকের অম্বেডকর সেটুকুতেই আইকন হয়ে থাকবেন!