এই মুহূর্তে অসমে নাগরিক পঞ্জির বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। দিল্লির এক তথাকথিত সর্বভারতীয় সংবাদ চ্যানেল থেকে এই বিষয়ে আয়োজিত বিতর্কে অংশ নিতে অনুরোধ এল। চ্যানেলটির গেস্ট কো-অর্ডিনেটরের প্রথম প্রশ্ন ছিল, আমি এনআরসি নিয়ে অমিত শাহের পক্ষে? না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের? ‘‘আপনি কোন দিকে, তৃণমূল না বিজেপি— বিতর্কের আগে এটা জেনে রাখা আমাদের রুটিন কাজ।’’
বললাম, এ তো আশ্চর্য ব্যাপার! অমিত শাহ বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি। এ ব্যাপারে তিনি যা বলছেন, সেটা তাঁর দলের অবস্থান। অমিত শাহ যা বলছেন, বাবুল সুপ্রিয় বা রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ও তা-ই বলবেন। আবার মমতা যা বলছেন, সেটাই সংসদে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন। কারণ সেটাই তৃণমূলের রাজনৈতিক লাইন। মাফ করবেন। আমি কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নই। আমি স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসাবে নিজের কথাই বলতে পারি।
মজার ব্যাপার হল, কংগ্রেস এবং বিজেপি, এই দুই সর্বভারতীয় দলই কিন্তু মনে করে একটি নাগরিক পঞ্জি আসলে রাষ্ট্রের পক্ষে সত্যিই প্রয়োজনীয়। ফারাক হল, ১৯৮৫ সালে রাজীব গাঁধী অসম চুক্তি করে এই নাগরিক পঞ্জি গঠনের প্রস্তাব মেনে নেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল অহমিয়া জাতিসত্তার নিজস্ব পরিসর প্রদান। এই চুক্তির মাধ্যমে বরং তৎকালীন ‘বাঙালি খেদাও’ আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছিল। আজ এত বছর পর মোদী জমানায় অসমে বিজেপি সরকার সে রাজ্যে নাগরিক পঞ্জি প্রকাশ করে দিল। তড়িঘড়ি করে একটি খসড়া তালিকাও প্রকাশিত হল। তাতে সেখানকার বাসিন্দা প্রায় ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষের নাম বাদ গিয়েছে।
আমি আমার কথাই বলব। নাগরিক পঞ্জি শুধু অসম কেন, গোটা দেশেই হওয়া প্রযোজন বলে আমি মনে করি। বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু, আর যা-ই হোক, কোনও দেশের পক্ষেই খুশি হওয়ার মতো খবর নয়। অর্থনৈতিক তো বটেই, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সঙ্কটও ডেকে আনতে পারে এই মানুষের বোঝা। আমাদের দেশে বেআইনি উদ্বাস্তু এবং অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা যে হুহু করে বাড়ছে, তা নিয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহ আছে?
ধরুন, আপনার খুব ইচ্ছে হল, কিন্তু আপনি কি ভিসা ছাড়া বেআইনি ভাবে নিউ ইয়র্ক বা লন্ডন শহরে থাকতে পারেন? পাসপোর্ট ছাড়া যেতে পারেন অন্য কোনও সার্বভৌম রাষ্ট্রে? না। বেআইনি ভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে গোপন করে চোরের মতো থাকছেন, সে তো ভিন্ন। টুরিস্ট ভিসা নিয়ে গেলেও সে অল্প কিছু দিনের জন্য। কিন্তু স্থায়ী ভাবে কি থাকতে পারবেন? পারবেন না। এমনকি মেহুল চোক্সীর মতো লোকও অ্যান্টিগাতে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেছেন গোপনে নয়, সে দেশের নিয়ম মেনে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন হওয়ার পর ওই অঞ্চলের একটি দেশের লোক বিনা বাধায় অন্য দেশে যেতে পারেন। কিন্তু তা বলে কি তাঁরা অন্য রাষ্ট্রে স্থায়ী নাগরিকত্ব পেতে পারেন? সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও, বিশেষত নেপাল–ভুটানে, আজও যাওয়া সহজ, ভারতীয়দের পাসপোর্ট দেখাতেই হয় না। আজকাল সেখানেও কড়াকড়ি বাড়ছে। বহু দেশে ভিসা অন্ অ্যারাইভাল প্রথা আছে। কিন্তু সার্কের ক্ষেত্রেও অন্য রাষ্ট্রে উদ্বাস্তু হয়ে গিয়ে অনন্ত কাল থাকা যায় না। কিছু দিন আগে উদ্বাস্তু নিয়ে জার্মানির প্রতিক্রিয়া দেখেছি। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং টেরেসা মে অভিবাসন নিয়ে যে ঘোষণা করেছেন তা দেখে আমি রসিকতা করে বলি, ওঁরাও ওঁদের দেশের ‘মোহন ভাগবত’ হয়ে উঠেছেন। ভারতে কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল তখনও এমন পঞ্জির কথা ভাবা হয়েছিল।
আডবাণী যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও আডবাণীকে এই অনুপ্রবেশের ভয়াবহ সমস্যার কথা বলে ব্যবস্থা করার আর্জি জানান। আডবাণী তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর শঙ্কার কথা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন। গোপাল গাঁধী যখন রাজ্যপাল ছিলেন তখন মনে আছে, দিল্লিতে এক রাজ্যপাল সম্মেলনে এসে রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ অনুপ্রবেশকারীদের জন্য এক ঘুমন্ত ডায়নামাইটে পরিণত হয়েছে। গোপাল গাঁধী তো আর বিজেপির লোক ছিলেন না।
সমস্যা বেধেছে অন্যত্র। নাগরিক পঞ্জি গঠনের পদ্ধতি নিয়ে। যে ভাবে তড়িঘড়ি শুধু একটি প্রদেশ থেকেই চল্লিশ লক্ষ মানুষকে অবলীলায় বাদ দেওয়া হল, যে ভাবে বহু মানুষ, যাঁরা অনুপ্রবেশকারী নন, দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা, তাঁদের নাম বাদ গেল, তাতে কিন্তু মনে হচ্ছে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। এ পদ্ধতি ক্রটিপূর্ণ। অক্ষরজ্ঞানহীন বহু দরিদ্র মানুষ কেবল কিছু কাগজপত্র না থাকার জন্য আকস্মিক ‘বিদেশি’ হয়ে যাবেন, সেটা কি গণতন্ত্র? সেটা কি অমানবিক নয়? অক্ষরজ্ঞানহীন দরিদ্র মানুষই শুধু নয়, আমার গুজরাতি সাংবাদিক বন্ধু শীলা ভাট বলছিলেন, তাঁর বার্থ সার্টিফিকেট হারিয়ে গিয়েছে, এখনও আধার কার্ড হয়নি, কোনও কাগজপত্র ছাড়াই এত দিন গুজরাত, মুম্বই, দিল্লিতে থেকেছেন। ঘোর দেশপ্রেমী শীলাকে বললাম এ বার গোটা দেশের পঞ্জি হলে তুমিও কিন্তু বিদেশি।
আসলে নাগরিক পঞ্জির এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে রাজনীতি। সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু, বাঙালি-অসমিয়া, বাঙালি-অবাঙালি, কত রকমের বিপজ্জনক রাজনীতি। সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। রাষ্ট্রিক কাজটাই উপলক্ষ হয়ে যায়। প্রধান হয়ে ওঠে দুর্গন্ধলাঞ্ছিত ভোট-রাজনীতি।
হিন্দু শরণার্থী হলে ঠিক আছে— আপনার কোনও বিপদ নেই। আর মুসলমান অনুপ্রবেশকারী হলে আপনাকে বিদায় নিতে হবে। এ বড় বিপজ্জনক, কদর্য রাজনীতি। এটা নতুন কিছু নয়। এ হল সঙ্ঘের মতাদর্শগত অবস্থান। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে এর ব্যবহার দেখে আমি শঙ্কিত।
পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শক্তিশালী ভোটব্যাঙ্ক হল এই জনসমাজ। সংখ্যালঘু রাজনীতির প্রতিপক্ষ হিসাবে তাই হালফিল বিজেপি পশ্চিমবঙ্গকেই তাদের সাম্প্রতিকতম ল্যাবরেটরিতে পরিণত করছে। সংখ্যালঘু সমাজের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুপ্রবেশের সমস্যা নিয়ে নিজেই সরব হচ্ছেন না।
তবে বাঙালিদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধের যে প্রশ্নটি মমতা তুলছেন, তার সঙ্গে আমি একমত। কারণ মনে পড়ে বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন বাল ঠাকরে বেঁচে। মহারাষ্ট্র থেকে বহু বাঙালিকে শিবসেনা সে দিন ট্রেনে তুলে হাওড়া স্টেশন পাঠিয়ে দেয়। দেখা গেল, তাঁরা যে সবাই বাংলাদেশি তাও নয়, বহু মানুষ পশ্চিমবঙ্গবাসী। মদনলাল খুরানা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তখন বিজেপি নানা বস্তি থেকে বাংলায় কথা বলা বহু মানুষের মাথা ন্যাড়া করে কলকাতায় ফেরত পাঠায়। তারাও অনেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা বা কোচবিহারের মানুষ ছিলেন। আর অনুপ্রবেশকারী হলে হাওড়া স্টেশন বা কলকাতায় কেন, তাঁদের তো ভারত সরকারের কাছেই সমর্পণ করার কথা।
নাগরিক পঞ্জি, সে তো বড় ব্যাপার, কিন্তু চলতি ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারেই যে কোনও রাজ্যে পুলিশ যে কোনও অনুপ্রবেশকারীকে গ্রেফতার করতে পারে। তা না করে যেটা হচ্ছে, সেটা হল ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি। চাই সংবেদনশীল মানবিক বিবেচনা। অন্ধ রাজনৈতিক স্বার্থ নয়। রাষ্ট্রের প্রভুরা বুঝছেন না, ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করতে গিয়ে তাঁরা ভারতকে আর একটা সিরিয়া বা মায়ানমার হওয়ার পথে ঠেলে দিচ্ছেন! সাধু সাবধান!