Advertisement
E-Paper

রক্তাল্পতার সহজ ওষুধ

গ্রাম শহর নির্বিশেষে অনেকেই জানেন না যে সবুজ পাতাযুক্ত বহু সবজি, মটরশাক, সরষে শাক, ফুলকপির পাতা, বা পুদিনা পাতায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে লোহা।

অচিন চক্রবর্তী ও সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৮ ০৬:০০

শুনলাম, নারীজাতির প্রতি সম্মান দেখাতে ৮ মার্চ এক বহুজাতিক ফাস্টফুড বিপণি তাদের লোগোটিকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে M-কে W করে রেখেছিল দিনভর। সোনার গয়না, প্রসাধনসামগ্রী, এমনকী মাসকাবারির জিনিসের দামের ওপরেও ছাড় পাওয়া গেছে সে-দিন। এমন বিচিত্র পথেই উদ্‌যাপিত হল আন্তর্জাতিক নারী দিবস।

মনে পড়ছিল পূজা, সীমা, তসলিমাদের কথা। নারীদিবসে বলার মতো এঁদের কোনও গল্প নেই। এঁরা কেউ অল্প বয়সে বিয়ের কথায় বেঁকে বসেননি; কেউ কঠিন বাধা টপকে এমন কিছু কীর্তি স্থাপন করেননি যে তাঁদের নিয়ে খবর হবে। এঁদের আছে শুধুই বুক ধড়ফড়, মাথাঘোরা আর শ্বাসকষ্ট। বাংলার ঘরে-ঘরে এঁদের দেখা মিলবে। ‘ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?’ ‘হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু বলেছেন রোগ নেই, তবে শরীরে রক্ত কম।’ অনেকে অবশ্য ডাক্তারের কাছেও যাননি, কারণ কোনও অভিজ্ঞ জন বলেছেন ‘ও কিছু নয়’। শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কোন স্তরে নেমে গেলে এই উপসর্গগুলি দেখা দিতে পারে, তা এঁদের অজানা। সে-সব নিয়েই গৃহস্থালির কাজ করে যেতে হয়। মাথা ঘোরা বেশি হলে তাও অসম্ভব হয়ে ওঠে যখন, জোটে গঞ্জনা। গ্রাম কিংবা শহর— পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বত্র একই ছবি। মাথা ঘোরা বা বুক ধড়ফড় যে শুধু রক্তাল্পতার কারণেই হয়ে থাকে, তা নয়। তবে চতুর্থ জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা (সংক্ষেপে এনএফএইচএস-৪) অনুসারে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে ৫৩% রক্তাল্পতায় ভোগেন। আর এ রাজ্যে ৬২.৪%। আরও উদ্বেগের কথা, এনএফএইচএস-৩ এবং ৪-এর মধ্যে প্রায় দশ বছরের ব্যবধানে এই হার প্রায় একই থেকে গিয়েছে। রক্তাল্পতা যেহেতু ডেঙ্গি নয় যে আচমকা থাবা বসিয়ে নারীপুরুষ নির্বিশেষে জীবন কেড়ে নেবে, তাই এ-নিয়ে খবরও হয় না।

মহিলাদের রক্তাল্পতা নিয়ে যে একেবারেই ভাবা হয়নি, তা নয়। তবে এ-বাবদে সরকারি উদ্যোগের সিংহভাগটাই দেখা গেছে প্রসূতিদের ক্ষেত্রে। গর্ভাবস্থায় লোহা ও ফলিক অ্যাসিডযুক্ত ট্যাবলেট বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন তাঁরা। তাই হয়তো ২০০৫-০৬ এবং ২০১৫-১৬-এর মধ্যে গোটা দেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে রক্তাল্পতায় ভোগা মহিলার শতাংশের হিসাবে যেখানে পরিবর্তন হয়েছে খুব সামান্য, গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা সেখানে চোখে পড়ার মতো। ২০০৫-০৬ সালে গর্ভবতীদের মধ্যে রক্তাল্পতায় ভুগতেন দেশে ৫৮% এবং এই রাজ্যে ৬৩%। ২০১৫-১৬ সালে দেশে এবং রাজ্যে হিসাবটা ৫০ শতাংশের আশপাশে। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মহিলাদের বেশির ভাগই যেহেতু গর্ভবতী নন (জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুসারে এঁদের অনুপাত ৯৫%), রক্তাল্পতার চিত্রটা তাঁদের ক্ষেত্রে একই রকম থেকে যাওয়ায় সমীক্ষার শেষ দুটি রাউন্ডে মহিলাদের রক্তাল্পতার সামগ্রিক হিসাবে তেমন কোনও উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। গর্ভাবস্থায় রক্তাল্পতা মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের উপরে। তার গুরুত্বকে এতটুকু খাটো না করেও বলা যায়, গর্ভবতী নন কিন্তু রক্তাল্পতায় ভুগছেন, এমন মহিলাদের নিয়ে খুব সম্প্রতি সরকারি স্তরে কিছু ভাবনাচিন্তা শুরু হলেও সাম্প্রতিকতম তথ্য বড় একটা ভরসা জোগায় না।

বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে এই বয়সের মহিলাদের অধিকাংশেরই দিন কাটে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে, বাড়িতে বা বাড়ির বাইরে। তারই মধ্যে আছে ঋতুস্রাব, বক্রকৃমির সংক্রমণ এবং রক্তাল্পতা, অর্থাৎ শরীরে লাল রক্তকোষ এবং তার অক্সিজেন বহনের ক্ষমতা কমে যাওয়া, প্রথমেই যার প্রভাব পড়ে তাঁদের কর্মক্ষমতায়। রক্তাল্পতা বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি ও মনঃসংযোগের ক্ষমতা কমায়, গর্ভধারণের ক্ষেত্রে বা গর্ভাবস্থায় সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। জানতে ইচ্ছা করে, কেমন এই মহিলাদের রোজনামচা।

অল্প একটু কাজ করলেই হাঁপিয়ে ওঠে বছর আঠারোর সোনামণি খাতুন। সারা দিনই তার মাথা ঘোরে, গা-হাত-পা ঝিমঝিম করে, বুক ধড়ফড় করে, বুকে যন্ত্রণা হয়। ডাক্তার দেখিয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করলে হাসে। বলে, ‘দেখিয়েছিলাম এক বার। রক্ত পরীক্ষা হয়েছিল, ওষুধ দিয়েছিলেন।’

—তার পর?

—কয়েক দিন খেয়েছিলাম। তেমন কোনও উপকার হয়নি। পেটে খুব অস্বস্তি হত।

—সে জন্য ছেড়ে দিলে?

‘সত্যি গো, বড্ড অসুবিধে হয় ওই ওষুধগুলো খেলে। পেট পরিষ্কার হয় না, কিচ্ছু হজম হয় না, খাওয়ার ইচ্ছে চলে যায়।’ পাশ থেকে যোগ দেয় সোনামণির ছোট বোন মামণি। ক’দিন আগে এক পাঁজা বাসন নিয়ে পুকুরঘাটে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল সে। দাদার বউ তাহেরা সোনামণির বয়সি, কোলে চার মাসের ছেলে। পাশের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে রক্ত বাড়ানোর ওষুধ পায় সে-ও।

—ঠিক মতো খাও তো?

তাহেরাও হাসে। বলে ‘মাঝেমাঝে খাই। টানা খেলে পেট খারাপ হয়।’ ছেলেকে সোনামণির কোলে দিয়ে জরির কাজ নিয়ে বসে তাহেরা। স্কুলছুট মামণি রান্না চাপায়। সংসার সামলায় তিন জনে মিলে। রাত থাকতে উঠে মা সবজি নিয়ে শহরে যান।

—কী সবজি?

—নানা রকম… থোড়, মোচা, ডুমুর, কুলেখাড়া শাক। সঙ্গে কাঁটালি কলা আর হাসের ডিম।

—কুলেখাড়া তোমরা খাও না?

—না। কাঁটা বাছতে হয়, স্বাদ ভাল নয়, কিন্তু আজকাল নাকি শহরে খুব বিক্রি হয়।

লোহার উৎস হিসাবে কুলেখাড়ার খ্যাতি আছে, কিন্তু এখনও গ্রামের এই সহজলভ্য, সস্তা বিস্ময়-গাছটির পুষ্টিগুণ সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল নন স্থানীয় মানুষ। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ১০০ গ্রাম কুলেখাড়ায় মেলে ৭.০৩ মিলিগ্রাম লোহা, যা প্রায় শুকনো খেজুরের সমান। শুধু তা-ই নয়, কুলেখাড়ায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, বিটা ক্যারোটিন, রাইবোফ্লেভিন, ক্যালশিয়াম ও তামার মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। খাদ্যগুণে পালং, কলমি বা মেথিশাক কুলেখাড়ার সঙ্গে তুলনাতেই আসে না।

গ্রাম শহর নির্বিশেষে অনেকেই জানেন না যে সবুজ পাতাযুক্ত বহু সবজি, মটরশাক, সরষে শাক, ফুলকপির পাতা, বা পুদিনা পাতায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে লোহা। খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের বয়ঃসন্ধি বিভাগের ‘ন্যাশনাল আয়রন প্লাস ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পটির নির্দেশাবলিতে খাদ্যে লোহার উৎসের তালিকায় মেথিশাক (যার ১০০ গ্রামে রয়েছে ১.৯৩ মিলিগ্রাম লোহা) অন্তর্ভুক্ত হলেও কুলেখাড়া বা ফুলকপির পাতার উল্লেখ নেই।

শুধুমাত্র বয়ঃসন্ধির মেয়েদের জন্য ‘কিশোরী শক্তি যোজনা’, ‘এনপিএজি’ (‘নিউট্রিশন প্রোগ্রাম ফর অ্যাডোলোসেন্ট গার্লস’) বা ‘সবলা’র মতো কয়েকটি বিশেষ কেন্দ্রীয় প্রকল্প থাকলেও, ২০১৩ সালে চালু হওয়া আয়রন প্লাস প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সি সমস্ত মহিলাকে। সপ্তাহে এক বার তাঁদের পাওয়ার কথা লোহা ও ফলিক অ্যাসিডের বড়ি। জোর দেওয়া হয়েছে সচেতনতা বৃদ্ধির উপরেও। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের এই বড়ি দেওয়ার কথা স্কুলে, স্কুলছুট ছেলেমেয়েদের এবং সন্তানধারণে সক্ষম বয়সকালের সমস্ত মহিলাকে বাড়িতে। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায় বয়ঃসন্ধির মেয়েদের রক্ত পরীক্ষা করানো হচ্ছে আইসিডিএস কেন্দ্র থেকে প্রতি চার মাসে এক বার। দেওয়া হচ্ছে লোহা ও ফলিক অ্যাসিডের বড়ি। সেই বিবরণ নথিভুক্ত থাকছে মেয়েটির ‘কিশোরী কার্ড’-এ।

এই উদ্যোগগুলি ভাল। তবে রক্তাল্পতা হ্রাস নিশ্চিত করতে হলে লোহা আর ফলিক অ্যাসিড বিতরণ ঘিরে একমুখী ভাবনা থেকে কিছুটা সরে আসতে হবে বোধহয়। লোহাযুক্ত বড়ি নিয়মিত খাওয়ায় অনীহার ব্যাপারটিও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। অন্য দিকে, শরীরে ভিটামিন-সি এবং প্রোটিনের স্বল্পতার জন্যে লোহাযুক্ত ট্যাবলেট তেমন কার্যকর নাও হতে পারে।

শহরের নামকরা রেস্তরাঁয় আজকাল ‘চিকেন এস্কালোপ’, বা ‘অক্টোপাস মেলাঞ্জ’-এর মতো মুখরোচক, ফিউশন-রান্নায় মিশছে কুলেখাড়া। মোটা টাকার বিল মিটিয়ে যাঁরা এই পদগুলি চেখে দেখছেন, এর ফলে তাঁদের স্বাস্থ্যের কতটা উন্নতি হচ্ছে, সে প্রশ্ন থাক। তবে ‘দেশীয় জ্ঞান ব্যবস্থা’ নিয়ে সারা পৃথিবীতে যখন তোলপাড় ঘটে যাচ্ছে, তখন মিড-ডে মিলের খিচুড়ি বা তরকারিতে কুলেখাড়া বা কপির পাতা কেন মেশানো হবে না, সেই প্রশ্নটি করা দরকার। রুটিনমাফিক কতকগুলি সরকারি প্রকল্পের গাইডলাইন মেনে স্থানীয় স্তরে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কতখানি এগিয়েছি আমরা, সময় এসেছে সেই প্রশ্নটিকেও তুলে ধরার।

ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতায় যথাক্রমে অধিকর্তা ও শিক্ষক

Anemia Medicine Women Health Protection
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy